গণমাধ্যমের সমালোচনা করে পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের দেওয়া বিবৃতির প্রতিবাদ জানিয়েছেন বিভিন্ন শ্রেণিপেশার বিশিষ্টজন। তারা বলেছেন, দুর্নীতির জন্য অভিযুক্তদের পক্ষে বিবৃতি দিয়ে পুলিশ বাহিনীকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদনের বিষয়ে আপত্তি থাকলে আইনি প্রক্রিয়ায় সুরক্ষা চাওয়ার অধিকার রয়েছে। সেই পথে না গিয়ে অ্যাসোসিয়েশনকে ব্যবহার করে দুর্নীতিকে সুরক্ষা দেওয়ার চেষ্টা চালানো হয়েছে। এটি গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পরিপন্থি এবং স্বাধীন সাংবাদিকতার প্রতি হুমকি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের নীতিগত অবস্থানের সঙ্গেও তা সাংঘর্ষিক।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ, সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়াসহ তাদের পরিবারের বিপুল সম্পদ নিয়ে সম্প্রতি গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়। গত বৃহস্পতিবার (২০ জুন) পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভায় এ নিয়ে আলোচনা হয়। পরদিন (শুক্রবার) এক বিবৃতিতে অ্যাসোসিয়েশন দাবি করে, স্বাধীনতা ও দেশবিরোধী চক্র এবং সরকারবিরোধী মহলের মদদপুষ্ট গণমাধ্যম যাচাই-বাছাই ছাড়াই খবর প্রকাশ করছে। অন্য গণমাধ্যমগুলো অতি উৎসাহী হয়ে তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করছে। পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার উদ্দেশ্যেই এসব করা হচ্ছে।
এদিকে এ বিবৃতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে পাল্টা বিবৃতি দিয়েছে সাংবাদিকদের সংগঠন বিএফইউজে–বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে)। বিএফইউজের সভাপতি ওমর ফারুক, মহাসচিব দীপ আজাদ, ডিইউজের সভাপতি সোহেল হায়দার চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক আকতার হোসেন বলেন, ‘প্রতিবেদন প্রকাশের পর কোনো কোনো নেতা এবং কোনো কোনো সংগঠন যে ভাষায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন তা স্বাধীন সাংবাদিকতার প্রতি হুমকি। কেউ সংক্ষুব্ধ হলে প্রেস কাউন্সিলে যেতে পারেন। কোনো কর্মকর্তা দুর্নীতি করে থাকলে এটি তাঁর ব্যক্তিগত বিষয়, কোনো বাহিনীর বিষয় নয়।’ সাংবাদিক সংগঠনগুলোর পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের বিবৃতি নিয়ে তীব্র সমালোচনা হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রীর সাবেক তথ্য উপদেষ্টা ও দ্য ডেইলি অবজারভার সম্পাদক ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, ‘পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি ও স্বার্থরক্ষার জন্য বিবৃতি দিয়েছে। এটা তারা দিতেই পারে। কিন্তু ঢালাওভাবে গণমাধ্যমকে প্রশ্নবিদ্ধ করা সমীচীন হয়নি। কারণ, গণমাধ্যম সংবাদ তৈরি করে না। ঘটনা ঘটলে অর্থাৎ দুর্নীতি হয়েছে বলেই গণমাধ্যম প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। গণমাধ্যমে খেয়াল রাখতে হবে ব্যক্তির দুর্নীতি প্রকাশের ক্ষেত্রে সার্বিকভাবে যেন পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন না হয়। পুলিশ বাহিনীরও উচিত হবে তাদের সদস্যরা যেন দুর্নীতিতে জড়িয়ে না যায়–সেদিকে সতর্ক থাকা।’
সাবেক প্রধান তথ্য কমিশনার ও আজকের পত্রিকার সম্পাদক গোলাম রহমান বলেন, দুর্নীতির খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ হওয়ায় পুলিশের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এজন্য তারা নিজেদের রক্ষার আশ্রয় হিসেবে বিবৃতি দিয়েছে, এটি একটি কৌশল। কিন্তু বিবৃতিতে গণমাধ্যমকে যেভাবে দোষারোপ করা হয়েছে সেটি অবিবেচনাপ্রসূত। গণমাধ্যম ও পুলিশের মুখোমুখি অবস্থান কখনও কাম্য নয়। গণমাধ্যমকে প্রতিপক্ষ না ভেবে বরং পুলিশ বাহিনী তার সদস্যদের দুর্নীতি রোধে সচেষ্ট হবে–এটাই প্রত্যাশা।
পুলিশের সাবেক দুই কর্মকর্তার দুর্নীতি নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদন ‘সাহসী সাংবাদিকতার নজির’ মন্তব্য করে বিএফইউজের সাবেক সভাপতি বিশিষ্ট সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন তাদের সাবেক দুই কর্মকর্তার দায় কেন নিতে চায়–এটা বোধগম্য নয়। গণমাধ্যম তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতেই প্রতিবেদন ছেপেছে। প্রতিবেদনের তথ্য নিয়ে অভিযোগ থাকলে সংশ্লিষ্টরা প্রেস কাউন্সিলে যেতে পারেন। সরকারও তদন্ত করে দেখতে পারে। কিন্তু বিবৃতির পাশাপাশি মন্ত্রীরা যেভাবে বক্তব্য দিচ্ছেন তাতে সাহসী সাংবাদিকতা বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এটি কারও কাম্য নয়।
বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহ্দীন মালিক সমকালকে বলেন, বিবৃতিটা স্পষ্টতই পুলিশের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতির খবর না প্রকাশ করার জন্য সরাসরি চাপ সৃষ্টির নামান্তর। ক্ষয়িষ্ণু ও সীমিত বাকস্বাধীনতার দেশে এটা মোটেই অপ্রত্যাশিত নয়। বিবৃতির পরিবর্তে পুলিশের বরং বলা উচিত ছিল দুর্নীতির যে খবর গণমাধ্যমে এসেছে সেগুলোর ব্যাপারে বাহিনীর সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতনরা অনুসন্ধান করবেন। দুদক সহায়তা চাইলে তারা তাতে সহায়তা দেবেন।
জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ও সংসদ সদস্য ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতির ব্যাপারে জিরো টলারেন্স। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেও দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে। গণমাধ্যমের কাজই হলো অনিয়ম-দুর্নীতি তুলে ধরা। গণমাধ্যম দায়িত্বশীলতার সঙ্গে সেই কাজগুলো করছে। পুলিশ প্রশাসনসহ পেশাজীবীরা গণমাধ্যমের প্রতিপক্ষ নয়। তাই ব্যক্তি বিশেষের দুর্নীতির কারণে পুলিশ বাহিনী প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, এটি ভাবার কোনো কারণ নেই।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, ‘পুলিশের বিবৃতির মাধ্যমে সাংবাদিকতাকে সংকুচিত করার চেষ্টা চলছে। এভাবে চলতে থাকলে মতপ্রকাশের বৈশ্বিক স্বাধীনতায় বাংলাদেশ আরও পিছিয়ে যাবে।’