গণতন্ত্র, সরকার এবং গণস্বর—এই তিনটি শব্দের মধ্যে একটি নিবিড় যোগসূত্র রয়েছে। বলতে গেলে একটি আরেকটির পরিপূরক। গণতন্ত্র সঠিক পথে চললে সরকার সঠিক পথেই চলে। আর যে জনগণ এই দুটি সৃষ্টি করে, তারাও ভালো থাকে।
ব্যত্যয় ঘটলে জনগণ প্রতিবাদী হয়, গণস্বর ভয়াল রূপ ধারণ করে। সেই স্বরের প্রবল কাঁপুনি সরকারকে তছনছ করে দেয়, গণতন্ত্রকে জাগ্রত করে। এক অদ্ভুত সমীকরণে এই তিনটি শব্দ সম্পর্কিত। তাই একটি রাষ্ট্রের কাছে এই শব্দ তিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
গণস্বর প্রতিফলিত হয়ে থাকে গণতন্ত্র এবং সরকার নামক দুটি প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বে। ভোট, সংসদ, মন্ত্রিসভা, সবই তো গণস্বরেরই ফসল। তবে কোনো দেশে গণতান্ত্রিক চর্চা না থাকলে সেখানে গণস্বরকে মূল্যায়ন করা হয় না, দাবিয়ে রাখা হয়। আর যে দেশে গণস্বরকে দাবিয়ে রাখা হয়, সেখানে গণতন্ত্র শক্তিশালী হওয়া তো দূরের কথা, বরং অগণতান্ত্রিক শক্তি শিকড় গেড়ে বসে।
তবে যেকোনো সময় যে সেই স্বর বড় রকমের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ক্ষমতায় থাকা অপশক্তিকে উত্খাত করতে পারে তার অনেক উদাহরণই এই বিশ্বে খুঁজে পাওয়া যাবে। এই বাংলাদেশেও তেমনি অপশক্তির কোনো আসা-যাওয়া যে ঘটেনি, তা নয়। কিন্তু গণস্বরের তীব্র জোয়ারের কাছে সেসব অপশক্তিকে মাথা নোয়াতে হয়েছে।
গণতন্ত্র তখনই অর্থবহ হবে, যখন তা উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করার মাধ্যমে মানুষের মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে। কাগজে-কলমে থাকা গণতন্ত্রের অস্তিত্ব মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা সামাজিক জীবনে পরিবর্তন ঘটাতে পারে না।
এসব ক্ষেত্রে পরিবর্তন ঘটাতে হলে বাস্তবিক গণতন্ত্র বিদ্যমান থাকা আবশ্যক। প্রথম ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদের হয়তো সুবিধা হতে পারে, যা এক ধরনের ধোঁকা ছাড়া কিছুই নয়। আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদরা দেশ ও মানুষের কল্যাণে গণতন্ত্রকে ব্যবহার করার সুযোগ পেয়ে থাকেন। আবার এই দুয়ের মিশ্রণে এক মাঝামাঝি ধরনের অবস্থায়ও যে অনেক দেশে গণতন্ত্র বেঁচে আছে। পৃথিবীজুড়েই এর উদাহরণ রয়েছে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীতে গণতন্ত্র বিভিন্ন অবয়বে বিকাশ লাভ করছে। তাইতো কোনো কোনো দেশে পূর্ণ গণতন্ত্রের কাছাকাছি গণতান্ত্রিক চর্চা দেখতে পাওয়া যায়। কোথাও আবার গণতন্ত্রের খুঁটি মজবুত হতে শুরু করেছে। কিছু দেশ আছে, যেখানে গণতন্ত্রের নামে চলছে ধোঁকাবাজি। আবার কিছু দেশে গণতন্ত্রের যাত্রা সবে শুরু হয়েছে। তবে গণতন্ত্রের ব্যাখ্যা যে যার সুবিধামতো দিতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। আসলে আমরা গণতন্ত্রকে একেক দেশে একেক রূপে দেখতে পাই। গণতন্ত্র ‘বহুরূপী’ হয়েই হয়তো আমাদের সমাজে গণতন্ত্রের বিভিন্ন স্বাদ দিয়ে যাবে। তবে গণতন্ত্রকে যদি কেউ দল বা ব্যক্তিতন্ত্রের পোশাক পরিয়ে চলাফেরা করতে শেখায়, তখন সেই দেশ থেকে গণতন্ত্র ধীরে ধীরে পালিয়ে যায়, একনায়কতন্ত্র বা স্বৈরাচারের প্রতিষ্ঠা ঘটে। হয়তো কোনো এক সময় ওই অবস্থারও পরিবর্তন ঘটে, জনগণের শাসন ফিরে আসে।
গণতন্ত্রের শুরু, অস্তিত্ব এবং বিকাশ—এসবের ইতিহাস অনেকেই খুব ভালো করে জানেন। তবে আমাদের দেশে গণতন্ত্রের ধারক এবং বাহক যাঁরা তাঁদের কয়জন এসব বিষয়ের খোঁজখবর রাখেন বা এ সম্পর্কিত অর্জিত জ্ঞান নিজের ক্ষেত্রে কাজে প্রয়োগ করেন, তা আমার জানা নেই। কারণ অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, তাঁদের কাছে গণতন্ত্র তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। গণতন্ত্রের চর্চা শুধু জনগণের মধ্যে থাকলেই হবে না, রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরেও গণতান্ত্রিক চর্চা থাকা আবশ্যক। একজন রাজনৈতিক কর্মী একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্যে অবস্থান করে ধীরে ধীরে উচ্চতর ধাপে উঠে আসবেন, তাঁর মনমানসিকতা আর চিন্তা-চেতনায় গণতন্ত্রের ভিত্তি দৃঢ়তর হবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, দূরদৃষ্টি এবং নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা পরিপক্বতা লাভ করবে। ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব গড়ে তোলার জন্য প্রতিটি দলেই এ ধরনের ব্যবস্থা থাকা দরকার। এর ফলে আমরা তিনভাবে উপকৃত হতে পারি; যেমন—ধারাবাহিক নেতৃত্ব সৃষ্টি, গণতন্ত্রের বিকাশ এবং দেশের উন্নয়ন। আর এ ধরনের চর্চা না থাকলে যেকোনো সময়ই দলে নেতৃত্ব সংকট দেখা দিতে পারে।
আমরা জানি, গণতন্ত্র বলতে জনগণের বা সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনকে বোঝায়। গণতন্ত্র হচ্ছে এমন একটি সরকার, যেখানে জনগণ সরাসরি ক্ষমতা ব্যবহার করে অর্থাৎ তাদের মধ্য থেকে প্রতিনিধি নির্বাচিত করে সরকার পরিচালনার জন্য। সংগত কারণেই ওই প্রতিনিধিরা জনগণের স্বার্থ সংরক্ষণ করবেন, তাদের কল্যাণ ও উন্নয়নের কথা চিন্তা করবেন। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে অনেক সময়ই আমরা ওই দৃশ্যটি দেখতে পাই না। এমনকি অনেক প্রতিনিধিই জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বীয় স্বার্থ চরিতার্থ করায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এ অবস্থা গণতন্ত্রের মূল উদ্দেশ্যকেই ব্যাহত করে, যা গণতন্ত্রমনা কারো কাম্য হতে পারে না।
অনেকের মতে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় চারটি মুখ্য বিষয় থাকা জরুরি; যেমন—মুক্ত এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পছন্দ বা প্রতিস্থাপন করার একটি রাজনৈতিক পদ্ধতি; নাগরিক হিসেবে জনগণের রাজনীতিতে কার্যকর অংশগ্রহণের সুযোগ; রাজনীতিতে ও সামাজিক জীবনে সব নাগরিকের মানবাধিকার নিশ্চিতকরণ এবং রাষ্ট্রে এমন এক আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত থাকবে, যেখানে সব নাগরিকের জন্য আইন ও পদ্ধতি সমানভাবে প্রয়োগ হবে। কোনো রাষ্ট্রের পক্ষেই রাতারাতি এসব অর্জন করা সম্ভব নয়। এ জন্য রাষ্ট্রকে নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। সে ক্ষেত্রে জনগণের ইচ্ছা এবং নেতৃত্বের আন্তরিক ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ কথা সত্যি পৃথিবীর খুব কম রাষ্ট্রেই এই বৈশিষ্ট্যগুলোর পরিপূর্ণ বিকাশ দেখতে পাওয়া যায়।
আমরা প্রায়ই গণতান্ত্রিক অধিকারের কথা বলি, যেগুলোর মধ্যে রয়েছে মত প্রকাশের অধিকার, রাজনৈতিক সভা-মিছিলের বা হরতাল-ধর্মঘটের অধিকার, ভোট দেওয়ার অধিকার, শিক্ষা বা স্বাস্থ্যসেবার অধিকার ইত্যাদি। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এসব আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের প্রয়াস অবশ্যই থাকতে হবে। তবে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থাই নির্ধারণ করবে কিভাবে কখন কতটুকু পূরণ করা যাবে। গণতান্ত্রিক সরকার যেহেতু জনকল্যাণমুখী নীতি নির্ধারণ এবং পরিকল্পনার বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুবদ্ধ, তাই রাষ্ট্রের সম্পদের মধ্যেই এসব অধিকার সীমাবদ্ধ রাখতে হয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ব্যক্তিমাত্রই জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। আর জনগণকেও রাষ্ট্র ও সরকারের সীমাবদ্ধতার বিষয়টি বিবেচনায় আনতে হবে। জনগণ ও সরকারের যৌথ সহযোগিতা এবং সহমর্মিতায় দেশের উন্নয়ন অনেক সহজ ও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে।
গণতন্ত্র সহনশীলতার শিক্ষা দেয়। বাংলাদেশে রাজনীতির সঙ্গে জড়িতদের কয়জনের মধ্যে এই গুণটি দেখতে পাওয়া যায়? বিপরীত চিত্রটির দেখা চোখ বন্ধ করলেই পাওয়া যায়। এই সহনশীলতা যেমন পরিবারের সদস্যদের প্রতি, তেমনি সমাজের প্রতিটি মানুষের প্রতি থাকতে হবে। শুধু নিজের দলীয় লোকজনের প্রতি সহনশীল হলেই হবে না, বিরোধী দলের লোকজনের প্রতিও সহনশীলতা দেখাতে হবে। সর্বোপরি রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি জনগণেরও সহনশীল হওয়া আবশ্যক। কারণ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহনশীলতা না থাকলে গণতন্ত্র টেকসই হয় না, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বিকশিত হয় না। দিনশেষে হিসাব মেলালে দেখা যাবে, সহনশীলতা একজন রাজনীতিবিদকে যেমন সম্মান ও শ্রদ্ধার আসনে বসাতে পারে, তেমনি জনগণেরও রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের ওপর আস্থার ভিত্তি মজবুত হয়।
তবে গণতান্ত্রিক অধিকারের নামে কেউ অপরাজনীতির আশ্রয় নিয়ে ধ্বংসাত্মক কাজকর্মে লিপ্ত হবে, এটি দেশের মানুষ কিছুতেই আশা করে না। আসলে নিজের গণতান্ত্রিক অধিকার ফলাতে গিয়ে আরেকজনের অধিকারকে বিঘ্নিত করাকে নিশ্চয়ই সুষ্ঠু রাজনীতি করা বা গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা করা বলে না। এতে গণতন্ত্র বিকশিত হয় না, বরং গণতন্ত্রকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাওয়া হয়। একে অরাজকতা সৃষ্টি করার মাধ্যমে জনজীবনকে দুর্বিষহ করে তোলা এবং দেশের উন্নয়ন ধারাকে বাধাগ্রস্ত করা বলে। যারা এসব করে, তারা কিছুতেই দেশের এবং মানুষের শুভাকাঙ্ক্ষী হতে পারে না। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, শেষ অস্ত্রটি কিন্তু জনগণেরই হাতে। আর জনস্বর যখন জনরোষে পরিণত হয়, তখন গণতন্ত্রই ফিরে আসে, জনগণের সরকারই প্রতিষ্ঠিত হয়।
লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সচিব