গত ৬ আগস্ট ইউক্রেনের কয়েকটি সেনা ইউনিট বিস্ময়করভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে রাশিয়ার কুরস্ক ওব্লাস্টে ঢুকে পড়ে। এর মধ্য দিয়ে রাশিয়ার মাটিতে সামরিক অভিযানের আড়াই বছরের নিষেধাজ্ঞার অবসান ঘটে। কুরস্ক আক্রমণের এই উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য এখনও রহস্যঘেরা এবং এ নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। তবে এটি ইতোমধ্যে স্পষ্ট, ইউক্রেনের রাশিয়া আক্রমণের সিদ্ধান্ত ভ্লাদিমির পুতিনের সীমা ও পশ্চিমাদের ক্রমবর্ধমান ভয়কে উপহাসে পরিণত করতে সফল হয়েছে।
ইউক্রেনের সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য সম্ভবত দেশের দক্ষিণ ও পূর্বে সামরিক চাপ কমিয়ে আনা, যেখানে গত কয়েক মাসে রাশিয়া ধীরে ধীরে কিন্তু স্থিরভাবে অগ্রসর হচ্ছে। কিছুটা সুরক্ষিত সীমান্তে আক্রমণ ও রাশিয়ার ভূখণ্ড দখল করে ইউক্রেনের সেনারা মনে করছেন, তারা যুদ্ধের সম্মুখসারির সেনাদের তুলে নিতে ক্রেমলিনকে চাপ দিতে পারে, যেগুলো স্বয়ং রাশিয়ার সুরক্ষা দিতে পুনরায় মোতায়েন করা হয়েছিল।
এ হামলা ইউক্রেনের জন্য এক বছরের ব্যয়বহুল ও হতাশাজনক প্রতিরক্ষামূলক অভিযানের পর সামরিক পদক্ষেপ পুনরুদ্ধারের সুযোগ তৈরি করে। এটা দীর্ঘদিন ধরেই স্পষ্ট, ইউক্রেন বাস্তবে অনেক বড় ও ধনী রাশিয়ান ফেডারেশনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়ের আশা করতে পারে না। কিয়েভের সামরিক সাফল্যের সবচেয়ে বড় সুযোগটি নির্ভর করছে যুদ্ধের গতিশীলতা ও কৌশলের ওপর, যা একদিকে ইউক্রেনের কমান্ডারদের আপেক্ষিক তৎপরতা কাজে লাগাতে দেয়; অন্যদিকে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর অনেক জটিল সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ায় সুযোগ নিতে সাহায্য করে। কুরস্ক ওব্লাস্টের আক্রমণে ইউক্রেন ঠিক এটাই অর্জন করেছে।
মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে রাশিয়ার দুয়ারে যুদ্ধ নিয়ে এসে ইউক্রেন তাদের শত্রুদের মনোবলের ওপর একটি শক্তিশালী আঘাত হানার সুযোগ পেয়েছে। ভিনদেশে ইউক্রেনীয় সেনাদের কোনো আগাম বার্তা না দিয়ে হামলা করে নিজেদের মধ্যে খুবই দরকারি মনোবল শক্ত করে তুলেছে। এতে তাদের মধ্যে এই আশা জাগিয়েছে যে, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটি এখনও গুরুত্বপূর্ণ সামরিক সাফল্য অর্জন করতে পারে।
রাশিয়ায় ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর অগ্রগতি যুদ্ধের ধারণা পেতে গোড়ার বার্তা দেয়। রাশিয়ার আক্রমণ একটি অচলাবস্থা তৈরি করেছে এবং যুদ্ধক্ষেত্রে আর ভিন্ন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না– ইউক্রেন সেনাদের হামলা এই বিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এতে ভ্লাদিমির পুতিনের সীমা লঙ্ঘন ও উত্তেজনা বেড়ে যাওয়া নিয়ে পশ্চিমের অতি গুরুত্ব দেওয়ার মূর্খতাও উদোম হয়ে পড়েছে।
সর্বোপরি রাশিয়ার ওপর ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর বর্তমান আক্রমণটি অবশ্য সব ধরনের সীমা লঙ্ঘনের মধ্যে সবচেয়ে বড়। যদি রাশিয়া সম্ভাব্য পারমাণবিক হামলার আশঙ্কা বেড়ে যাওয়া নিয়ে জোরেশোরে প্রস্তুতি নিত, তাহলে এটি তার জন্য বিবিধ হুমকির বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ এক পদক্ষেপ হয়ে দাঁড়াত। বাস্তবে পুতিন আক্রমণকে কমিয়ে আনার চেষ্টা করে নিজের প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন; অথচ তিনি এমন ভাব ধরেছিলেন, সবকিছু এখনও তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী চলছে।
ইউক্রেনের আক্রমণ শুরু হওয়ার পর প্রথম গণবিবৃতিতে পুতিন একটু নরমভাবে এটি ‘বড় আকারের উস্কানি’ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। তখন মনে হয়েছিল, বাক্যের এই অংশ পরিস্থিতির মাত্রা চাপা দিতে বিশেষভাবে তৈরি করা। ক্রেমলিন কুরস্ক ওব্লাস্টে এক ‘জরুরি অবস্থা’ জারি করে, যা পরে ‘সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান’-এ রূপ দেওয়া হয়। এই সংযত আইনশৃঙ্খলার ভাষা ও ন্যাটোর সঙ্গে অস্তিত্বের লড়াইয়ে স্বাভাবিকভাবে উত্তপ্ত শব্দ বিনিময়ের মধ্যে পার্থক্যটা খুব কমই পরিস্থিতি জটিল করতে পারে।
২০১৪ সালে ইউক্রেনের উপদ্বীপ দখল পুতিনের গৌরবের মুকুট হিসেবে রয়ে গেছে। এ ঘটনা দেশটির সর্বশ্রেষ্ঠ শাসকদের মধ্যে তিনি একজন ও রাশিয়ার ইতিহাসে তাঁকে স্থান দেওয়ার ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। এর পরও ইউক্রেন যখন ক্ষেপণাস্ত্র ও সামুদ্রিক ড্রোন মোতায়েন করে পুরো রাশিয়ার ব্ল্যাক সি ফ্লিটের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ডুবিয়ে দিতে বা নিষ্ক্রিয় করতে চেয়েছিল, তখন ক্রেমলিনের কাছ থেকে কোনো পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। বিপরীতে পুতিন তাঁর বাকি যুদ্ধজাহাজগুলো ক্রিমিয়া থেকে সরিয়ে ফেলে রাশিয়ার বন্দরে নিরাপত্তা খোঁজার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
পুতিন উস্কানি পেতে পারেন এই ভয়ে, পশ্চিমা বিশ্ব দুই বছরেরও বেশি সময় ধীরগতিতে ইউক্রেনে সামরিক সহায়তা দিয়েছে। এখনও মাঝে মাঝে ইউক্রেন এটাই প্রমাণ করেছে, যখনই রাশিয়ার স্বৈরশাসক পরাজয়ের সম্ভাবনার মুখোমুখি, তখন তিনি সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেয়ে অনেক বেশি পিছু হটেছেন। যেহেতু ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী এখন পুতিনের শেষ সীমানা অতিক্রম করে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা ছাড়াই রাশিয়া আক্রমণ করেছে, সুতরাং কিয়েভের আত্মরক্ষার ক্ষমতায় সীমাবদ্ধতা বা যুদ্ধজয়ে ইউক্রেনের প্রয়োজনীয় অস্ত্রগুলোর ব্যাপারে অস্বীকার করার আর কোনো অজুহাত নেই।
পিটার ডিকিনসন : আটলান্টিক কাউন্সিলের ইউক্রেন অ্যালার্ট সার্ভিসের সম্পাদক; আটলান্টিক কাউন্সিল থেকে ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম