বাংলাদেশের অভ্যন্তরে তিস্তার পানিপ্রবাহ বাড়ানো, নদীটির সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় ভারত সাহায্যের হাত বাড়াতে চায়। গতকাল শনিবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে এ বিষয়ে এই প্রথম আনুষ্ঠানিক আলোচনা হয়। ভারত এ ক্ষেত্রে যথাযথ সহযোগিতা দিতে আগ্রহী।
বাংলাদেশও স্বাগত জানিয়েছে। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রী মোদি নিজেই তাঁর ভাষণে এ প্রসঙ্গে বলেন, এ নিয়ে আলোচনার জন্য শিগগিরই একটি কারিগরি দল বাংলাদেশে যাবে।
দুই দেশের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিনয় কোয়াত্রা সংবাদ সম্মেলনে জানান, ইতিমধ্যে ওই বিশেষজ্ঞ দল গঠিত হয়েছে। তিনি বলেন, তিস্তা নিয়ে এ উদ্যোগ দুই দেশের মধ্যে প্রবাহিত অভিন্ন নদীগুলোর পানিবণ্টন ও ব্যবস্থাপনারই অংশ।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে এ প্রসঙ্গে প্রশ্নের উত্তরে বলেন, তিস্তা নিয়ে অন্যান্য দেশের মতো ভারতও আগ্রহ দেখিয়েছে। তারা প্রস্তাব দিয়েছে। টেকনিক্যাল (কারিগরি) দল পাঠানোর কথা বলেছে। এটা খুবই ইতিবাচক। দুই দেশের টেকনিক্যাল কমিটি বসে এ বিষয়কে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে তিস্তাজনিত সমস্যার সমাধান নিয়ে চীন আগেই আগ্রহ জানিয়েছিল। ২০২০ সালে তারা ১০০ কোটি ডলারের এক প্রকল্প বাংলাদেশ সরকারকে দেয়। বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত তিস্তা অববাহিকা পরিদর্শনও করেছিলেন। তবে ভারতের আপত্তির কথা বিবেচনায় বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত সেই প্রস্তাব গ্রহণ বা বর্জন কোনোটাই করেনি। ধীরে চলো নীতি নিয়েছে।
এ পরিস্থিতিতে ভারতের নতুন প্রস্তাব গুরুত্বপূর্ণ। আরও লক্ষণীয়, আনুষ্ঠানিকভাবে তা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে কথাবার্তা হলো শেখ হাসিনার প্রস্তাবিত চীন সফরের ঠিক আগে। আগামী মাসে শেখ হাসিনার চীন সফরে যাওয়ার কথা।
গতকাল হায়দরাবাদ হাউসে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে মোট ১০টি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা হয়। তিস্তার সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা ছাড়া ওই ঘোষণাগুলোর মধ্যে রয়েছে ই-মেডিকেল ভিসার প্রবর্তন। বাংলাদেশ থেকে মানুষ যাতে সহজে চিকিৎসার প্রয়োজনে ভারতে যেতে পারেন, সে জন্য দেশটি ই-মেডিকেল ভিসা চালু করবে।
বাংলাদেশের রংপুরে ভারত একটি নতুন সহকারী হাইকমিশনারের দপ্তরও খুলবে বলে জানিয়েছে। রাজশাহী ও কলকাতার মধ্যে নতুন এক যাত্রীবাহী ট্রেন চালানো হবে। কলকাতা ও চট্টগ্রামের মধ্যে চালানো হবে নতুন এক বাস পরিষেবা। গেদে-দর্শনা ও হলদিবাড়ী-চিলাহাটির দলগাঁও পর্যন্ত মালগাড়ি চালানো হবে। ভারতের সহায়তায় সিরাজগঞ্জে অভ্যন্তরীণ কনটেইনার ডিপো তৈরি করা হবে।
ভারতীয় গ্রিডের সাহায্যে নেপাল থেকে বাংলাদেশের মধ্যে ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ রপ্তানি শুরু করা হবে। বাংলাদেশের ৩৫০ পুলিশ কর্মকর্তার জন্য প্রশিক্ষণশিবির এবং গঙ্গার পানি চুক্তি নবায়নের লক্ষ্যে যৌথ কারিগরি কমিটি আলোচনা শুরু করবে।
এ ছাড়া দুই দেশের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা বিস্তারে ১০টি সমঝোতা স্মারক সই হয়। এগুলোর মধ্যে ৭টি নতুন। বাকি ৩টি নবায়ন করা হয়েছে। নতুন সমঝোতা স্মারকগুলোর মধ্যে রয়েছে ডিজিটাল অংশীদারত্ব ও টেকসই ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে সবুজ অংশীদারত্ব। এ ছাড়া রয়েছে সমুদ্র সহযোগিতার অন্তর্গত সুনীল অর্থনীতি বা ‘ব্লু ইকোনমি’। দুই দেশের রেল সংযোগের জন্যও এক সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে।
দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দুজনেই তাঁদের ভাষণে দুই দেশই সম্পর্ককে ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আরও দৃঢ় করে তুলতে আগ্রহী বলে জানিয়েছেন। ‘শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের’ লক্ষ্যেই দুই দেশ ‘ভিশন স্টেটমেন্ট’ বা রূপকল্প ঘোষণা গ্রহণ করেছে। এ ঘোষণা দুই দেশের বহুমুখী সহযোগিতার ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন রাখবে, যা ২০৪৭ সালের মধ্যে বিকশিত ভারত গড়ে তুলতে সাহায্য করবে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ে তুলবে। ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণের লক্ষ্যেই গড়ে তোলা হয়েছে বাংলাদেশের ‘ভিশন ২০৪১’ ও ভারতের ‘বিকশিত ভারত ২০৪৭’ ডকুমেন্ট।
প্রধানমন্ত্রী মোদি তাঁর ভাষণে জানান, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা আরও বাড়ানোর লক্ষ্যেও তাঁরা আলোচনা করেছেন। সেই আলোচনায় প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম উৎপাদনের বিষয় যেমন ছিল, তেমনই ছিল সেনাবাহিনীর আধুনিকীকরণ। বৈঠকে দৃঢ়ভাবে সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ রুখতে যেমন আলোচনা হয়েছে, তেমনই ঠিক হয়েছে দুই দেশের সীমান্ত যথাসম্ভব শান্ত রাখা।
সীমান্ত হত্যা বাংলাদেশের কাছে সবসময় খুব স্পর্শকাতর এক বিষয়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বৈঠক শেষে সংবাদমাধ্যমকে বলেন, এ বিষয়ে দুই দেশই যথাসম্ভব সংযত থাকার ওপর জোর দিয়েছে। তিনি জানান, বাংলাদেশ বিকাশমান অর্থনীতির দেশগুলোর জোট ব্রিকসের সদস্য হওয়ার জন্য ভারতের কাছে সমর্থন চেয়েছে।
হাছান মাহমুদ বলেন, ভারত পেঁয়াজ, তেল, গম ও চিনির মতো প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের জন্য কোটা চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ একটি নির্দিষ্ট কোটা চেয়েছে; যাতে ভারত বাংলাদেশে প্রয়োজনীয় জিনিস রপ্তানি বন্ধ না করে।
ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিনয় কোয়াত্রা সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ভারত এ বিষয়ে (সীমান্ত হত্যা) সবসময় খুবই সচেতন থাকে। সীমান্ত হত্যা কখনো কাম্য নয়। সতর্কতারও শেষ নেই। তবু কখনো কখনো এমন পরিস্থিতি হয়, বিএসএফ এমনভাবে আক্রান্ত হয় যে গুলি না চালিয়ে উপায় থাকে না।
তিস্তা প্রসঙ্গে বিনয় কোয়াত্রা বলেন, অভিন্ন নদী তিস্তায় প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য কারিগরি দল গঠন করা হয়েছে। এখানে অভিন্ন নদীর পানি ব্যবস্থাপনা ও আন্তনদীর ক্ষেত্রে প্রতিবেশীর সংবেদনশীলতা বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।
ভারতের পররাষ্ট্রসচিব জানান, রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। রোহিঙ্গা সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো মিয়ানমারের কাছে কীভাবে তুলে ধরা হবে, সে প্রসঙ্গও আলোচনায় এসেছে।
সম্প্রতি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে খুন হওয়া বাংলাদেশের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারের প্রসঙ্গে বিনয় কোয়াত্রা জানান, দুই দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এই হত্যার তদন্তে যুক্ত আছে। নিয়মিতভাবে দুই পক্ষের মধ্যে প্রয়োজনীয় তথ্যের আদান–প্রদান হচ্ছে। বাংলাদেশকে প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহায়তা করছে ভারত।
বাংলাদেশে ভারতবিরোধী প্রচারণা বিষয়ে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বলেন, স্বার্থান্বেষী ব্যক্তিদের মাধ্যমে পরিচালিত এ ধরনের প্রচারণা যে বাস্তবসম্মত নয়, তা অনুধাবন করা জনগণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এটি মূলত কিছু মানুষের কাল্পনিক ধারণার বহিঃপ্রকাশ। দুই দেশের জনগণ ও সমাজের মধ্যে গভীর, ঐতিহাসিক, ইতিবাচক সংযোগই যে সম্পর্কের সঠিক বাস্তবতা, তা যেন জনগণ জানতে পারে, সেটি নিশ্চিত করার জন্য ভারত চেষ্টা চালিয়ে যাবে।
দুই দেশের সম্পর্ক দিন দিন কত গভীর হচ্ছে, দ্বিপক্ষীয় সফরসূচি তার প্রমাণ। গতকাল সকালেই ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়াল ‘এক্স’ হ্যান্ডল মারফত জানিয়ে দেন, ২০১৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পরস্পরের সঙ্গে মোট ১০ বার সাক্ষাৎ ও বৈঠক করেছেন।
তিনি বলেন, সম্পর্কের রূপান্তর কত অভূতপূর্ব, এটা তারই প্রমাণ। শেখ হাসিনাও তাঁর ভাষণে বলেন, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি দ্বিপক্ষীয় সফরে ভারতে এসেছিলেন। তারপর আসেন ২০২৩ সালে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে। দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র আমন্ত্রিত অতিথি দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন তিনি। চলতি বছরে এই জুন মাসে এটা তাঁর দ্বিতীয়বারের জন্য ভারতে আসা।
প্রথমবার এসেছিলেন ৯ জুন, প্রধানমন্ত্রী মোদির তৃতীয়বারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে। এক পক্ষকালের মধ্যেই আবার সফর। এবার দ্বিপক্ষীয়। তিনি বলেন, দুই দেশ কতটা ঘনিষ্ঠভাবে একে অন্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে, এটা তারই পরিচায়ক।
শেখ হাসিনা এই বছরের জানুয়ারি মাসে টানা চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। মোদিও তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন এ মাসে। এবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর এটাই শেখ হাসিনার প্রথম দ্বিপক্ষীয় রাষ্ট্রীয় সফর। মোদিও তাঁর তৃতীয় দফার শাসনামলের প্রথম বিদেশি নেতা হিসেবে শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানালেন।
তাঁর ভাষণে মোদি বলেন, ‘বিশেষত্ব এটাই যে শেখ হাসিনাই আমার এই তৃতীয় দফায় প্রথম আমন্ত্রিত রাষ্ট্রীয় অতিথি।’
গত শুক্রবার বিকেলে শেখ হাসিনা দিল্লি যান। সেদিনই পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। গতকাল সকালে রাষ্ট্রপতি ভবনে প্রধানমন্ত্রী মোদি আনুষ্ঠানিকভাবে শেখ হাসিনাকে অভ্যর্থনা জানান। শেখ হাসিনা গার্ড অব অনার গ্রহণ করেন। তারপর তিনি চলে যান রাজঘাটে জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর সমাধিতে শ্রদ্ধা জানাতে।
এরপর হায়দরাবাদ হাউসে বসে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা। তিন দফার ওই বৈঠকে বেশ কিছু সময় দুই প্রধানমন্ত্রী একান্তে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেন বলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ জানিয়েছেন।
দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথমে দেখা করেন উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড়ের সঙ্গে। তারপর তিনি দেখা করেন রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর সঙ্গে। গতকাল রাতে দেশে ফেরেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।