জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার নেপথ্যের নায়ক স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমানের হাতে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তির প্লাটফর্ম বিএনপি। সামরিক জান্তার ছত্রছায়ায় গড়ে উঠা এই দলের অভ্যন্তরে প্রতিষ্ঠার শুরুতেই গণতন্ত্রের চর্চা অনুপস্থিত ছিল। ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর তার পত্নী খালেদা জিয়া দলের হাল ধরেন, তখন দলের অভ্যন্তরে স্বল্প পরিসরে গণতন্ত্রের চর্চা শুরু। ওই সময়ে দলটির সাংগঠনিক কাঠামোও বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে এমন সব সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব নিয়েছেন, এর ফলে বিপর্যয়ের দিকেই ঠেলে দেওয়া হয়েছে দলকে।
২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন, ২০১৫ সালের পেট্রোল বোমার আন্দোলন ছিল বিএনপির এ যাবৎকালের সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক সিদ্ধান্ত। জোট শরিক জামায়াতে ইসলামীর প্ররোচনায় ওই অবিমৃশ্যকারী সিদ্ধান্তে বিএনপি ‘ল্যাথারিজম’ রোগে আক্রান্ত হয়েছে, এমনটি মনে করেন রাজনীতি বিশ্নেষকরা। এর পর ২০১৮ সালে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আদালতের রায়ে দণ্ডিত হয়ে কারান্তরালে চলে গেলে তাঁর পুত্র (দুর্নীতি মামলা ও একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলায় সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামি) তারেক রহমানকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা হয়। তাকে নেতৃত্বে রাখার প্রয়াসে বিএনপি তাদের গঠনতন্ত্রের একটি ধারা বিলুপ্ত করে। ওই ধারায় বলা হয়েছিল, নৈতিক স্খলনজনিত অভিযোগে বাংলাদেশের কোনো বিধিবদ্ধ আদালত কর্তৃক সাজাপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি বিএনপির সদস্য হওয়ার অযোগ্য বলে গণ্য হবেন। খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর দল চলে যায় তারেক রহমানের একক নিয়ন্ত্রণে।
সাংগঠনিকভাবে বিপর্যস্ত বিএনপিকে সবল করার জন্য গত কয়েক বছরে নানাবিধ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ঘোষণা করা হয়েছে নানা কর্মসূচি। কিন্তু সেগুলোর একটিও সাফল্যের মুখ দেখেনি। এর প্রধান কারণ দলের অভ্যন্তরে একনায়কতন্ত্রের চর্চা। বিএনপিতে এখন একনায়কতন্ত্র চলছে- এমন অভিযোগ দলটির একাংশের নেতাকর্মীর। তারা শীর্ষ নেতৃত্বের অনেক সিদ্ধান্তে একমত হতে না পারলেও দল থেকে বহিস্কৃত হওয়ার আশঙ্কায় মুখ বুজে তা মেনে নিচ্ছেন। কারণ দ্বিমত প্রকাশ করলেই নেমে আসছে অব্যাহতি কিংবা বহিস্কারের চিঠি। কেউ কেউ বলেন, দলটির ‘লন্ডন ব্যুরো’ থেকে যেসব নির্দেশনা আসে, মহাসচিব সেসব নির্দেশনার ওপর ‘রাবার স্ট্যাম্প’-এর কাজ করেন। দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্ত বলে যা বাজারজাত করা হয়, সেগুলো আসলে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের একক সিদ্ধান্ত। প্রচারিত আছে, স্থায়ী কমিটির বৈঠকে যারা উপস্থিত থাকেন, তারা কিছু বলেন না। শুধু ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বক্তব্য শুনে ‘হাত তুলে’ সমর্থন ব্যক্ত করেন।
বিএনপিতে কী ধরনের ‘একনায়কতন্ত্র’ চলছে, তার উদাহরণ সৃষ্টি গত ১৪ জুন দেশের চার মহানগরসহ কয়েকটি কমিটি ভেঙে দেয়া, একদিন পর দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটিতে বড় রদবদল করার কাণ্ডকে ঘিরে। কোনো ধরনের কাউন্সিল ছাড়াই দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে মোট ৩৯ নেতা নতুন পদ পেয়েছেন! এছাড়াও নতুন নামে সাবজেক্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। রদবদলে বিতর্কিতদের পুনর্বাসন করা হয়েছে। বিএনপির প্রভাবশালী কয়েকজন নেতা মনে করেন, তারেক রহমান আসলে দলের ওপর নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে কমিটি পুনর্গঠন করে নিজস্ব বলয় গড়ে তুলছেন। ভবিষ্যতে কেউ যাতে তার সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ না করে, সেজন্য তিনি এটা করছেন। তাদের দাবি, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বিএনপিতে একক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেছে। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে গঠন করা স্থায়ী কমিটিও পাত্তা পায়না। কমিটি নিয়ে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়নি। কী চমৎকার গণতন্ত্র জেঁকে বসেছে দলে! অথচ যে দলটির ভেতরে এমন নজিরবিহীন অগণতান্ত্রিক পরিবেশ বিদ্যমান, সেই দলের নেতারাই দেশে গণতন্ত্রের জন্য গলা ফাটায় এবং বিভিন্ন দূতাবাসে নালিশ দিয়ে বেড়ায়!
আমাদের প্রশ্ন হলো- যে দলের অভ্যন্তরেই গণতন্ত্রের চর্চার ছিটেফোঁটা নেই, যে দল একনায়কতন্ত্রের পূজা করে, সেই দল দেশে গণতন্ত্র কীভাবে প্রতিষ্ঠা করবে? তারা দেশের গণতন্ত্র নিয়ে কথা বলার ন্যূনতম অধিকার রাখে কী? বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশে একটি স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক অবস্থা বিরাজ করছে এবং তাঁর দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরেও গণতন্ত্রের যথাযথ অনুশীলন বিদ্যমান। এমতাবস্থায় দেশে বিদ্যমান গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন তোলার পূর্বে বিএনপিকে নিজেদের মধ্যে গণতন্ত্র চর্চা নিশ্চিত করতে হবে। কেননা, নিজ দলের অভ্যন্তরে একনায়কতন্ত্রকে পোষে, দেশব্যাপী গণতন্ত্রের দাবিতে আন্দোলন কিংবা অন্যদের গণতন্ত্রের শিক্ষা দেওয়া বড্ড বেশি বেমানান। বিএনপি একনায়কতন্ত্রের করাল গ্রাস থেকে বেরিয়ে আসতে পারলেই সুন্দর ভবিষ্যতের সন্ধান পাবে।
লেখক : সাবেক ছাত্রনেতা