বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৩৬ দিনের মাথায় সরকার থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার পতনের মুহূর্তেই বিজয় উদযাপনের উল্লাসে অন্য এক বিভীষিকাময় অধ্যায় শুরু হয়েছিল। ৫ আগস্ট থেকেই দেশজুড়ে আওয়ামী লীগ ও তাদের সমর্থকদের বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় স্থাপনা, হিন্দু সম্প্রদায় এমনকি বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছাত্রদের ওপরেও হামলা চালিয়েছে বিভিন্ন সুযোগ সন্ধানী গোষ্ঠী। তাদের সহিংসতায় শতাধিক মৃত্যুর সংবাদ প্রকাশ করেছে গণমাধ্যম। সেই সঙ্গে প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলার মধ্যে বিএনপিপন্থীদের দখল উৎসব ও চাঁদাবাজি আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোর দখল নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে ছাত্রদল ও শিবির। আওয়ামী লীগের পতন মুহূর্তেই জেলায় জেলায় নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের খবরও পাওয়া গিয়েছে। দেশের বিভিন্ন বার কাউন্সিল দখল নিতেও দেখা যায়। দেশের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত সচিবালয়েও একই দৃশ্য। খবরে প্রকাশ ‘সরকার পতনের পর গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে ঢুকছেন বিএনপিপন্থী কর্মকর্তারা’। একই সঙ্গে ইসলামী ব্যাংক পুনরায় জামায়াত নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে বলেও জানা গিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকেও একই চিত্র। রাষ্ট্র ও সরকারের ক্ষেত্রগুলোয় এভাবে বারবার দলবাজদের দখল ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সঙ্কট দূর হবে না এটা সুস্পষ্ট। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সরকারি অফিসে বিএনপিপন্থী কর্মকর্তাদের জোর করে পদোন্নতির বিষয়টিও শুভ বার্তা বহন করে না। যার ফলে বিএনপি জামায়াত জোট নিয়ে চরম অস্বস্তি দেখা দিয়েছে সব শ্রেণি পেশার মানুষের মাঝে।
দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি ক্ষমতায় যেতে খুবই তৎপর হয়ে উঠেছে। দেশ স্থিতিশীল না হওয়ার পূর্বেই এরা গত ৭ আগস্ট থেকে নিজেদের অস্তিত্ব ও আধিপত্যের জানান দিতে পল্টনসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সভা-সমাবেশ করছে। বিএনপি এমন আচরণ করছে, এই গণ-অভ্যুত্থান যেন তাদের আন্দোলনের ফসল এবং এর একমাত্র অংশীদার তারাই। অনেক ক্ষেত্রে তাদের অশোভন কথাবার্তা, ভাব ও ভঙ্গি প্রমাণ করছে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছাত্র-জনতা ও শহীদেরা মূল্যহীন। নানামুখী সঙ্কটের মধ্যে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের সরকারকে রোড ম্যাপ ঘোষণা ও নির্বাচন নিয়ে চাপ নতুন করে সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। সেই সঙ্গে এই মুহূর্তে বিগত সরকার আমলে ‘রাজনৈতিক’সহ নানা কারণে ‘সুবিধা বঞ্চিত’ দাবিকৃত বিভিন্ন মহলের দাবিদাওয়ার আন্দোলনে বেসামাল বর্তমান সরকার। অদ্ভুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসতেই দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে বন্যায় মানবিক বিপর্যয় নেমে এসেছে। অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ও বন্যা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সকলকে জাতীয় ঐক্য মতে পৌঁছানো প্রয়োজন।
আমরা জানি, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সরকার ও তার বিভিন্ন বাহিনীর নৃশংসতায় এরই মাঝে শত শত মানুষের মৃত্যু হয়েছে। একই সঙ্গে জ্বালাও পোড়াও ভাঙচুরে অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণও কোটির ওপরে। ধানমন্ডি ৩২-এর বঙ্গবন্ধু ভবন ও যাদুঘর, মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর, পুলিশ যাদুঘর, বিভিন্ন ভাস্কর্য, ম্যুরাল ও নান্দনিক শিল্প কর্ম ভাঙচুর, সিনেমা হলে হামলা, অগ্নিসংযোগের ফলে ইতিহাস ঐতিহ্য শিল্প ও সংস্কৃতি আক্রান্ত হয়েছে। এসব ঘটনা দেশে উগ্র ধর্মীয় সন্ত্রাসের উত্থানকেই ইঙ্গিত করে। দেশজুড়ে দেড় হাজার ভাস্কর্য ও শিল্প কর্ম ভাঙচুর, শিশু একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমিতে আক্রমণের ঘটনা কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বিএনপি জামায়াত জোটসহ নানা মহলের এমন মনোভাব দেখে, দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা আশঙ্কা করছেন এই আন্দোলন হয়তো বেহাত হয়ে যাবে। দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ছেলে সোহেল তাজ হতাশা প্রকাশ করে প্রশ্ন তুলেছেন— ‘বিজয় পরবর্তী দেশজুড়ে নানা প্রতিহিংসামূলক কর্মকাণ্ড এবং সুযোগসন্ধানীদের তাণ্ডব দেখে লাখো-কোটি মানুষের মতো আমিও ব্যথিত। এই হত্যাযজ্ঞ আর ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের জন্যই কি ছাত্র-জনতা রাজপথে নেমেছিল?’ তার এই প্রশ্নের উত্তর এই প্রজন্ম ঠিক কীভাবে দিবে তা আমাদের জানা নেই। তার মতে ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি অশ্রদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অবজ্ঞা নিয়েও ভাবতে হবে।
সদ্য গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। এখনও তারা সেভাবে কাজ শুরু করে উঠতে পারেনি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নাজুক হওয়ায় দেশ স্বাভাবিক গতি ফিরে পায়নি। এর মাঝেই পুনরায় শুরু হওয়া গুম খুন, লুটপাট, ডাকাতি, ছিনতাই, দলীয় আধিপত্য জনজীবনে ঘোর সংকট ডেকে আনছে। ব্যবসায়ীরা অনিরাপত্তার দরুন নিজেদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনায় সাহস পাচ্ছে না। রপ্তানি-আমদানিও অনেকাংশে বন্ধ। এমন পরিস্থিতিতে দেশের সকল শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। দেশের আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে তৎপরতা কিছুটা দেখা গেলেও বিএনপি দলীয় লোকজনদের নিয়ন্ত্রণ করতে বেগ পেতে হচ্ছে। অনেকাংশেই তারা নিয়ন্ত্রণহীন। দেশের নানা প্রান্তে জমি দখল, চাঁদাবাজি, নিজেদের মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষ ও আইন বহির্ভূত কর্মকাণ্ডের খবর প্রতিদিনই বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে আসছে। দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে এসবে বিরতে থাকতে বললেও আজীবন বিশৃঙ্খলা এই দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে কোনো শুভ চিন্তা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। দেশের সচেতন নাগরিকমাত্রই শঙ্কা প্রকাশ করছে, বিএনপি জামায়াতসহ তাদের সমমনা দলগুলো যদি প্রতিহিংসার রাজনীতি পরিহার না করে, ধৈর্য না ধরে, সকল সঙ্কট উত্তরণে সরকারকে সহযোগিতা না করে, তাহলে দেশের পরিস্থিতি আরও বেশি খারাপ হবে। সেই সঙ্গে বিএনপির শাসনামলে (বিশেষত ২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত) যে চিত্র দেখা গিয়েছিল, সেই চিত্রের পুনরাবৃত্তি ঘটবে কিনা তা নিয়েও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেকে। প্রশ্ন উঠেছে বিচারবহির্ভূতভাবে এই সরকার কেন গণহারে বিগত সরকার আমলে গ্রেপ্তার অপরাধীদের মুক্তি দিচ্ছে, তা নিয়েও। এই মুক্তিদানে শুধু যে রাজনৈতিক মামলার আসামি রয়েছে এমনটা নয়। বড়ো চিন্তার বিষয় বিভিন্ন দুর্নীতি, খুন এমনকি ব্লগার হত্যাসহ জঙ্গিবাদী সন্ত্রাসীরাও মুক্তি পাচ্ছে। যা জননিরাপত্তার জন্য হুমকি স্বরূপ।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘আমাদের প্রিয় এই সুন্দর ও বিপুল সম্ভাবনাপূর্ণ দেশটিকে আমাদের নিজেদের ও পরবর্তী প্রজন্মের জন্য রক্ষা করা এবং একে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই এখন আমাদের প্রধান কাজ। একটি নতুন পৃথিবী বিনির্মাণে আমাদের তরুণেরা প্রস্তুত। অকারণ সহিংসতা করে সুযোগটি আমরা হারাতে পারি না।’ তার এই আহ্বানে পরিস্থিতি ঠিক কতটা স্থির হবে তা বুঝতে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় তার সরকার যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তা নিয়ে আমরা এখনও পরিষ্কার বার্তা পাইনি। বরং ইতোপূর্বে সরকার পতনের পর যেভাবে বিরোধীদের বিরুদ্ধে গণমামলা দায়ের, গণগ্রেপ্তার শুরু হয়, আপাতত সেই চিত্রই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অনভিপ্রেত ঘটনা এই যে, আসামিদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিতেও পাচ্ছে না এই সরকার। ফলে আদালত প্রাঙ্গণে আসামিদের শারীরিক ও মানসিকভাবে আক্রমণ করতে দেখা গিয়েছে। যা আমাদের আইন ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
এটা খুবই সুস্পষ্ট হচ্ছে যে, এ দেশের তরুণরা জামায়াত-বিএনপি ও ধর্মপন্থী দলগুলোকে গ্রহণ করতে চাচ্ছে না। কিন্তু বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়করা জামায়াত বিএনপিকে নিয়ে সিংহভাগ তরুণের মতামত কতটা আমলে নিচ্ছে, তা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। সমন্বয়কেরা যদি সংখ্যাগরিষ্ঠের চাওয়াকে গুরুত্ব না দিয়ে বিএনপি জামায়াতে গা ভাসিয়ে দেয়, তাহলে তা পুরো জাতির সঙ্গেই বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে। এই বিশ্বাসঘাতকতা পুনরায় সহিংসতা সংঘাত প্রাণহানি ঘটালে এই আন্দোলনকে একটি ব্যর্থ আন্দোলন বলে অভিহিত হবে। কেননা অর্থলোলুপ ক্ষমতা কাঠামোয় পুরো সমাজই এখন অনিয়ম-অনাচারে পথভ্রষ্ট। সেই সঙ্গে মেকি নেতৃত্বের ভেক ধরা অরুচির বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টিসহ সব দলই একই দোষে দুষ্ট এবং ক্ষমতায় পৌঁছলেই তারা স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস এই চিত্রের বাইরে নয়। তাই নতুন এই বাংলাদেশ গণমানুষের প্রত্যাশা বিগত শাসকদের বাইরে, তারুণ্যের নেতৃত্বে নতুন কেউ আসুক। নতুনের হাত ধরে নব অভিযাত্রা চায় ছাত্রসমাজ।
বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই দেশের শাসনব্যবস্থা বারবার স্বৈরাচারী মনোভাবের শাসকদের হাতে করায়ত্ত হয়েছিল। এর পরিণামও ছিল করুণ। রাষ্ট্র্র কাঠামোকে দুর্বল করে তুলেছিল তারা। শাসনের বৈকল্য, রাজনৈতিক ভ্রষ্টাচার, নীতি-নৈতিকতার অবক্ষয়ে দালাল-লেহন-তোষণের রাজনৈতিক উত্থান ঘটেছিল দেশে। লাগামহীন দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন, অসীম বৈষম্য, শোষণতন্ত্র এবং শিক্ষার অপরিণামদর্শিতায় সংস্কৃতির মনোবৈকল্য সমাজে সংকট তৈরি করেছে বারবার। দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক ও সংস্কৃতিগত সঙ্কট কাটিয়ে তুলতে ঘুনেধরা পুরনো শাসন কাঠামোই শুধু সংস্কার করা প্রয়োজন নয়, দরকার পুরোনো ফ্যাসিস্ট শাসকদেরকেই পুরো রাষ্ট্র কাঠামো থেকে দূরে রাখা। রাষ্ট্রকে পরিবার ও ধর্মতন্ত্র থেকে রক্ষা করতে দরকার Social Democracy। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের সমন্বয়ে নতুন রাষ্ট্রনীতি ও শাসনতন্ত্র। তরুণরা এটা নিয়ে ভাববেন এমন প্রত্যাশা আমাদের। আমরা চাই না বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টি কিংবা কোনো তথাকথিত ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক শক্তি রাষ্ট্র ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করুক। এদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোই এখন সবচেয়ে বড়ো বিপ্লব। এই বিপ্লবে যদি জয়ী না হওয়া যায়, তাহলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না বরং বাংলাদেশকে অনিশ্চিত এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত দেউলিয়া দেশের দিকে ঠেলে দিবে।
লেখক : কবি