জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে অত্যন্ত সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও জো বাইডেন বৃহস্পতিবার আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন উপলক্ষ্যে জনসম্মুখে বিতর্কে অংশগ্রহণ করছেন। জনপ্রিয়তার পাশাপাশি তাদের কিছু দুর্বলতাও রয়েছে, যেগুলো তেমন একটা আলোচনায় আসছে না। বাইডেনের দুর্বলতার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—তার ওপর আরোপিত দুর্নীতির অভিযোগ ও মুদ্রাস্ফীতির রেকর্ড। অন্যদিকে ট্রাম্পের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় দাগ হলো, ২০২১ সালে তার সমর্থক দ্বারা ক্যাপিটল হিল আক্রমণ।
বাইডেনকে যদি মুদ্রাস্ফীতি সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়, তাহলে হয়তো তিনি আমেরিকার জনপ্রিয় টেলিভিশন সিরিজ ‘দ্য সিম্পসন’-এর চরিত্র গ্র্যান্ডপা সিম্পসনের মতো হতভম্ব হয়ে যাবেন। তিনি যদি মুদ্রাস্ফীতি সম্পর্কে গ্রহণযোগ্য যুক্তি প্রদান না করতে পারেন, তাহলে তার পুরো প্রচারণা বিফলে চলে যেতে পারে। অন্যদিকে ট্রাম্পকে যদি ক্যাপিটল হিল সম্পর্কে জিগ্যেস করা হয়, তাহলে তিনি কর্নেল জেসেপের মতো খেপে যেতে পারেন। আবার এমনও হতে পারে, তিনি ক্যাপিটল হিলের দায় স্বীকার করে নিচ্ছেন।
বিতর্কে কী ঘটবে, তা এই মুহূর্তে নিশ্চিত বলা সম্ভব নয়। কিন্তু দুই জনের ভাগ্য নির্ধারণের আগে তাদের একটি গৌণ দুর্বলতা দেখে নেওয়া যাক, যা শেষ মুহূর্তে ভোটারদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বাইডেনের জন্য সেই দুর্বলতা হলো পররাষ্ট্রনীতি, অর্থাত্ তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর বিশ্বব্যবস্থার অবনতি। আর ট্রাম্পের ক্ষেত্রে কোভিড-পূর্ববর্তী সময়ে আমেরিকার অর্থনৈতিক সংকট। যদিও এখানে ট্রাম্পের কিছু করার ছিল কি না, সে বিষয়ে পক্ষে-বিপক্ষে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। কিন্তু ট্রাম্প-যুগে বিশ্বের ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত ছিল। ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত এত তীব্র আকার ধারণ করেনি, ফিলিস্তিন-ইসরাইল সংঘাতও মারাত্মক যুদ্ধে রূপ নেয়নি, এমনকি মার্কিনবিরোধী শক্তি, যেমন :রাশিয়া, চীন, ইরান ও উত্তর কোরিয়ার জোট বর্তমান সময়ের তুলনায় ছিল বেশ দুর্বল। কোনো সন্দেহ নেই যে, বাইডেন প্রশাসন এই অবনতির দায় সরাসরি অস্বীকার করবে এবং যুক্তি দেবে যে, একনায়কতন্ত্রের প্রতি সহানুভূতিশীল ট্রাম্পের চেয়ে অনেক কঠিন পরিস্থিতি বিচক্ষণতার সঙ্গে সামাল দিয়েছেন বাইডেন। হয়তো এ কথাও উল্লেখ করবেন যে, বিপর্যয়কর বাস্তবায়ন সত্ত্বেও তিনি আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার সমর্থন করেছেন এবং হোয়াইট হাউজের ন্যায্যতা রক্ষার পাশাপাশি ইউক্রেনে ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য যথাসম্ভব প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
তবে আমি মনে করি যে, বিচ্ছিন্নতাবাদের বিরুদ্ধে উদার আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার মহান রক্ষক হিসেবে বাইডেনের আত্মপ্রকাশ ডেমোক্রেটদের জন্য ট্রাম্পের অসম অর্থনৈতিক লেনদেনের নীতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া কঠিন করে তুলেছে। যদি বাইডেনের পররাষ্ট্রনীতির পক্ষে একটা ইতিবাচক যুক্তি দাঁড় করানো হয়, তাহলে এটা বলা যায় যে, তিনি ট্রাম্পের মতো ন্যাটোকে দুর্বল করার জন্য উঠেপড়ে লাগেননি। যদিও বাইডেনের সময়ে এসেই মার্কিনবিরোধী শক্তিগুলো আগের চেয়ে বেশি আগ্রাসী হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে ট্রাম্পের গৌণ দুর্বলতা তার আগের কর্মকাণ্ড নয়, বরং তার আগের প্রতিশ্রুতি। বিশেষ করে, তার সম্ভাব্য দ্বিতীয় মেয়াদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক নীতি হিসেবে আমদানির ওপর ১০ ভাগ শুল্ক আরোপ করার প্রতিশ্রুতি।
২০১৬ সালে যখন তিনি প্রথম বার প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন, তখন ট্রাম্প অর্থনৈতিকভাবে উদারতার পথ অবলম্বন করেছিলেন। মিট রমনি ও পল রায়ানের কঠোরতা নীতি থেকে সরে এসে তিনি কিছুটা উদার নীতি গ্রহণ করেছিলেন।
ইরান ও চীনের মতো দেশের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধের খরচে সহযোগিতা করে ভারসাম্য রক্ষার জন্য এমন নীতি গ্রহণের প্রতিশ্রুতি তখন অবশ্য সম্ভব ছিল। এবারও ট্রাম্পের সমর্থকরা এমন নীতিই আশা করবে। কিন্তু পরিস্থিতি এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে, মুদ্রাস্ফীতি যদি নিয়ন্ত্রণে না আনা যায়, তাহলে কর কমানোর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করা অসম্ভব হয়ে যাবে। এছাড়া ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত এই মুহূর্তে মুদ্রাস্ফীতি দ্বারা জর্জরিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির ওপর কঠোর আঘাত হানতে পারে। আবার কিছু কিছু শ্রেণির জন্য এটা স্বস্তির সংবাদও হতে পারে। যারা শুল্কনীতি নির্ধারণ করেন, তারা এই ব্যাপারটাকে সমর্থন করবেন কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। এটা একটা জটিল বিষয়। আর জটিল যুক্তিতর্কের ক্ষেত্রে ট্রাম্পের বরাবরই দুর্বলতা রয়েছে। অর্থাত্, ট্রাম্পের শুল্কনীতির প্রতিশ্রুতি ২০০৮ সালের জন ম্যাককেইনের স্বাস্থ্য-বিমায় ট্যাক্স প্রত্যাহারের নীতির মতো মনে হতে পারে। অবশ্য পরবর্তীকালে বারাক ওবামা সেটাকে মধ্যবিত্তের ওপর কর বৃদ্ধি করে সফল হয়েছিলেন।
মধ্যবিত্তের জন্য উচ্চমূল্য এবং করপোরেট করের হার কমানো, বিশেষ করে যখন ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের করপোরেট ট্যাক্স কাট করার সিদ্ধান্ত হিতে বিপরীত হতে পারে। ডেমোক্রেট দ্বারা রিপাবলিকান পার্টির বিরুদ্ধে সবচেয়ে কার্যকর প্রচারণা হলো—রিপাবলিকান দল ধনীদের উপকার করার জন্য মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে চুরি করছে বলে প্রচার করা। বাইডেন কি তার যুক্তিগুলো এমনভাবে তুলে ধরতে পারবেন, যা তার ভোটারদের মুদ্রাস্ফীতির কথা সাময়িক সময়ের জন্য হলেও ভুলিয়ে দিতে পারবে? আমার তা মনে হয় না। আবার অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, ট্রাম্প তার নিজের কর্তৃত্ববাদী পরিচয় লুকিয়ে রেখে তার ভোটারদের এই কথা বিশ্বাস করাতে পারবেন কি না যে, বাইডেনের দুর্বল পররাষ্ট্রনীতির কারণে মার্কিনবিরোধী শক্তিগুলো আগের চেয়ে বেশি সংঘবদ্ধ হয়ে উঠেছে। এই দুইটি প্রশ্নের উত্তরের পাশাপাশি আরো বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর আগামী বৃহস্পতিবার ‘ট্রাম্প বনাম বাইডেন’ বিতর্কে পাওয়া যাবে বলে আশা করা যায়।
লেখক : দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের নিয়মিত কলামিস্ট
দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস থেকে অনুবাদ : আব্দুল্লাহ আল মামুন