ফিলিস্তিনে গণহত্যায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়

মত ও পথ ডেস্ক

সংগৃহীত ছবি

ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার প্রশ্নে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের অন্যতম স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস ইসরাইলের অভ্যন্তরে যে আকস্মিক ও দুঃসাহসী অভিযান চালিয়েছে, তার জবাবে ইসরাইল গাজার অভ্যন্তরে নির্বিচারে গণহত্যা চালাচ্ছে। গাজার নিরীহ ও নিরস্ত্র নারী, শিশু, বৃদ্ধ তথা বেসামরিক নাগরিকদের নির্বিচারে হত্যা করা এবং তাদের আশ্রয়স্থল কিংবা অবকাঠামোগত ব্যবস্থাকে ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে উড়িয়ে দেওয়ার মতো ঘৃণ্য কাজ করছে। এমনকি মসজিদসহ হাসপাতাল, চার্চ, স্কুল, কলেজ ও বিভিন্ন বিশ^বিদ্যালয়ের স্থাপনায় বিরামহীনভাবে হামলা চালাচ্ছে ইসরাইল। যুদ্ধাহত অসহায় মানুষকে বয়ে নিয়ে যাওয়া অ্যাম্বুলেন্সও তাদের হামলা থেকে রক্ষা পায়নি। ইসরাইল হামলায় এ পর্যন্ত ৪০ হাজারের অধিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। সমগ্র গাজায় এখন খাদ্য, পানীয়, ওষুধ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।

ইসরাইলের বর্তমান সরকার ও সেনাবাহিনী সাম্রাজ্যবাদী যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র ইউরোপীয়দের সমর্থন ও প্রকাশ্য মদতে যা করছে; তার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে গণহত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। নিউইয়র্ক, লন্ডন, বার্লিনের মতো নগরীসহ বিশ^ব্যাপী শান্তিকামী মানুষ ইসরাইলিদের এই গণহত্যা বন্ধ করার জন্য চাপ দিয়েছে। যদিও এ বিষয়ে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আরব লীগ কিংবা ওআইসির গুরুত্ব ও কার্যকারিতা সম্পূর্ণভাবে অকার্যকর বলে মনে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি ও ফ্রান্সের আধিপত্যের কারণে চলমান এই সংঘাত এখন সম্ভাব্য তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

পূর্ব জেরুজালেম, গাজা এবং পশ্চিম তীরে যে ফিলিস্তিনিরা থাকেন, তাদের সঙ্গে ইসরাইলিদের উত্তেজনা প্রায়শই চরমে ওঠে। গাজা ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী হামাস শাসন করে। ইসরাইলের সঙ্গে তাদের অনেকবার যুদ্ধ হয়েছে। গাজার সীমান্ত কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে ইসরাইল এবং মিসর, যাতে করে হামাসের নিকট কোনো অস্ত্র পৌঁছাতে না পারে। গাজা এবং পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিরা বলছেন, ইসরাইলের নানা পদক্ষেপ ও কঠোর বিধিনিষেধের কারণে তারা খুবই দুর্দশার মধ্যে রয়েছেন। অন্যদিকে ইসরাইল দাবি করে, ফিলিস্তিনিদের সহিংসতা থেকে নিজেদের রক্ষার জন্য তাদের এই কাজ করতে হয়। বর্তমানে ভুরোজনৈতিক বিবেচনায় মধ্যপ্রাচ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভুকৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় এখানকার সমস্যাও প্রকটভাবে দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে ফিলিস্তিন সংকটকে বর্তমানে জটিলভাবে দেখা হচ্ছে। জেরুজালেম মুসলিম, ইহুদি এবং খ্রিস্টান এই তিন ধর্মের মানুষের নিকট পবিত্র ভূমি হিসেবে বিবেচিত।

তাই এখানকার সংঘাত কেবল রাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধ নয়, এটি ধর্মযুদ্ধও বটে। এর সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতি ও জাতীয়তাবাদ অবধারিতভাবে জড়িয়ে গেছে। রাষ্ট্রশক্তির বাইরে এই সংঘাতে শতাব্দীর পর শতাব্দী অ-রাষ্ট্রীয় শক্তি, রাষ্ট্রীয় জোট, সাম্রাজ্য যুদ্ধ করেছে। এই ইস্যুতে শুধু মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র পরিবর্তন হয়নি, এমনকি নিকট অতীতে অনেক প্রভাবশালী দেশের রাজনৈতিক সরকারের পতনও হয়েছে। মানব ইতিহাসে সাম্রাজ্যের পর সাম্রাজ্য এসেছে। রোমান সাম্রাজ্য থেকে অটোমান সাম্রাজ্য সব সাম্রাজ্যেরই লক্ষ্য ছিল জেরুজালেম ও আল-আক্সাকে নিয়ে। ধর্ম ও রাজনীতির বাইরেও ভূমধ্যসাগরের তীরের এই ভূখন্ডটির বাণিজ্যিক ও পূর্ব-পশ্চিম যোগাযোগ তৈরির গুরুত্ব রয়েছে। ফলে, বিশ্ব মোড়ল হিসেবে আগে ব্রিটিশরা এবং বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অঞ্চলটির ওপর কর্তৃত্ব বজায় রাখতে সর্বদাই তৎপর।

১৯৪৮ সালে অবৈধভাবে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে মধ্যপ্রাচ্য থেকে শান্তি তিরোহিত হয়েছে। ইরান, সৌদি আরব, মিসর, জর্দান, আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতারসহ বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে আরব প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে। এতে ইন্ধন জুগিয়ে যাচ্ছিল ইসরাইল এবং তাকে সার্বিক সাহায্য-সহযোগিতা ও সামরিকভাবে মদদ দিয়ে যাচ্ছিল যুক্তরাষ্ট্র। সৌদি আরব, ইরান, আরব আমিরাত, এমনকি রাশিয়াও জ্বালানি সরবরাহের বিষয়ে এখন ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এই পরিস্থিতিকে আরও উদ্বেগজনক করে তুলেছে। এই অবস্থায় চীনের মধ্যস্থতায় সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে নতুন পর্যায়ে সমঝোতা এবং সম্পর্ক স্থাপন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তা ছাড়া তুরস্কের রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের ফলপ্রসূ কূটনৈতিক পদক্ষেপের কারণে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে সৌদি আরব, ইরান, মিসর, জর্দান ও আমিরাতের মতো পরস্পরবিরোধী আরব রাষ্ট্রগুলো। তুরস্কের প্রচেষ্টায় তাদের মধ্যে এখন গড়ে উঠছে উন্নত বাণিজ্য ও সামরিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন সহযোগিতামূলক প্রকল্প।

সৌদি আরব ও আমিরাত তুরস্কের সঙ্গে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের সামরিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। যাতে যৌথ উদ্যোগে উৎপাদিত হবে আধুনিক ড্রোনসহ বিভিন্ন ক্ষেপণাস্ত্র। তুরস্ক তৈরি করছে বিভিন্ন আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, যা আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে। এক্ষেত্রে রাশিয়া ভূকৌশলগত কারণে বিশেষভাবে সহযোগিতা করছে। এসব কারণে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা বেড়ে গেছে। গাজার প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস ও লেবাননের গেরিলা বাহিনী হিজবুল্লাহ ইরানের প্রযুক্তিতে গড়ে তুলেছে বিভিন্ন পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র সম্ভার। সামনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। তাছাড়া ইউক্রেনের সার্বিক পরিস্থিতি কোনোভাবেই আশাব্যঞ্জক মনে হচ্ছে না। হামাস-ইসরাইল যুদ্ধকে কেন্দ্র করে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

ইসরাইল বরাবরের মতোই গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। বরং তাদের যুক্তি যে, ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলার জন্য হামাসই দায়ী। তারা বলছে, গাজার ঘনবসতিপূর্ণ শহর ও শরণার্থী শিবিরের ভেতর এবং নিচে ঢুকে হামাস তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে, ইসরাইলের পক্ষে বেসামরিক লোকদের হত্যা এড়ানো এক রকম অসম্ভব করে দিয়েছে। তাদের দাবি, সাধারণ লোকদের সতর্ক করে দিতে ও ঝুঁকি এড়াতে তারা যা করার সবই করছে।

যুক্তরাষ্ট্রসহ ইসরাইলের অনেক মিত্র বহুল আলোচিত ‘দুই রাষ্ট্রভিত্তিক’ সমাধানের কৌশলের কথা বলছে। এর অর্থ ভবিষ্যতে ইসরাইলের পাশে পৃথক ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ওই অঞ্চলে টেকসই শান্তি বজায় রাখা। ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গড়ার বিষয়টি নিয়ে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রীকে ওয়াশিংটন কূটনৈতিক চাপ দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই ফিলিস্তিনি সংকটের মূল কারণ খুঁজে বের করে তার সমাধানসহ ইসরাইল আগ্রাসনের অবসানে সত্যিকারের প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে। ইসরাইল যাতে সকল আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও মানবিক আইন এবং জাতিসংঘ রেজ্যুলেশন ২৩৩৪সহ (২০১৬) সংশ্লিষ্ট অন্যান্য জাতিসংঘ রেজ্যুলেশন প্রতিপালন করতে সম্মত হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। ১৯৬৭ সালের সীমানা অনুযায়ী দ্বি-জাতি সমাধান কাঠামোর আওতায় পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন, কার্যকর ও সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ফিলিস্তিনি জনগণের ন্যায়সংগত অধিকার নিশ্চিত করা জরুরি। ইসরাইলি দখলদার বাহিনী কর্তৃক বাড়িঘর ও অবকাঠামো ভেঙে ফেলা, দখল, বহিষ্কার জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি এবং ফিলিস্তিনিদের রক্তপাত ঘটানোর কারণে ইসরাইল অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখন্ডে পরিস্থিতি ক্রমশ অবনতির দিকে যাচ্ছে।

ইসরাইলের এহেন কর্মকান্ড জাতিসংঘ রেজ্যুলেশন এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও মানবিক আইনের প্রতি সুস্পষ্ট অবজ্ঞা প্রদর্শন। ফিলিস্তিন প্রশ্নে জাতিসংঘে দীর্ঘদিন ধরে ধারাবাহিকভাবে আলোচনা চলমান থাকার অর্থ হচ্ছে ফিলিস্তিনি জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার রক্ষায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ব্যর্থতার একটি অনুস্বাক্ষর। জাতিসংঘে ফিলিস্তিনকে তার ন্যায্য স্থান প্রদানসহ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে ফিলিস্তিনি সমস্যার একটি ন্যায়সংগত, দীর্ঘস্থায়ী, ব্যাপকভিত্তিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধান নিশ্চিতে কাজ করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি পুনরায় আহ্বান জানান।

ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বাস্তব সত্যটি অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এখন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে। সেগুলো হলো- ১) স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের সীমানা নির্ধারণ, ২) জেরুজালেমের ভবিষ্যৎ এবং ৩) উদ্বাস্তু ফিলিস্তিনিদের নিজ বাসভূমে ফিরিয়ে আনা। ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে জেরুজালেমকে স্বীকৃতি দিয়ে পরিস্থিতি আরও জটিল করে দিয়েছেন।

তবে বারাক ওবামা প্রশাসন দুই রাষ্ট্রের ফর্মুলা (ইসরাইল ও ফিলিস্তিন) নিয়ে কিছুদূর এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। ২০১৪ সালের ৮ জুলাই গাজা ভূখন্ড থেকে সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করার অজুহাতে ইসরাইল বাহিনী ফিলিস্তিনিদের ওপর হত্যালীলা চালায়। কিন্তু জাতিসংঘ এই গণহত্যা বন্ধ করার জন্য কোনো সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। সে সময়ের মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ২৭ জুলাই পশ্চিম এশিয়ায় ‘তাৎক্ষণিক ও স্থায়ী’ যুদ্ধ বিরতির দাবি জানান। যদিও তিনি ভালো করেই জানতেন যে, সেখানে যুদ্ধ নয়, চলছে একপেশে গণহত্যা।

ওবামা যুদ্ধবিরতি চাইলেও তার সরকার কিন্তু তখনও ইসরাইলকে অস্ত্র জোগান দেওয়া অব্যাহত রেখেছিল। দীর্ঘসময় ধরে চলমান ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংকট নিরসনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্তই ছিল দুই পক্ষের জন্য আলাদা দুটি দেশ। তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বি-রাষ্ট্র নীতির দরকার নেই বলে মন্তব্য করলেও আশার বাণী হচ্ছে, বর্তমান মার্কিন প্রশাসন বলছে, তারা দ্বি-রাষ্ট্র নীতি সমর্থন করেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইতোমধ্যেই ফিলিস্তিনিদের অধিকার আদায়ে দ্বি-রাষ্ট্রিক সমাধান চান বলে ঘোষণা দিয়েছেন। তবে তার এই চাওয়াটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে আরব ও মুসলিম বিশে^র ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার কোনো বিকল্প নেই। এর আগে হিলারি ক্লিনটন পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালীন বলেছিলেন যে, ইসরাইলের স্বার্থেই ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন। ফিলিস্তিনি আরবদের পূর্বনির্ধারিত কিংবা জাতিসংঘ স্বীকৃত স্থানে পৃথক রাষ্ট্র গঠনে ইসরাইলকে সম্মত হতে হবে। এজন্য বিশ্ব সম্প্রদায়, আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সংগঠন, ওআইসি, আরব লীগ ও মুসলিম রাষ্ট্রগুলোকে সম্মিলিতভাবে প্রয়োজনে ইসরাইলের ওপর চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখতে হবে।

বাংলাদেশসহ মুসলিম প্রধান দেশগুলো সবসময় ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং নিপীড়িত ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানিয়ে আসলেও বড় ধরনের সংকটে পুরো মুসলিম বিশ্বকে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে খুব একটা শক্ত অবস্থান নিতে দেখা যায় না। এমনকি মুসলিম দেশগুলোর সংগঠন ওআইসি কিংবা আরব লীগও ইসরাইলের সঙ্গে সংকটকালে ফিলিস্তিনের পক্ষে খুব জোরালো কোনো ভূমিকা নিতে পারে না। এবার গাজার নিয়ন্ত্রণে থাকা হামাস ইসরাইলি ভূখন্ডে ভয়াবহ হামলার পর নিরবচ্ছিন্ন বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইল।

উভয় পক্ষের আক্রমণে বহু সামরিক ও বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রভাবশালী পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো ইসরাইলের সমর্থনে এগিয়ে এলেও; মুসলিম বিশে^র প্রভাবশালী দেশগুলো তেমনভাবে এগিয়ে আসেনি ফিলিস্তিনের পক্ষে। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, মুসলিম বিশে^র জনগণ ফিলিস্তিনের পক্ষে একাট্টা হলেও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কাঠামোর দুর্বলতার কারণে সরকারগুলোর পক্ষে শক্ত অবস্থান নেওয়া সম্ভব নয়। ইসরাইলের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেওয়ার ক্ষেত্রে বড় সীমাবদ্ধতার জায়গা হলো ইসরাইলের পক্ষে পশ্চিমাদের অবস্থান। তবে সংঘাতের অবসানে আরব বিশ^ ও আন্তর্জাতিক উদ্যোগ হয়তো সফল হতে পারে। তবে কোনো কোনো আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক মনে করেন, অনেক বিষয় ইসরাইলকে উত্তেজনা বৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাওয়া থেকে বিরত রাখতে পারে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে পশ্চিমাদের আরেকটি বড় সংঘাতের প্রতি অনীহা এবং যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু সৌদি আরব-ইসরাইলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার কূটনৈতিক উদ্যোগ নিচ্ছে, তখন দেশটি সহিংসতা এড়াতে চাইবে।

সৌদি আরব-ইসরাইল শান্তি পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে। ইরান-সৌদি আরবের সম্পর্ক গভীর হচ্ছে। চীন সেখানে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নিয়েছে। চীনের যে আঞ্চলিক আঁতাতের চেষ্টা, তার গুরুত্ব বেড়েছে। পশ্চিম এশিয়ায় তার যে জিও পলিটিক্স, সেটাও অনেক বদলে গেছে।

অন্যদিকে পশ্চিম এশিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের যে অগ্রাধিকার, তা কিছুটা কমে যাচ্ছিল। আর সেই সুযোগটা চীন গ্রহণ করেছিল। চীন এই গালফের উত্তীর্ণ দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক খুব ভালো করতে শুরু করল, শান্তি স্থাপন করল এবং সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে বোঝাপড়ার বিষয়ে একটা ভূমিকা নিতে শুরু করল। চীনের মধ্যস্থতায় এখন ইরান ও সৌদির পুনর্মিলন, এটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সুখবর নয়। সৌদি আরব এবং আমিরাত তারা যুক্তরাষ্ট্রের যে স্যাংশন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে যে নিষেধাজ্ঞা, তাতে শামিল হয়নি। সৌদি আরব ওপেক ছাড়াও মস্কোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষা করেছে। ওয়াশিংটনের পরামর্শ সেখানে তারা মানেনি। চীন গালফ এলাকায় একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছে।

ইসরাইল ফিলিস্তিনের সংঘাতে ভারতের অবস্থান হলো, বৃহৎ শান্তির স্ফটিকে ভারত বিষয়টা দেখতে চায় এবং পশ্চিম এশিয়ায় স্থায়িত্ব চায়। সেই কারণে পশ্চিম এশিয়ার অনেক রাষ্ট্র হামাস ও হিজবুল্লাহকে সমর্থন করে। ভারত এক্ষেত্রে টু স্টেট সলিউশনের পক্ষে। একটা স্বাধীন-সার্বভৌম কার্যকর ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন হোক, ভারত সেটা চায়। পাশাপাশি ইসরাইলেও যাতে শান্তি স্থাপিত হয়। সমগ্র বিশ্বের সকল শান্তিপ্রিয় মানুষের মতো আমরাও চাই, সকল প্রকার ভূরাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে ফিলিস্তিন সত্যিকার অর্থেই স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হোক।

লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

শেয়ার করুন