ম্যাচ শেষে এমন ঘোষণা আমরা অনেকবার শুনেছি- ‘‘সাকিব আল হাসান, ম্যান অব দ্য ম্যাচ।” আবার টুর্নামেন্ট শেষেও মাইক্রোফোনে উচ্চারিত হয়েছে বহুবার- ‘‘সাকিব আল হাসান, ম্যাচ অব দ্য টুর্নামেন্ট।” তবে এই প্রথমবারের মতো শুনতে হচ্ছে-সাকিব আল হাসান, মার্ডার কেসের আসামী!
ক্রিকেট সাকিবকে এখন পর্যন্ত তার ক্যারিয়ারে অনেক কিছু দিয়েছে। সম্মান, অর্জন, পুরস্কার- সঙ্গে শাস্তিও। আর রাজনীতি করতে এসে সর্বশেষ তার পরিচয় হচ্ছে-খুনের মামলার আসামী!
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতাচ্যুতিরপর দেশে এখন নতুন অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের শাসন চলছে। এই সময়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী এবং রাজনীতির সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন, তাদের অনেকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে এবং হচ্ছেও। সেই তালিকায় অনেকের সঙ্গে পড়ে গেছেন সাকিব আল হাসানও।
রাজনীতি করলে হামলা, মামলা সইতেই হবে। অন্তত বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিত তাই জানায়। তবে স্রেফ হয়রানি, নিপীড়ন, নির্যাতন ও সম্মানহানির জন্য কারো বিরুদ্ধে কোনো মামলা করা হলে সেটা আর মামলা থাকে না, তা ‘মামলাবাজিতে’ পরিণত হয়! সেই মামলার মেরিট নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। গ্রহণযোগ্যতা হারায়। গণঅভ্যূত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার অমন সব হয়রানি মামলা ঠুকে ‘সুখ’ খুঁজলেও দেশের সাধারণ মানুষ এবং বিশ্বের কাছে পরিষ্কার বার্তা গিয়েছিল যে ওসব মামলার উদ্দেশ্য সৎ নয়।
আমি কোনো তুলনায় যাচ্ছি না। আবার সেই সঙ্গে এটাও বলছি না যে, সাকিবের বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে না। যাবে, যে কারোর বিরুদ্ধেই করা মামলা করা যাবে। সাকিবের বিরুদ্ধে অভিযোগ, মামলা করার আরো অনেক ক্ষেত্র আছে। বিতর্কিত শেয়ার ব্যবসায় তার সংযোগ, বিনিয়োগ, অনলাইন জুয়াড়ি প্রতিষ্ঠানের হয়ে বিজ্ঞাপনে অংশ নেওয়া, দাগী আসামির স্বর্ণের দোকান উদ্বোধন; বিতর্ক হতে পারে এমনতর আরো অনেক কাণ্ডে জড়িয়েছেন সাকিব।
সাকিবের বিরুদ্ধে যদি অভিযোগই খুঁজতে হয়, তাহলে ক্রিকেট মাঠের বাইরে তার বিরুদ্ধে অভিযোগের অভাব হবে না। আওয়ামী লীগ করলেই তাকে এবং সবাইকে হত্যা মামলায় ফাঁসাতে হবে, কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে, জেলে থাকতেই হবে- এমন পূর্ব-সিদ্ধান্ত নিশ্চয়ই সুসভ্য কোনো চিন্তা-ভাবনার ইঙ্গিত দেয় না।
সাকিবের বিরুদ্ধে এই হত্যা মামলার খবরে ফেসবুকে অনেকেই প্রকাশ্যে এবং মনে মনে ‘সুখ’ খুঁজছেন। কিন্তু এসব মামলা-কাণ্ড যে বহির্বিশ্বে ‘নতুন বাংলাদেশ’ সম্পর্কে একটা বাজে বার্তা দিচ্ছে-সেই বাস্তবতাও বর্তমান প্রশাসনের মনে রাখা উচিত।
এমন সব মামলা কারা করছেন সম্ভবত তা বর্তমান প্রশাসনের উপরের স্তরে যারা আছেন তারাও জানেন না। তবে এইসব মামলা এখন এক নাগাড়ে দেওয়া হচ্ছে। নেওয়াও হচ্ছে। সাকিব বাংলাদেশ ক্রিকেটের আইকন। আর ঠিক অন্যভাবে দেখলে আইকনিক চরিত্রের সঙ্গে সঙ্গে সাকিবকে ঘিরে বিতর্কও কিছু কম ছিল না।
আপনি কেন রাজনীতিতে এলেন? রাজনীতিবিদদের এই প্রশ্ন প্রায়ই শুনতে হয়। খুব অবাক করার বিষয় হলো তাদের সবারই প্রায় একই রকম মুখস্থ করা উত্তর দেন, বলেন, ‘‘জনসেবা করতেই মুলত আমি রাজনীতিতে এসেছি।” স্পষ্ট মনে আছে সাকিব নিজেও সংসদ সদস্য হয়ে মুজিবকোট গায়ে সংসদ ভবনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেদিন বলেছিলেন, ‘‘মানুষের জন্য কাজ করার চেষ্টা করবো।” সাকিব সম্ভবত সেদিন থেকেই ‘রাজনীতিবিদ’ হয়ে উঠার চেষ্টা করছিলেন। তবে এটা খুবই স্পষ্ট যে, সাকিব রাজনীতিতে জড়িয়েছিলেন দেশসেবার জন্য না৷ মাঠের ক্রিকেট অনেক দেখা হয়ে গিয়েছিল তার। ক্রিকেটার হিসেবে মাঠে প্রায় সবকিছুই পেয়েছেন। তিন ফরম্যাটেই বিশ্বের নাম্বার ওয়ান ছিলেন। সব ফরম্যাটেই বাংলাদেশের অধিনায়ক ছিলেন। ক্রিকেটার হিসেবে মাঠে এবং মাঠের বাইরে যা চেয়েছেন তার সবই পেয়েছেন। বলতে হয়, একটু বেশি মাত্রায় পেয়েছেন। নিজের ইচ্ছেয় তিনি এমনকি বোর্ড সভাপতিকেও সিদ্ধান্ত পাল্টাতে বাধ্য করতে, এমনকি বলা যায় নাচাতেও পেরেছেন! সিরিজ শুরুর আগে বিদেশ থেকে ফিরে ক্যাম্পে যোগ দেন না, কিন্তু ঠিকই শুটিংয়ে অংশ নেন। অনিয়মকেই সাকিব নিয়ম বানিয়ে ফেলেছিলেন!
বিসিবিতে ক্রিকেটারদের জন্য অনেক নিয়ম-কানুন রয়েছে। কিন্তু সেই নিয়ম সাকিব পাত্তা দেন কিনা- এমন প্রশ্নের উত্তরে সাবেক বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনকে বারবার শুধু বলতে হয়েছে, ‘‘বেসিক্যালি বিষয়টা হলো আমরা তো জানি যে, সাকিব একটু অমনই..!”
সাকিব যে রাজনীতিতে হঠাৎ করেই নেমেছেন তা-ও কিন্তু নয়। ছয় বছর আগে ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগেও তিনি এমন খায়েশের কথা জানিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু এভিনিউ এবং ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে দৌড়াদৌড়িও করেছিলেন। কিন্তু সেই দফায় আওয়ামী লীগ শুধুমাত্র মাশরাফি বিন মতুর্জাকে বেছে নিয়েছিল। সাকিবকে সেবার তারা অপেক্ষায় রাখে। সাকিবের সেই অপেক্ষা শেষ হয় ২০২৪-এর নির্বাচনে।
তার রাজনীতিতে সেই ‘সুখের’ বয়স মাত্র ছয় মাস! তবে এটা স্পষ্ট যে, সাকিব শুধুমাত্র জনসেবার জন্য রাজনীতিতে জড়াননি। তিনি তো কখনোই গ্রামমুখি বা তার এলাকামুখি ছিলেন না। আরে তিনি তো তার যশোর এলাকা থেকে মনোনয়ন চাননি, চেয়েছিলেন ঢাকার ধানমন্ডি থেকে। নায়ক ফেরদৈাসের জন্যই তাকে ঢাকা থেকে সরে যেতে হয়। নির্বাচনে একজন আইকনকে খুঁজছিল আওয়ামী লীগ, সেই কোটায় শেষমেষ তাকে যশোর থেকে মনোনয়ন দেয়া হয়। সাকিবও এই রাজনীতি থেকে ক্ষমতা-সুবিধা লুটতে ‘পলিটিক্স’ শিখতে শুরু করেন। যদিও এই পলিটিক্সের হাতে খড়ি তার বহু আগেই হয়েছে খেলায় এবং খেলার মাঠে, এমনকি ড্রেসিংরুম শেয়ার করা নিজ সতীর্থের সঙ্গে এবং বিরুদ্ধেও! আর তাই এখন সাকিব-তামিমের যৌথ জুটিতে রেকর্ডের চেয়ে ক্রিকেট মহলে বড় আলোচনার বিষয় তাদের ‘পলিটিক্স’!
অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ দায়িত্ব গ্রহণের পর বলেছিলেন, ‘‘আমরা ব্যক্তি না, সিস্টেমে বদল আনতে চাই।”
আমরা এর আগের শাসনামলে দেখেছি আওয়ামী লীগ যে কোনো ভুল বা বাজে সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যায় বলতো, এটা তো আগে বিএনপিও করেছিল। এখন যদি বর্তমান প্রশাসনও সেই একই ব্যাখ্যা ও নজির হাজির করে, তাহলে সিস্টেমে বদল কোথায় এবং কিভাবে হবে?
মানেন নিশ্চয়ই, প্রতিহিংসার রাজনীতি কেবল প্রতিহিংসাই শেখায়!
লেখক: স্পোর্টস বাংলা.নিউজ