২০০০ খ্রিষ্টাব্দে (১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দের পর) প্রথম ডেঙ্গু আউটব্রেক এবং প্রাণহানির (মৃত-৯৩, রোগী-৫ হাজার ৫৫১) পর যে বছরটি মানুষকে ভীষণ কষ্ট দিয়েছে এবং সর্বোচ্চ প্রাণ কেড়ে নিয়েছে, সেটি হলো ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দ। গত ২৩ বছরে দেশে ডেঙ্গুতে মারা গেছে ৮৬৮ জন কিন্তু ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে এ সংখ্যা ১৬৯৭ জন, আর রোগীর সংখ্যা ছিল ৩ লাখেরও বেশি, অর্থাৎ বিগত ২৩ বছরের চেয়ে এ সংখ্যা দ্বিগুণ। এত এত প্রাণের বিসর্জন হয়েছে শুধু ক্ষুদ্র একটা ভাইরাসের কারণে।
এই ভাইরাসটি (চারটি সেরেটাইপ—ডেন-ওয়ান, ডেন-টু, ডেন-থ্রি, ডেন-ফোর) স্ত্রী এডিস মশার শরীরে বসবাস করে এবং ডেঙ্গু জ্বর ছড়ানোর জন্য মশার শরীরে নিজেকে প্রস্তুত করে। যদি কেউ এই চারটি সেরোটাইপের মধ্যে প্রথম বার যে কোনো একটা সেরোটাইপ দিয়ে আক্রান্ত হয়, তবে দ্বিতীয় বার সে যখন অন্য আরেকটি সেরোটাইপ দিয়ে আক্রান্ত হয়, তখন অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন হয়। সাধারণত ঢাকা সব সময়ই ডেঙ্গু ঝুঁকিতে থাকলেও এখন গ্রামাঞ্চলেও সমানভাবে ছড়িয়ে পড়ছে ডেঙ্গু এবং ‘সেমি আরবান কন্ডিশন’-এ এটি বেশি বিরাজ করছে। আফ্রিকা মহাদেশ থেকে এডিস এজিপ্টাই এবং এশিয়া থেকে এডিস অ্যালবোপিকটাস মশার আগমন ঘটেছে এ দেশে। সব স্ত্রী এডিস মশা কিন্তু ডেঙ্গু জ্বর ছড়ায় না।
যেসব স্ত্রী এডিস মশা ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীকে কামড়িয়েছে শুধু সেসব ভাইরাসবাহী স্ত্রী এডিস মশা ডেঙ্গু রোগ ছড়ানোর উপযোগী। একটি পরিবার বা নিকটস্থ আবাসস্থলে ডেঙ্গু রোগ ছড়ানোর জন্য ভাইরাসবাহী একটি স্ত্রী মশাই যথেষ্ট। ডেঙ্গু ভাইরাস মানুষ থেকে মশা, মশা থেকে মানুষে সংক্রমণ চক্রের মাধ্যমে ছড়ায়। সাধারণত ভাইরাস সংক্রমিত স্ত্রী এডিস মশা দ্বারা কামড়ানোর চার দিন পরে একজন ব্যক্তির ডেঙ্গু রোগের উপসর্গ প্রকাশ পায় । তাই এডিস মশা যাতে বংশবিস্তার তথা ডিম পাড়তে না পারে, তার জন্য সবাইকে আরও সচেতন হতে হবে।
এবারের প্রকৃতির আচরণ অন্যান্য সময়ের চেয়ে বেশ ভিন্ন। অত্যধিক তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা, কম বৃষ্টিপাত—সব মিলিয়ে অসহনীয় এবারের আবহাওয়া। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে থেমে থেমে বৃষ্টিপাত। তাই আশপাশে খোলা জায়গায় বা যে কোনো খালি পাত্র/গাছের কোটরে বৃষ্টির পানি জমার সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। ঘরের ভেতরে বা বাইরে অথবা অন্য কোনো খোলা জায়গায় যদি কোনো পাত্রে বা অন্য কোনোভাবে পানি জমার সুযোগ তৈরি হয়, সেখানে মশা ডিম পাড়বে এবং সাত থেকে ১০ দিনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ এডিস মশার জন্ম হবে। মশার ডিমগুলো কালো রঙের দেখতে এবং এককভাবে আর্দ্রপৃষ্ঠে জলরেখার কাছাকাছি (close to the waterline) পাত্রের গায়ে ডিম পাড়ে। ডিম পাড়ার জায়গাটা পরবর্তী সময়ে পানিতে নিমজ্জিত হলে ডিম ফুটে লার্ভা বের হয়ে আসে।
সব ডিম একবারে না-ও ফুটতে পারে এবং ডিমগুলো দীর্ঘ সময় ধরে ডেসিকেশন (শুকনো) সহ্য করতে পারে এবং কয়েক মাস ধরে এর কার্যকারিতা (সজীবতা) বজায় থাকে; এমনকি ঠাণ্ডায়ও বেঁচে থাকতে পারে। একটি স্ত্রী এডিস মশা এক জীবনে অন্তত তিন বার ডিম পাড়ে, যাতে সব মিলিয়ে প্রায় ১০০টি ডিম হতে পারে। একটি পূর্ণাঙ্গ স্ত্রী এডিস মশা প্রায় তিন সপ্তাহ পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। এডিস মশার লার্ভা চারটি ইনস্টারের (পর্যায়) মাধ্যমে পরিপক্ব হয়, যা পরবর্তী কালে পিউপার মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ মশায় পরিণত হয়। নতুন জন্ম নেওয়া পূর্ণাঙ্গ মশাটি দুই দিনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ পুরুষ এডিস মশার সঙ্গে ম্যাটিং করে এবং স্ত্রী মশা মানুষের রক্ত পানের জন্য উদ্গ্রীব হয়ে ওঠে। পরবর্তী প্রজন্ম রেখে যাওয়ার জন্য স্ত্রী এডিস মশা মানুষের রক্ত (প্রোটিন জাতীয় খাবার গ্রহণ করার জন্য) পান করে।
বৈরী আবহাওয়া, এডিস মশার গত বছরের ডিমের পর্যাপ্ততা (ডেসিকেশন থাকা ডিম), থেমে থেমে বৃষ্টিপাত, অতি আর্দ্রতা, এবং নাগরিক জীবন যাপনে পরিবর্তনসহ সবকিছু মিলিয়ে এবারও ডেঙ্গু রোগ আমাদের ভোগাবে। তাই ব্যক্তি উদ্যোগে বাসাবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস আদালতের আশপাশের পরিবেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখাসহ পানিপূর্ণ পাত্রের দিকে নিবিড় পর্যবেক্ষণ রাখাসহ এসব পাত্র ধ্বংস করার উদ্যোগ গ্রহণ প্রয়োজন। তাই নিম্নোক্ত বিষয়ে দৃষ্টি দেওয়া একান্ত জরুরি—
* এডিস এজিপ্টাই একটি গৃহপালিত মশা; একটি ভাইরাস সংক্রমিত মশা যথেষ্ট একটি পরিবারে ডেঙ্গু রোগ ছড়ানোর জন্য। তাই সবাই যার যার অবস্থান থেকে এ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিসহ মশা দমনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া দরকার;
* স্ত্রী এডিস মশা সাধারণত দিনের বেলায় মানুষকে কামড়ায়। তাই দিনের বেলা ঘুমানোর সময়/এক জায়গায় দীর্ঘক্ষণ বসে কাজ করার সময়/শিক্ষার্থীদের প্রতিষ্ঠান প্রাঙ্গণে থাকার সময় শরীরের উন্মুক্ত অংশের জন্য বিশেষ প্রটেকশন গ্রহণ করা দরকার;
* গাছের কোটরসহ পানি জমার পাত্র (মাটির হাঁড়ি, প্লাস্টিকের কৌটো, দইয়ের কৌটো, পরিত্যক্ত টায়ার, বোতল, চিপসের প্যাকেট/যে কোনো ধরনের পলিথিন বা পাত্র যেখানে সহজে পানি জমতে পারে, ড্রাম, চৌবাচ্চা ইত্যাদি) সময় সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও এডিসমুক্ত আবাসস্থল বা পরিবেশ গড়ার জন্য কঠোর নজরদারি;
* সিটি করপোরেশনের কীটতত্ত্ববিদসহ দক্ষ ও অভিজ্ঞ লোকবলের সমন্বয়ে যুগোপযোগী, গবেষণাভিত্তিক আলাদা মশা নিয়ন্ত্রণ সেল/ইউনিট প্রতিষ্ঠা করে সফল মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণা করার উদ্যোগ গ্রহণ এবং রিকমেন্ডেশন অনুযায়ী মাঠ পর্যায়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ;
* আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের খুদে শিক্ষার্থীদের মধ্যে মশার জীবন চক্র, বংশবৃদ্ধির স্থানসমূহ এবং সার্বিক বিষয়ে ধারণা প্রদানের উদ্যোগ নেওয়া; এবং
* কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে গ্রামীণ পর্যায়ে ডেঙ্গু রোগের চিকিত্সাসেবার পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে মশা নিয়ন্ত্রণ সেলের মাধ্যমে সার্ভিলেন্সসহ মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের (অপারেশন) ব্যবস্থা গ্রহণ।
বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের এই ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তারের এ সময়ে এডিস মশার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সেজন্য এখনই ডেঙ্গু জ্বরের বাহক মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা সময়ের দাবি। পূর্ণবয়স্ক মশা নিধনের জন্য অ্যাডাল্টটিসাইডিং (কার্যকর মাত্রা নিশ্চিতপূর্বক) এবং লার্ভা দমনের জন্য লার্ভিসাইডিংয়ের পাশাপাশি ঢাকা সিটি করপোরেশন কর্তৃক ২০০১-২০০২ খ্রিষ্টাব্দে গৃহীত পদক্ষেপগুলোকে (বাড়ি বাড়ি গিয়ে এডিস মশা কালেকশনসহ মশা সম্পর্কে সম্যক ধারণা প্রদান, ওয়ার্ডভিত্তিক মশার প্রজাতি ও ঘনত্ব নির্ণয়করণ, রুটিন করে সকাল-বিকাল কীটনাশক ছিটানো ইত্যাদি) প্রাধান্য দিয়ে সমন্বিত মশা দমন পদ্ধতি অনুসরণপূর্বক বাসাবাড়িসহ সব ধরনের স্থাপনা নিবিড় পর্যবেক্ষণে এনে লার্ভা এবং পূর্ণাঙ্গ মশা দমনের জন্য জরুরি ভিত্তিতে সার্ভিলেন্স কর্মসূচির পাশাপাশি মশা নিয়ন্ত্রণে প্রিভেনটিভ মেজারসহ সঠিক মাত্রায় কার্যকর ঔষুধ ছিটানো এবং ব্যক্তি পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধির মতো নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার।
লেখক : কীটতত্ত্ববিদ