মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেছেন গাজা যুদ্ধবিরতি এবং জিম্মি চুক্তির ৯০ শতাংশ শর্তাদি নিষ্পত্তি করা হয়েছে। একই সঙ্গে ইসরায়েল এবং হামাস উভয়কেই অবশিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একমত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
বৃহস্পতিবার (৫ সেপ্টেম্বর) হাইতিতে এক সংবাদ সম্মেলনে ব্লিঙ্কেন বলেন, ‘আমি যা দেখেছি তার ওপর ভিত্তি করে আমি মনে করি, ৯০ শতাংশ শর্তাদিতে উভয়পক্ষ সম্মত হয়েছে, কিন্তু কিছু জটিল সমস্যা রয়েছে। এই মুহুর্তে আমার কাছে মনে হচ্ছে, এই অবশিষ্ট ইস্যুতে সম্মত হওয়া উভয় পক্ষেরই দায়িত্ব।’
মার্কিন, মিশর এবং কাতারের মধ্যস্ততাকারীরা উভয় পক্ষের (ইসরায়েল ও হামাস) সঙ্গে ‘সক্রিয় আলোচনা’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ফিলাডেলফি করিডোরসহ অবশিষ্ট বিতর্কিত বিষয় এবং জিম্মি ও বন্দিদের কীভাবে বিনিময় করা হয় সে সম্পর্কে সাম্প্রতিক দিনগুলোতে আলোচনা করা হয়েছে।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমি আশা করি সামনের দিনগুলোতে আমরা ইসরায়েল ও হামাসের সঙ্গে আমাদের চিন্তাভাবনা নিয়ে আলোচনা করবে, যাতে ঠিক কীভাবে অবশিষ্ট প্রশ্নগুলো সমাধান করা যায়। তারপর উভয় পক্ষের কাছে একটি পথ খোলা থাকবে— “হ্যাঁ অথবা না” সিদ্ধান্ত নিন।’
প্রসঙ্গত, অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় একটি যুদ্ধবিরতি এবং জিম্মি-মুক্তি বিষয়ক চুক্তির জন্য চাপ দিতে গত মাসের শেষের দিকে ইসরায়েলে যান ব্লিঙ্কেন। গাজা যুদ্ধ শুরুর পর ব্লিঙ্কেনের এটি নবম ইসরায়েল সফর।
সে সময় ইসরায়েলি প্রেসিডেন্ট আইজ্যাক হারজোগের সঙ্গে বৈঠকে ব্লিঙ্কেন জোর দিয়ে বলেছেন, চলমান আলোচনা যুদ্ধবিরতি এবং জিম্মি মুক্তির জন্য একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর সম্ভবত শেষ সুযোগ।
তিনি বলেন, ‘এটি একটি অতন্ত গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত- জিম্মিদের মুক্তি, যুদ্ধবিরতি এবং স্থায়ী শান্তি ও সকলের নিরাপত্তার জন্য একটি চুক্তিতে যাওয়ার সম্ভবত এটি সেরা এবং সম্ভবত শেষ সুযোগ।’
ব্লিঙ্কেনের এই সফরের কিছুদিন আগেই ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যকার বৈরিতা ও ব্যবধান দীর্ঘমেয়াদে স্থায়ীভাবে দূর করার লক্ষ্যে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিছুটা পরিবর্তিত নমনীয় এক প্রস্তাব উপস্থাপন করেছিলেন। মূলত তারপর থেকেই যুদ্ধবিরতির বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র একটি চুক্তির ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করে আসছে। যদিও যুদ্ধবিরতির বিষয়ে দৃশ্যমান তেমন কোনো অগ্রগতি নেই বলে জানিয়েছে হামাস।
হামাস জোর দিয়ে বলেছে, গাজা উপত্যকা থেকে ইসরায়েলি সৈন্যদের পুরোপুরি প্রত্যাহার করা হবে কি-না, সেটি নিয়ে এখনও চুড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। সব মিলিয়ে যুদ্ধবিরতির যে চুক্তির কথা বলা হচ্ছে, সেটি একটি ‘ভ্রম’ বলে মন্তব্য করেছে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠীটি।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র আশা করছে, আগামী সপ্তাহের মধ্যেই হয়ত যুদ্ধবিরতির বিষয়ে কার্যকর একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হবে। যদিও ইসরায়েল ও হামাস, কোনো পক্ষই তেমন কিছুরই আভাস দেয়নি। উল্টো, যুদ্ধবিরতি না হওয়ার কারণ হিসেবে এখনও তারা একে অপরকে দোষারোপ করে চলেছে।
যদিও গত কয়েক মাস ধরেই যুদ্ধবিরতির বিষয়ে নানান আলোচনা শোনা গেছে। বেশ কয়েকবার এ নিয়ে আশার আলো দেখা গেছে বলা হলেও পরবর্তীতে তেমন কিছুই ঘটতে দেখা যায়নি।
গত মে মাসে গাজায় যুদ্ধবিরতির একটি প্রস্তাব তুলে ধরেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন।
সেখানে বলা হয়েছে যে, মোট তিন ধাপে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা হবে, যার প্রথম ধাপ শুরু হবে ছয় সপ্তাহের যুদ্ধবিরতির মধ্য দিয়ে। ওই সময়ে গাজার জনবহুল এলাকা থেকে ইসরায়েলি সৈন্যদের সরিয়ে নেয়া হবে। দেওয়া হবে মানবিক সহায়তা। একই সঙ্গে, হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে মধ্যে বন্দী এবং জিম্মি বিনিময় হবে বলেও প্রস্তাবে বলা হয়।
যুদ্ধবিরতির ওই প্রস্তাবে ইসরায়েল রাজি হবে বলে যুক্তরাষ্ট্র আশাবাদ ব্যক্ত করছিল। কিন্তু পরে দেখা যায়, ইসরায়েলের মন্ত্রিসভার কয়েক জন সদস্য প্রস্তাবটির বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।
উল্লেখ্য, গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে নজিরবিহীন হামলা চালায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস। এদিন ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলীয় ইরেজ সীমান্ত দিয়ে ইসরায়েলে প্রবেশ করে অতর্কিত হামলা চালায় হামাস যোদ্ধারা। পাশাপাশি ইসরায়েল থেকে প্রায় ২৪০ জনকে জিম্মি হিসেবে গাজায় নিয়ে যায় হামাস।
তারপর ওই দিন থেকেই গাজায় অভিযান শুরু করে ইসরায়েলি বিমানবাহিনী। পরে ২৮ অক্টোবর থেকে অভিযানে যোগ দেয় স্থল বাহিনীও। প্রায় ১১ মাস ধরে ইসরায়েলি হামলায় গাজায় ৪০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ৭০ শতাংশেরও বেশি নারী ও শিশু। এছাড়া আহত হয়েছেন ৯৪ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি।
গত বছরের নভেম্বরে কাতারের মধ্যস্থতায় প্রথমবারের মতো যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয় হামাস ও ইসরায়েল। এক সপ্তাহব্যাপী যুদ্ধবিরতিতে ইসরায়েলি কারাগার থেকে ২৪০ ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল, যার মধ্যে ৭১ জন মহিলা এবং ১৬৯টি শিশু রয়েছে। বিনিময়ে ২৪ বিদেশিসহ মোট ১০৫ জনকে মুক্তি দিয়েছে হামাস। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে গাজা থেকে বেশ কয়েজন জিম্মির মরদেহ উদ্ধার করেছে ইসরায়েল। সর্বশেষ হামাসের কাছে এখনো প্রায় ১০১ জন জিম্মি রয়েছে বলে দাবি ইসরায়েলের।
অন্যদিকে ইসরায়েলে বর্তমানে অন্তত সাড়ে ৯ হাজার ফিলিস্তিনি বন্দি রয়েছে।
সূত্র: আনাদোলু