আমাদের সময়ের অর্থাৎ ষাট ও সত্তর দশকের সবচেয়ে সাহসী, প্রাণোচ্ছল তারুণ্যে ভরপুর যুবক হচ্ছেন শেখ কামালউদ্দিন (যিনি শেখ কামাল হিসেবে সমধিক পরিচিত)। ১৯৪৯ সালের ৫ আগস্ট তাঁর জন্ম, আর মাত্র ২৬ বছর বয়সে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাত্রিতে সেনাবাহিনীর কতিপয় দলছুট দুর্বৃত্তের নির্মম বুলেটের আঘাতে প্রবাসী দুই বোন (শেখ হাসিনা ও শেখ রেহেনা) ছাড়া মা-বাবা, ভাই, জায়া, ভ্রাতৃজায়া ও স্বজনসহ তিনি শাহাদাতবরণ করেন। ষড়যন্ত্রের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে ছিলেন কুলাঙ্গার মুশতাক; জিয়া, শাহ মোয়াজ্জেম, ওবায়দুর রহমান, তাহের উদ্দিন ঠাকুর প্রমুখ।
ষাট ও সত্তর দশকের শেষার্ধ ও প্রথমার্ধের ছাত্র আন্দোলনের একজন সফল কর্মী, সংগঠক ও নেতা শেখ কামাল ছিলেন বাংলাদেশে আধুনিক ফুটবলের অন্যতম দিশারী, একজন প্রতিভাবান ক্রিকেটার, একজন ক্রীড়া সংগঠক, দক্ষ বাস্কেটবল খেলোয়াড়, নাট্যকর্মী ও প্রতিভাবান সেতারবাদক। আবাহনী ক্রীড়াচক্র, স্পন্দন শিল্পীগোষ্ঠী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নাট্যচক্র প্রভৃতি ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম শেখ কামাল তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষা ও সংস্কৃতি সপ্তাহের প্রাদেশিক প্রতিযোগিতায় সেতারবাদনে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে একজন উদীয়মান তরুণ সেতারবাদক হিসেবে আপন প্রতিভার উপযুক্ত স্বাক্ষর রেখেছিলেন। আবাহনী ক্রীড়াচক্রের হয়ে তিনি প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লিগে খেলেছেন এবং নাট্যচক্রের অনেক নাটকে করেছেন অভিনয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র হিসেবে তিনি ছিলেন শিক্ষক-ছাত্রমহলের মধ্যে জনপ্রিয় একজন ব্যক্তিত্ব। শেখ কামাল সম্পর্কে প্রখ্যাত সাহিত্যিক, লেখক, বুদ্ধিজীবী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আবুল ফজল লিখেছেন, “সে দিনের ঋজু দেহ দীর্ঘ লিকলিকে চেহারার সুদর্শন তরুণটির নম্র-মধুর ছবি আমার মনে আজও গাঁথা হয়ে আছে। আজ ও নেই, বাংলাদেশের সেরা মেয়ে ক্রীড়াবিদ, ওর নববধূটিও গেছে হারিয়ে।” (২৬.১০.৭৫-এ লেখা দিনলিপি: ‘শেখ মুজিব: তাঁকে যেমন দেখেছি’।)
১৯৬৯ সালে ঢাকা কলেজে ভর্তি হতে এসেছিলাম। আর যেদিন ঢাকা কলেজে প্রথম প্রবেশ করি, সেদিনই তাঁর সাথে হয়েছিল পরিচয় ও আলাপ। ইতিপূর্বে সভা আর মিছিলে সক্রিয় শেখ কামালকে দূর থেকে দেখেছি কিন্তু পরিচয় ও আলাপ হয়নি। দিন তারিখ মনে নেই, তবে স্মরণে আছে আমরা কয় বন্ধু মিলে মাদ্রাসা থেকে ভর্তি হতে কলেজে এসেছি। কলেজ কম্পাউন্ডে ঢুকে প্রথমেই গেলাম ছাত্রলীগের কর্মীদের টেবিলে, যেখানে তাঁরা সাহায্য করছিলেন নতুন ছাত্রদেরকে ভর্তির ব্যাপারে (তখন ভর্তি-ইচ্ছুক ছাত্রদেরকে সহায়তা করার জন্য প্রতিটি ছাত্রসংগঠন থেকে ছাত্রকর্মীরা টেবিল পেতে বসে ফরম পূরণ, অফিসের দৌড়াদৌড়ি ইত্যাদি কাজে নবাগতদের সহায়তা করতেন)।
ঢাকা কলেজে তখন ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া ও মেনন গ্রুল্প) ও ইসলামী ছাত্রসংঘ খুবই তৎপর ছিল। সেখানে ছিলেন কলেজ থেকে সদ্য পাস করে বেরিয়ে যাওয়া শেখ কামাল ও তাঁর বন্ধুরা। আমার বন্ধুদের মধ্যে অন্তত দুইজনের সাথে শেখ কামালের পরিচয় ছিল। তাঁরাসহ আমরা গেলাম কামাল ভাইয়ের কাছে। তিনি আমাদেরকে সাদরে গ্রহণ করলেন এবং (আমাকে দেখিয়ে) বললেন যে, ওর রেজাল্ট তো খুবই ভালো। ওকে আমরা সংসদে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দাঁড় করাব। আমি তো অবাক। তাঁর আন্তরিকতায়, তাঁর কথায় আমরা সবাই অভিভূত হয়ে গেলাম। শহীদ শেখ কামালের সাথে এমনিভাবে আমার পরিচয় হয়েছিল।
তারপর ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলো। যথারীতি আমি সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলাম। নির্বাচনের সময় তাঁর সাংগঠনিক প্রতিভা, নির্বাচন পরিচালনায় তাঁর দক্ষতা প্রত্যক্ষ করলাম। সেসব অনেক কথা, অনেক কাহিনি, যা বলে শেষ করার নয়। শুধু একটি কাহিনি এখানে উল্লেখ না করলেই নয়। ইয়াহিয়ার সামরিক শাসন জারির পর আওয়ামী লীগের আহ্বানে কোনো এক হরতাল পালন করতে গিয়ে কর্মীদের নিয়ে কাজ করার সময় আমি গ্রেফতার হয়ে যাই টহলরত সামরিক বাহিনীর হাতে। পরে আমাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালতে আমার বিচার হবে। অপেক্ষায় আছি। এমনি সময়ে ঈদ-উল-ফিতরের দিন হঠাৎ করে অপ্রত্যাশিতভাবেই দুপুরের সময় একটি বড় টিফিন ক্যারিয়ারে আমার জন্য বাইরে থেকে খাবার গেল। জেল কর্তৃপক্ষ জানালেন, বঙ্গবন্ধুর বাড়ি থেকে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের নিজ হাতে রান্না করা খাবার কামাল ভাই গেটে এসে দিয়ে গেছেন আমার জন্য। আনন্দে, কৃতজ্ঞতায় আমার দু-চোখ ভরে পানি নেমে এলো।
কামাল ভাই তাঁর একজন রাজনৈতিক সহকর্মীর কথা ভোলেননি। নেতা হিসেবে, বন্ধু হিসেবে, সহকর্মী হিসেবে এবং সর্বোপরি মানুষ হিসেবে শেখ কামাল কত বড় মাপের ছিলেন এ ঘটনা তাঁর উজ্জ্বলতম উদাহরণ। আজও কামাল ভাইয়ের কথা মনে হলে চোখ দুটি পানিতে ভরে আসে। সত্তরের নির্বাচন, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের পরে সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে ছাড়িয়ে এনে পুনরায় ছাত্ররাজনীতিতে সম্পৃক্তিকরণ, তেয়াত্তরের ডাকসু নির্বাচন, হঠকারী রাজনীতির অনুসারীদের দ্বারা ছাত্রলীগের বিভক্তির পর মূলধারা ছাত্রলীগকে পুনর্গঠন ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই তাঁর সাথে একযোগ হয়ে কাজ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের কালরাত্রিতে সর্বশেষ তাঁর সাথে আমার কথা হয়েছিল টেলিফোনে মধ্যরাত্রিতে। পরদিন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আসবেন বিশ্ববিদ্যালয়ে সে বিষয়ে ছাত্রদের প্রস্তুতির সর্বশেষ অবস্থা নিয়ে।
চৌকস বলতে যা বুঝায় তাই ছিলেন শেখ কামাল। খেলাধুলা, পড়াশোনা, সংগীত, নাটক, রাজনীতির উত্তপ্ত ময়দান- সর্বত্রই তাঁর বিচরণ ছিল সাবলীল ও স্বচ্ছন্দ। নিজে খেলতেন এবং খেলাধুলার এক কৃতী সংগঠকও ছিলেন শেখ কামাল। যন্ত্রসংগীতে পারঙ্গম এই অফুরন্ত প্রাণশক্তির তরুণ সংগীতজগতেরও একজন সফল সংগঠক ছিলেন। সহজাত অভিনেতা শেখ কামাল অভিনয়ে যেমনি, নাট্য-সংগঠনেও তেমনি তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী ও পরবর্তী ছাত্ররাজনীতিতে তাঁর উপস্থিতি ছিল উজ্জ্বল। সংগঠক হিসেবে অতুলনীয়। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটার হিসেবে তিনি অংশ নিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিমে ও আবাহনী ক্রীড়াচক্রে। বাংলাদেশের ফুটবলের আধুনিকায়নের তিনি অগ্রদূত। দেশের ক্রীড়াঙ্গনের অন্যতম প্রধান সংগঠন ‘আবাহনী ক্রীড়াচক্রের’ প্রতিষ্ঠাতা হচ্ছেন শেখ কামাল।
আবাহনী শেখ কামাল আর বাংলাদেশের ক্রীড়াজগতের আধুনিকায়ন পরস্পর সম্পর্কযুক্ত হয়ে আছে। শেখ কামালকে হত্যা করে যারা ইতিহাসের পাতা থেকে তাঁর নাম মুছে দিতে চেয়েছিল, তারা ব্যর্থ হয়েছে। ‘আবাহনী’র সগৌরব অগ্রযাত্রা শেখ কামালের স্মৃতিকে জাগ্রত রাখবে। সংগীতের জগতে শেখ কামালের বিচরণ ছিল খুব স্বচ্ছন্দ। বিশেষ করে যন্ত্রসংগীতে তাঁর পারঙ্গমতা ছিল উল্লেখযোগ্য। ছায়ানটের ছাত্র ছিলেন শেখ কামাল। বন্ধুদের সাথে নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন ‘স্পন্দন শিল্পীগোষ্ঠী’। এ স্পন্দন শিল্পী- গোষ্ঠীর অনেকেই বিশিষ্ট তারকা। একইভাবে নাটকের জগতেও তাঁর বিচরণ ছিল খুবই সাবলীল ও অবাধ। ম. হামিদ এবং খ. ম. হারুন প্রমুখ প্রখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্বদের সাথে মিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘নাট্যচক্র’ নামক সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন শহীদ শেখ কামাল। তিনি নাট্যচক্রের অনেকগুলো নাটকেও অভিনয় করেছেন।
শেখ কামাল ছিলেন একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক ও সময়ের সাহসী সন্তান। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে নেয়ার সময় এক ফাঁকে শেখ কামাল গৃহ থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন এবং মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম ব্যাচের ক্যাডেট অফিসার হিসেবে ট্রেনিং শেষে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি (কমান্ডার-ইন-চিফ, নট সুপ্রিম কমান্ডার) জেনারেল এমএজি ওসমানীর এডিসি হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। ওসমানী সাহেবকে যাঁরা জানেন তাঁরা অবগত আছেন যে, তাঁর সঙ্গে কাজ করা কতটা দুরূহ বিষয়। এছাড়া এ পদটির গুরুত্ব অপরিসীম। লে. শেখ কামাল হাসিমুখেই এ দুরূহ কাজটি সম্পাদন করে গেছেন নিষ্ঠার সঙ্গে। দেশপ্রেম এবং সাহস তাকে তাঁর দায়িত্ব পালনে সহায়তা করেছে। মা-ভাইবোনদের পেছনে রেখে মায়া-মমতা ত্যাগ করে দেশের ডাকে সাড়া দিতে এক মুহূর্তও ভাবেননি শেখ কামাল। আর তাঁর মহীয়সী মা হাসিমুখেই স্বামী ও পুত্রের ভিন্ন ভিন্ন যাত্রায় দেশের জন্য ত্যাগ স্বীকারের পথ চলতে প্রেরণা জুগিয়েছেন।
নেশাজাতীয় কোনো দ্রব্য, এমনকি সিগারেটও তিনি গ্রহণ করেননি কোনোদিন। ভদ্র, বিনম্র ও চঞ্চল শেখ কামাল পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হয়েছিলেন বাংলাদেশের সেরা মহিলা ক্রীড়াবিদ সুলতানা বেগম খুকীর সঙ্গে। খুকী আপা, পরে আমাদের সুলতানা ভাবী আর শেখ কামাল এমন এক জুটি যেন তাঁরা একে অপরের জন্যই সৃষ্টি হয়েছিলেন। মরণেও তাঁরা তাই প্রমাণ করে গেলেন। উভয়ের প্রেম ছিল নিষ্কলুষ ও মার্জিত। পরস্পরের প্রতি তাঁদের আকর্ষণ কখনো শালীনতার মাত্রা অতিক্রম করেনি।
সংগঠক হিসেবে ক্রীড়া, সংগীত ও নাটকের ক্ষেত্রে যেমন ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ, তেমনি ছাত্ররাজনীতির ক্ষেত্রেও তাঁর ছিল নিরলস কর্মপ্রয়াস। স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী সময়ের এমন কোনো ছাত্র আন্দোলন নেই যাতে তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি ছিল না। ৬-দফা, ১১ দফা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাবিরোধী আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেই একজন প্রথম কাতারের ছাত্রকর্মী হিসেবে তাঁর উপস্থিতি ছিল। মিছিলে, সমাবেশে, স্লোগানে উচ্চকিত হতে তাঁকে চোখে পড়েছে সকল মানুষের।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে শেখ কামালকে সেনাবাহিনী থেকে বের করে নিয়ে আসা হয়। এতে বঙ্গবন্ধুর সম্মতি আদায় করতে ইসমত কাদির গামা, মমতাজ হোসেন (সাবেক রাষ্ট্রদূত), সৈয়দ নুরুল ইসলাম ও আমি উদ্যোগী ভূমিকা নিয়েছিলাম (কাজটা সেদিন ভালো করেছিলাম, না অর্বাচীনের মতো করেছিলাম, আজকের এই ক্ষণে দ্বিধায় ভুগছি)। আমার কেন যেন মনে হয় বঙ্গবন্ধু অনেকটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমাদের প্রস্তাবে সায় দিয়েছিলেন। শেখ কামালের সায় ছিল পুরোটাই। হয়তোবা বঙ্গবন্ধু আমাদেরকে অপত্য স্নেহ করতেন, তাই আমাদেরকে বিমুখ করতে পারেননি (তাঁর এই আকাশসম স্নেহ-মমতা আর ভালোবাসার সুযোগেই বাঙালি জাতির কতিপয় কুলাঙ্গার ষড়যন্ত্র করে তাঁকে হত্যা করতে সক্ষম হয়েছিল)।
বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে শেখ কামাল সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। অতি বিপ্লবী হঠকারী স্লোগান দিয়ে ছাত্রলীগের দ্বিধাবিভক্তিতে আমাদের অংশটা ছিল দুর্বল (জাসদের অংশ ছিল সবল)। এই দুর্বলাবস্থা থেকে একটি মজবুত সংগঠন গড়ে তোলার কাজে শেখ কামাল ও তাঁর নেতৃত্বে আমরা যারা অপেক্ষাকৃত তরুণ ছিলাম কেন্দ্রীয় কমিটিতে, অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছি। কিন্তু ষড়যন্ত্র ছিল অত্যন্ত গভীরে প্রোথিত। এক ভাঙনের ধাক্কা সামলাতেই আরেক ধাক্কা। শফিউল আলম প্রধানের নেতৃত্বে অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতায় বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে সাতখুনের নির্মম ঘটনায় আমরা স্তম্ভিত ও বিপর্যস্ত হয়ে গেলাম। এবারও ত্রাতার ভূমিকায় আমরা কয়জনা। নেতৃস্থানীয় অনেকেই অন্তর্ঘাতের হোতা প্রধানের রক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ। কী যে দুঃসময়। বন্যা, দুর্ভিক্ষ মৃত্যু, অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা, আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে ‘তেল যুদ্ধ’- সব মিলিয়ে এক কঠিন সময়। ছাত্ররা স্বভাবতই আবেগপ্রবণ এবং তদানীন্তন বিশ্বপরিস্থিতির আলোকে বৈপ্লবিক ও বামপন্থার ঝোঁক তাদের মধ্যে প্রবল। আলবদর, আলশামস আর মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত পক্ষ গোপনে তৎপর ছিল। এরই মাঝে ছাত্রলীগকে পুনর্গঠন ও সাংগঠনিক দিক দিয়ে দৃঢ় ভিত্তি দেয়া কতটা পরিশ্রমের কাজ- আজকের দিনে তা কল্পনাও করা যাবে না। এমনি অবস্থার মধ্য দিয়ে চলতে চলতেই বঙ্গবন্ধু আমূল রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রিক সংস্কারের কর্মসূচি নিলেন। ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র সমিতি, বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন ও জাসদ ছাত্রলীগের ছোট দুটি উপদল নিয়ে জাতীয় ছাত্রলীগ গঠন করা হলো দেশের রাষ্ট্রিক ও রাজনৈতিক সংস্কার কর্মসূচির সহায়ক ছাত্রসংগঠন হিসেবে। এখানেও আমরা একুশ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটিতে একত্রে কাজ করার সুযোগ পেলাম। মোদ্দাকথা যে, ছাত্ররাজনীতির ক্ষেত্রে শেখ কামালের ছিল বিরাট ভূমিকা এবং একজন রাজনৈতিক সংগঠক হিসেবে তিনি ছিলেন অনন্য।
দুর্ভাগ্য আমাদের যে, পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে ঘরোয়া রাজনীতির শুরুতে আওয়ামী লীগের প্রথম প্রকাশ্য কর্মিসভায় (যে সভায় আওয়ামী লীগ পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়) শোকপ্রস্তাবে তাঁর নামটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি প্রথমে। মতিউর রহমান সাহেবের ধানমন্ডির বাসভবনের লনে অনুষ্ঠিত সভায় আমার প্রতিবাদের মুখে ও বন্ধুবর প্রয়াত অ্যাডভোকেট সাইদুর রহমান, ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন ও অন্যদের সমর্থনের ফলে শোকপ্রস্তাবে আমরা তাঁর নাম অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলাম (ইতিহাসের প্রয়োজনেই কথাটা এখানে আনতে বাধ্য হয়েছি। উল্লেখ্য, এর কিছুদিন পরই আমি গ্রেফতার হয়ে যাই।)
আমাদের মাঝ থেকে শেখ কামাল গত হয়েছেন আজ দীর্ঘ প্রায় ৪৯ বছর হতে চলল। এই ঊনপঞ্চাশ বছরে আমরা বন্ধু সৈয়দ নূরুল ইসলামকেও হারিয়েছি। ১৯৭৫-এর প্রতিবিপ্লবী তৎপরতার প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নিয়ে সহযোদ্ধাদের অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতায় তিনিও শাহাদাতবরণ করেছেন। যাঁরা বেঁচে আছি, তাঁদের স্মৃতিতে আজও তাঁর অম্লান উপস্থিতি। শূন্যতার মাঝেও তাঁদের উপস্থিতি দেশপ্রেমে স্থির থাকতে অনুপ্রেরণা জোগায়। তারুণ্যের প্রতীক শেখ কামাল আমাদের প্রজন্মের এক সাহসী সৈনিক।
লেখক: মন্ত্রী, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, সংসদ সদস্য, যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং ৭৫-পরবর্তী প্রতিরোধযোদ্ধা