ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশের ওপর চীন ও ভারতের প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতার বিষয়টি আবারও প্রকাশ্যে এসেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চতুর্থ মেয়াদের ক্ষমতারোহণের ছয় মাসের মধ্যে নতুন করে শুরু হওয়া এই প্রতিযোগিতা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম কোণ ছাড়িয়ে এবার উত্তরের তিস্তা নদীতে গিয়ে বাসা বেঁধেছে। আকাশ ও সড়কপথে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের দূরত্ব যথাক্রমে ১,৮৯৪.১৬ ও ৩,৪৩৯.১৭ কিলোমিটার। অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ৪,০৯৬ কিলোমিটার সীমান্ত সরাসরি যুক্ত রয়েছে। এই অর্থে চীন ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী, ভারত সীমান্তযুক্ত প্রতিবেশী।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত ও চীন ছিল যথাক্রমে বন্ধু সহায়তাকারী ও শত্রুসহায়তাকারী। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের ৫৩ বছর পর এসে বাংলাদেশকে নিয়ে এই দুটি দেশ রীতিমতো নিজেদের মধ্যেই নীরব লড়াই শুরু করেছে। এই লড়াইয়ে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলাসহ আরো অনেক জেলা-উপজেলার কয়েক কোটি মানুষের দুর্ভাগ্যলিপি শক্ত বাঁধনে বাঁধা পড়ে গেছে, বন্দি হয়ে গেছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, নিজের স্বার্থ হাসিলের লক্ষ্যে বাংলাদেশকে তিস্তা নদী পুনরুদ্ধার এবং ব্যবস্থাপনা প্রকল্পে অর্থায়ন ও আর্থিক এবং প্রযুক্তিগত সহায়তার জন্য চীনের প্রস্তাবের পর ভারতের অতি আগ্রহী হয়ে একই প্রকল্পের জন্য কারিগরি দল প্রেরণের সিদ্ধান্তে এলে তিস্তাপারের মানুষের দুর্ভাগ্য আরো প্রলম্বিত করা গেছে, জাতীয় অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্তের ধারা অব্যাহত রাখা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক কূটনীতি বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, গত দুই দশকের প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের প্রবণতা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধ ও শোষণে দরিদ্র হয়ে পড়া বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক স্তরে যে আভিজাত্যপূর্ণ অবস্থায় নিয়ে গিয়েছিলেন, তা থেকে বাংলাদেশের সীমাহীন অধঃপতন হয়েছে। বঙ্গবন্ধু তার প্রবল ব্যক্তিত্বের আঁচ দিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে করা প্রতিটি চুক্তিতে তিনি ন্যায্য হিস্যা আদায় করেছিলেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর থেকে গত সাড়ে চার দশকে বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বহুমাত্রিকতায় বাণিজ্য, বিনিয়োগ, শক্তি ও জ্বালানি, যোগাযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সংস্কৃতি খাত প্রাধান্য পেয়েছে, যার একটিতেও বাংলাদেশের স্বার্থের পাল্লা ভারী করা যায়নি। পারিপার্শ্বিক নানা ঝুঁকি থাকলেও শেখ হাসিনার আমলে করা ট্রানজিট চুক্তি বাস্তবায়ন শুরু হলে দেখা যায়, যে মাশুলে ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দেওয়া হয়েছে এবং তা থেকে বাংলাদেশ যে অর্থ পাচ্ছে; তার চেয়ে অনেক বেশি অর্থ উপার্জন করছে বাংলাদেশের তৃতীয় শ্রেণির একজন ঘুষখোর-দুর্নীতিবাজ ব্যক্তি। কলকাতা থেকে আগরতলায় পণ্য পৌঁছাতে ১ হাজার ৬৫০ কিলোমিটার দুর্গম পথ পাড়ি দিতে ভারতের সময় লাগত কমপক্ষে ৩৬ ঘণ্টা। বাংলাদেশের সঙ্গে ট্রান্সশিপমেন্ট চুক্তি করে ২০১৬ সালে প্রথম কলকাতা থেকে আসা পণ্য আশুগঞ্জ নৌবন্দরে খালাসের মাধ্যমে ঐ দূরত্ব দাঁড়ায় ৩৫০ কিলোমিটারে। তিন ভাগের এক ভাগ সময় ও খরচ কমে গেলেও বাংলাদেশকে বিনিময়ে ভারত দিচ্ছে প্রতিটনে ১৯২ টাকা করে।
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ৫৪টি আন্তঃসীমান্ত নদী রয়েছে। তিস্তা বাংলাদেশের চতুর্থ বৃহত্তম নদী। উপরন্তু উত্তরাঞ্চলীয় ৮-১০টি জেলার প্রাণভোমরা। ভারতের পার্বত্য রাজ্য সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাংশের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে নীলফামারী দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করা তিস্তা রংপুর বিভাগ জুড়ে নানা শাখা-প্রশাখা সৃষ্টি করে ব্রহ্মপুত্র নদে গিয়ে মিশেছে। ফলে বলা যায়, তিস্তা বাংলাদেশের অর্ধেক ভূখণ্ডের কৃষি খাতের জন্য মহাগুরুত্বপূর্ণ। এই নদীর ধারে ভারত যে বাঁধ নির্মাণ করেছে, তা উজানের সময় জলের প্রবাহকে চরমভাবে বাধাগ্রস্ত করে এবং বাংলাদেশের জলনিষ্কাশন-ব্যবস্থা ক্রমাগত বদলে দিচ্ছে। এতে প্রতি বছর অন্তত ১৫ লাখ হেক্টর জমির সেচ ব্যাহত হয়। ৪০ বছর আগেও নদীটি বাংলাদেশ অংশে বর্ষা মৌসুমে প্রস্থে ছিল দুই কিলোমিটার, শুষ্ক মৌসুমে এক কিলোমিটার। ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশের অপরিকল্পিতভাবে নদীরক্ষা বাঁধ এবং ব্যারাজ নির্মাণের ফলে নদীটি এখন কোথাও কোথাও চওড়ায় কয়েক কিলোমিটার বেড়ে সমস্ত গভীরতা হারিয়ে ফেলেছে।
বর্ষা মৌসুমে বন্যায় প্রতি বছর দুই পারে হাজার হাজার হেক্টর জমি নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে, যা নদীর তলদেশ ভরাট করছে; আবার উজান থেকে বিপুল বালু-পলি এসেও নদীর তলদেশ ক্রমেই স্ফীত করছে। যে কারণে এখন কোথাও কোথাও নদীটির তলদেশ সমতল ভূমির চেয়েও অনেক উঁচুতে। শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা নদীর কোথাও কোথাও হাঁটুপানিতে হেঁটে পার হওয়া যায়, কোথাও-বা আবার জুতা না ভিজিয়েই পার হওয়া যায়। পশ্চিমবঙ্গের গজলডোবায় তিস্তা ব্যারাজ নির্মাণের আগে বাংলাদেশ প্রতি সেকেন্ডে ৬ হাজার ৭১০ কিউসেক (কিউবিক ফুট) পানি পেত। বাঁধ দেওয়ার পর বাংলাদেশ চেয়েছিল ৫ হাজার কিউসেক, যা পরে আরো কমিয়ে আনা হয়।
১৯৮৩ সালে ২৫তম যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) সভায় এককালীন ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের তিস্তার ৩৬ শতাংশ জল পাওয়ার কথা ছিল। আন্তর্জাতিক নদীর হিস্যার আইনে এটাই রীতিসিদ্ধ। ২০১১ সালে আরেকটি চুক্তির কথা হয়েছিল, যার অধীনে বাংলাদেশ তিস্তার ৩৭.৫ শতাংশ জল এবং ভারত ৪২.৫ শতাংশ জল পাবে স্থির করা হয়। কিন্তু সামগ্রিকভাবে নদীর প্রবাহ কমার কথায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তির কারণে এই চুক্তি আর স্বাক্ষর করা হয়নি। সেই থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তিস্তা নিয়ে ভারতের অভ্যন্তরে কেন্দ্র-রাজ্যের রাজনীতির বিষবাষ্প ছড়িয়েছে। এমনকি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সর্বশেষ ভারত সফরের পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে বিশাল চিঠি দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০২৬ সালে গঙ্গা চুক্তি নবায়ন নিয়ে আগাম সতর্কবার্তাও পাঠিয়ে দিয়েছেন।
অথচ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সর্বসাম্প্রতিক সফরে ভারত-বাংলাদেশ যে সাতটি নতুন এবং তিনটি নবায়নসহ ১০টি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করেছে, তার অন্তত ৭০ শতাংশই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের অনুকূলে গেছে। ভারতের ঘোষিত ১৩টি বিবৃতির একটিতে তিস্তা প্রসঙ্গটি জায়গা পেয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরে তিস্তা নদী সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের জন্য বাংলাদেশে ভারতীয় কারিগরি প্রতিনিধিদল সফর করবে।’ এখানে উল্লেখ্য, ২০২২ সালে বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে একটি বহুমুখী ব্যারাজ নির্মাণ এবং তিস্তার কিছু অংশ ড্রেজিং ও বাঁধ নির্মাণের জন্য একটি একক ব্যবস্থাপনাযোগ্য চ্যানেল তৈরি করতে কাজ শুরু করে, যেখানে জলের স্তর অনেক বেশি হওয়া ছাড়াও আরো কিছু সুবিধা পাওয়া যাবে। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) অংশ হিসেবে তিস্তা চীনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ চীনের এই মহাপ্রকল্পের সদস্য। ভারতের দাবি, বাংলাদেশের পরিকল্পিত তিস্তার এই প্রকল্পটি চীনকে তার সীমান্তের ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে নিয়ে যাবে, উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের সঙ্গে ভারতের একমাত্র স্থলসংযোগ সংকীর্ণ শিলিগুড়ি করিডরের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করবে।
কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীন-ভারত যে-ই তিস্তা প্রকল্পে জড়িত হোক না কেন, উত্তরাঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের আশা, তিস্তা সংকটের একটি সুষ্ঠু সমাধান। কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না। এক্ষেত্রে তিস্তা নদী নিয়ে নিবিড় গবেষণা করা এশীয় প্রবৃদ্ধি গবেষণা ইনস্টিটিউট ও জাতিসংঘের সাবেক উন্নয়ন গবেষণাপ্রধান ও ভিজিটিং প্রফেসর ড. নজরুল ইসলামের বিশ্লেষণ বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, “‘পাওয়ার-চায়না’র তিস্তা প্রকল্প তিস্তা নদীর সমস্যাগুলোর কোনো স্থায়িত্বশীল সমাধান দেবে না। এরকম অবস্থায় চীনের এই প্রকল্প নিয়ে অগ্রসর হওয়ার বাংলাদেশের পক্ষে সমীচীন হবে না।” তার মতে, তিস্তা প্রতি বছর প্রায় ৫ কোটি টন পলি নিয়ে আসে, যা চীনের অর্থসহায়তায় খনন করা তিস্তার গভীরতা দ্রুতই ভরাট করে দেবে। ফলে নদীর পাড় ভাঙনের সমস্যা আরো তীব্র হবে। একই সঙ্গে এই প্রকল্পের মাধ্যমে তিস্তা নদীর বর্তমানের প্রায় দুই থেকে তিন কিলোমিটার প্রশস্ততা শূন্য দশমিক ৮১৬ মিটারে (অর্থাত্ ০.২৭২ বা প্রায় এক-চতুর্থাংশে) নামিয়ে আনার ফলে নদীটি বর্ষাকালের জলের আধিক্য আর উজান থেকে নেমে আসা বন্যার পানি ধারণ করতে পারবে না। ফলে বাংলাদেশের বিশাল অঞ্চল জুড়ে নতুন সংকট দেখা দেবে।
এই সবকিছু বিচার-বিশ্লেষণের পর বলা যায়, বৈশ্বিক ক্ষমতার ভরকেন্দ্রে দ্রুত পালাবদলের বর্তমান প্রেক্ষাপটকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের বর্তমান নীতিনির্ধারকদের বাঙালি জাতির স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দৃঢ়তা ও স্বদেশপ্রেমের কাছে ফিরে যাওয়াই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হবে। তাদের মতে, বিশ্ব যখন দ্রুত দু্ই মেরুতে ভাগ হয়ে যাচ্ছে, আধিপত্য প্রতিষ্ঠা ও টিকিয়ে রাখতে পারমাণবিক বোমা নিয়ে একে অন্যকে হামলা করার হুমকি দিচ্ছে, তখন ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে শত্রুতা নয়’ নীতি বুকে ধারণ করে দুই নৌকায় পা দিলে বাংলাদেশেরই সমূহ ক্ষতি হবে। নীতিনির্ধারকদের মনে রাখা উচিত, স্বাধীনতাযুদ্ধে বাংলাদেশকে অনেক উপকার করলেও তিস্তাসহ দ্বিপাক্ষিক-আন্তর্জাতিক নানা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে মতানৈক্য রয়েছে। বাংলাদেশেরও তাই এখন স্বদেশ-স্বার্থ সবার ঊর্ধ্বে তুলে ধরার চেষ্টা করার সময় এসেছে এবং সেই আলোকেই উত্তরাঞ্চলের ‘জীবনরেখা’ তিস্তাসহ অন্যসব আন্তর্জাতিক নদনদীর ভাগ্য উন্নয়নে মনোযোগী হতে হবে, আন্তঃরাষ্ট্রীয় দর্শন পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়; সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি