জাতীয় সংগীত নিয়ে অহেতুক বিতর্ক কাম্য নয়

সম্পাদকীয়

অঙ্কন : মিতা মেহেদী (সংগৃহীত)

জাতীয় সংগীত যেকোনো স্বাধীন দেশের পরিচয়, ইতিহাস এবং জাতির গভীর আবেগের প্রতীক। জাতীয় সংগীত শুধুই একটি গান নয়, এটি একটি দেশের নাগরিকদের ঐক্যবদ্ধ করার জন্য, তাদের গৌরবময় অতীতকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য এবং ভবিষ্যতের পথে চলার প্রেরণা দেওয়ার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

সম্প্রতি জাতীয় সংগীত নিয়ে একটি তর্কের শুরু হয়েছে। সুশীলদের অনেককেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এটিকে ‘কুতর্ক’ আখ্যা দিয়ে এ নিয়ে কথা বলাটাই অবান্তর বলে উড়িয়ে  দিচ্ছেন। আবার অনেকেই এটিকে ‘কুতর্ক’ বলে উড়িয়ে দিতে নারাজ। বরং কেউ কেউ  সংবাদ সম্মেলন ডেকে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতকে ‘স্বাধীনতার অস্তিত্বের পরিপন্থি’ আখ্যা দিচ্ছেন। কেউ-বা বাহাত্তরের সংবিধান ‘বৈধ নয়’ মন্তব্য করে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করারও দাবি জানাচ্ছেন, প্রশ্ন তুলছেন ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়েও!

যতদূর জানা যায়, বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের লক্ষ্যে এর আগেও একাধিকবার  উদ্যোগ নিয়েছেন অনেকে। জানা যায়, প্রথমে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর খন্দকার মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতির পদে বসে জাতীয় সংগীত পরিবর্তনে কমিটি গঠন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. দ্বীন মুহাম্মদকে চেয়ারম্যান করে গঠিত সেই কমিটি কাজী নজরুল ইসলামের ‘চল চল চল’, ফররুখ আহমদের ‘পাঞ্জেরি’ কবিতাকে জাতীয় সংগীত করার প্রস্তাব দেয়। ১৯৭৯ সালের ৩০ এপ্রিলে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে ‘প্রথম বাংলাদেশ, আমার শেষ বাংলাদেশ’ গানটিকে জাতীয় সংগীত করতে প্রস্তাব করা হয়। মোশতাকের সরকার পাল্টা ক্যু ও জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ায় সেসব প্রস্তাব বাস্তবায়ন হয়নি। আর ২০০২ সালে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে তখনকার দুই মন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মুজাহিদ জাতীয় সংগীত পরিবর্তনে যৌথ সুপারিশপত্র প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দিলেও তখনকার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া প্রস্তাবটি পরে আমলে নেননি বলে বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশ। আবার ২০২৪ সালে জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের জন্য অহেতুক বিতর্ক শুরু হয়েছে; যা দেশ ও জাতির জন্য কোনো সুফল বয়ে আনবে না বলেই মনে করি।

বাংলাদেশ মানে, আমাদের কাছে ভালোবাসার অন্য নাম। বাংলার প্রাণ-প্রকৃতি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, মুক্তিসংগ্রাম আর ভাষার প্রতি ভালোবাসা। বাঙালির এই স্বজাত্যবোধ ও স্বাদেশিকতার মূর্ত প্রতীক তার একান্ত নিজস্ব আবাসভূমি বাংলাদেশের হৃদয়গ্রাহী জাতীয় সংগীত- ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’। বিশ্বের যেকোনো জাতিগোষ্ঠী তার আত্মপরিচয়ের প্রধানতম অনুষঙ্গ জাতীয় সংগীত নিয়ে গর্ব অনুভব করবে, শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে চাইবে সেটাই যৌক্তিক, ন্যায়সংগত। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আত্মবিস্মৃত বাঙালি জাতির পক্ষেই সম্ভব স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও নিজেদের জাতীয় সংগীত নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হওয়া, শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে সন্দিহান হওয়া অবশ্যই দুঃখজনক।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত স্বদেশ পর্যায়ের গানগুলোর মধ্যে অনন্যসাধারণ ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’—এর প্রথম দশ চরণ আমাদের জাতীয় সংগীত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৫৩-৫৪ শিক্ষাবর্ষের কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদের অভিষেকসহ অন্যান্য নানা অনুষ্ঠানে গানটি বারবার গীত হয়েছে সার্বিক মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে বাঙালির প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে। ১৯৭০ সালে জহির রায়হান নির্মাণ করেন ‘জীবন থেকে নেয়া’। এ সিনেমায় ব্যবহৃত পাঁচটি গানের একটি ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। প্রকৃতপক্ষে তারও আগে থেকে একুশের প্রভাত ফেরির অন্যতম গান হয়ে ওঠেছিল এটি। জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ পূর্ব বাংলার মানুষের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে প্রতীকায়িত করেছিল এবং এ সিনেমায় গানটির ব্যবহার তাই বিশেষ মাত্রা পায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালের ২৮ জুন কুড়িগ্রামের রৌমারী ট্রেনিং ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের গাওয়া ‘আমার সোনার বাংলা’র ভিডিও আমাদের প্রাণে শিহরণ জাগায় এখনও।

আরেকটু পেছন ফিরে তাকালে- ১৯৬৯ সালের উত্তাল গণ-অভ্যুত্থানের কাল পেরিয়ে ’৭০-এর নির্বাচন ও ’৭১-এ মুক্তিসংগ্রামের ব্রত নিয়ে সংগঠিত ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ’৭১-এর ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের ক্যান্টিনে জাতীয় সংগীত সংক্রান্ত আলোচনায় সর্বসম্মতিক্রমে গানটিকে জাতীয় সংগীত হিসেবে নির্ধারণের প্রস্তাব গ্রহণ করে। জাতীয় নেতারা বিষয়টিতে সম্মতি দিলে ঢাকায় ৩ মার্চ অনুষ্ঠিত প্রতিবাদী জনসভায় এবং ৭ মার্চ রেসকোর্সের ঐতিহাসিক জনসভায় গানটি গীত হয়। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ২৫ মার্চের কালরাত ও ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পর মুজিবনগর সরকার গানটিকে জাতীয় সংগীতের মর্যাদা দেয়। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের সূচনা হয় জাতীয় সংগীত বাজিয়ে। সেদিন থেকে গানটি বাঙালির একান্ত আপনার। তার আত্মপরিচয়ের মূলমন্ত্র;  আত্মচেতনার হাতিয়ার। আর এক সাগর রক্তের পিচ্ছিল পথ পেরিয়ে পাওয়া ’৭২-এর সংবিধানে অন্তভুর্ক্তির মধ্য দিয়ে জাতীয় সংগীত পায় সুসংহত ভিত্তি।

গানটি এতটাই আধুনিক যে তার অন্তর্নিহিত বাণী অসাম্প্রদায়িক, ধর্ম, বর্ণ, জাতি, লিঙ্গ, উচতা—নিচতার প্রভাবমুক্ত। শুধুমাত্র মা আর সন্তানের অপত্য স্নেহের গল্প। প্রকৃতি আর বাঙালির নাড়িছেঁড়া সম্পর্কের ইতিবৃত্ত। বাঙালির মিলন-বিচ্ছেদ, প্রেম-বিরহ, আনন্দ-যন্ত্রণা, চেতনা-দ্যোতনা লুকায়িত আছে এ সুরের প্রবাহে। আমরা বিশ্বাস করি, এ গানের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ইতিহাস, বাণী আর সুর একটি চেতনাকেই উর্ধ্বে তুলে ধরে তা হলো অসাম্প্রদায়িক বাংলার চেতনা। তাই চলতি পরিস্থিতিতে জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের আলোচনাকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে আমাদের। আমার মনে হয়, পুরোনো তর্ককে সামনে এনে আবারও আমাদেরকে পরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাই জোর প্রতিবাদ জারি রাখতে হবে। সেই সঙ্গে সমাপ্তি ঘটুক অহেতুক বিতর্কের। স্বাধীন বাংলাদেশের সমান্তরালে জাতীয় সংগীত হিসেবে টিকে থাকুক- ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি…।’

শেয়ার করুন