কয়েকদিন ধরে দেশব্যাপী কোটাবিরোধী আন্দোলন চলে আসছিল। সরকার বারবার বলে এসেছে, এটা আদালতের হাতে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ তা বিশ্বাস করেনি। তাদের ধারণা, এটি সরকারের ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর নির্ভর করছে। যদিও আইনের দিক দিয়ে বিবেচনা করলে সরকারের অ্যাটর্নি জেনারেল কোটা পদ্ধতি সংস্কার বা বিলুপ্তির পক্ষে, কিন্তু শিক্ষার্থীদের ওই অংশের ধারণা যে শেষ পর্যন্ত হয়তো কোটা বহাল রেখে রায় আসবে। তাই তারা আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ায়নি। এক পর্যায়ে আন্দোলন তীব্র হতে থাকে। সত্যি কথা বলতে কী, এই আন্দোলনে সরকারি দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগেরও কিছু কিছু সমর্থক বা কর্মী প্রাথমিকভাবে কোটা বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পদক ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও বলেছিলেন, ছাত্রলীগ এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে নামবে না, কারণ এটি শিক্ষার্থীদের একটি অরাজনৈতিক আন্দোলন। এমনকি ছাত্ররা যখন পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি জমা দিতে যায়, তখনো তাদের উপর পুলিশ চড়াও হয়নি এবং রাষ্ট্রপতির পক্ষে তা গ্রহণ করা হয়। কিন্তু দেখা গেছে কোটা বিরোধী আন্দোলন যখন শক্তিশালি হয়ে ওঠে, তখন আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বি বিএনপি এবং অন্যান্য সরকার বিরোধী দল সেই আন্দোলনের পেছনে এসে দাঁড়ালো। বিএনপি শিক্ষার্থীদের পক্ষে কর্মসূচি দিয়ে বসল। এবং শুধু বিএনপিপন্থী শিক্ষার্থীরাই না, অন্য অচেনা মুখ ঢুকে পড়ে এই আন্দোলনে। ছাত্রলীগও আর বেশি সময় নিজেদের ধরে রাখতে পারেনি। অনেকটাই যেন তাদেরকে টেনে আনা হলো। শুরু হয় পুলিশ, কোটা বিরোধী শিক্ষার্থী এবং ছাত্রলীগের ত্রিমুখী লড়াই। এ সংঘর্ষে দেশব্যাপী কমপক্ষে ৬ জন নিহত হয় এবং কয়েক শ’ শিক্ষার্থী আহত হয়।
এরই প্রেক্ষিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ১৭ জুলাই সন্ধ্যায় একটি ভাষণ দিয়েছেন। ভাষণের একটি পর্যায়ে তিনি বলেছেন, ‘আমার বিশ্বাস, আমাদের ছাত্র সমাজ উচ্চ আদালত থেকে ন্যায় বিচারই পাবে। তাদের হতাশ হতে হবে না।’ অর্থাৎ তিনি পরিষ্কার ইঙ্গিত দিলেন যে আদালত থেকে শিক্ষার্থীদের দাবি অনুসারে একটি রায় আসছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের পরপরই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফেসবুক পেজ থেকে পরদিন, অর্থাৎ ১৮ জুলাই কমপ্লিট শাটডাউন বা সর্বাত্মক হরতালের ডাক দেওয়া হয়। সঙ্গে সঙ্গে খবরটি সমস্ত গণমাধ্যমে প্রচার করা হয়।
এখন মনে করার অনেক কারণ আছে যে এই আন্দোলন আর শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। আন্দোলনে সরাসরি রাজনৈতিক দলগুলো এবং কিছু ধর্মীয় সংগঠনও জড়িয়ে পড়েছে। হেফাজতে ইসলাম এবং শর্ষিনা পীর ইতিমধ্যে কর্মসূচি দিয়েছে। এটা পরিষ্কার যে এই আন্দোলনকে ঘিরে সরকারের পদত্যাগের দাবি উঠবে। কোনো কোনো মহল থেকে এই কথাও উঠেছে যে এক বা একাধিক বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা এই আন্দোলনে ঘুঁটি চালতে শুরু করে থাকতে পারে। বিদেশি একটি গোয়েন্দা সংস্থা, যারা বরাবরই আওয়ামী লীগ বিরোধী, তারা বহুদিন ধরেই একরকম নিস্ক্রিয় হয়ে আছে। তারা ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের পাঁয়তারা করতে পারে। যে সকল দেশের সঙ্গে সরকারের ব্যবসা বাণিজ্য ও নুতন প্রকল্প গ্রহণের সম্ভাবনা কম, সেই সকল দেশ থেকেও আসতে পারে আর্থিক মদদ। সুতরাং আন্দোলনকে ভিন্ন পথে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া সরকারের মোটেই উচিত হবে না। কোটা নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে আদালতও একটি রায় নিয়ে আসতে পারে। আগামী কয়েক দিনে আমাদের কাছে অনেক কিছু স্পষ্ট হবে বলে মনে হচ্ছে। তবে সরকারকে বৃহৎ জনগোষ্ঠির নিরাপত্তার দিকে বিশেষ নজর রাখতে হবে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক।