জনতার আন্দোলন-সংগ্রামই ইতিহাসের জন্ম দেয়, আর রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হলো সেই ইতিহাসের অন্যতম প্রধান মৌলিক বাহন। সাধারণ মানুষের মনোজগতের চিন্তা, চেতনা, আকাঙ্ক্ষা এবং স্বপ্ন দিয়ে তৈরি যে রাজনৈতিক দল তার ভাষা আপামর জনসাধারণেরই প্রতিধ্বনি। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তেমনি একটি রাজনৈতিক সংগঠন যেটি গড়ে উঠেছিল মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, সৈয়দ শামসুল হক ও রাষ্ট্রপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে। এই দলটি নেতৃত্ব দিয়েছে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬২’র ছাত্র আন্দোলন, ৬৬’র ছয় দফা আন্দোলন, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ৭০’র সাধারণ নির্বাচন, ৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে। স্বাধীনতার পর সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে আওয়ামী লীগের রয়েছে গৌরবময় ইতিহাস। যদিও বিগত কয়েকটি বিতর্কিত নির্বাচনের কারণে দলটির সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইমেজ সংকটে পড়েছেন। বলতে দ্বিধা নেই, ২০২৪ সালে এসে কিছু বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে আওয়ামী লীগের গৌরবগাঁথা অনেকটা ম্লান হলেও ইতিহাসের পাতা থেকে দলটির অবদান কখনোই মুছে ফেলা যাবে না।
প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই আওয়ামী লীগ একটি সংগ্রামী রাজনৈতিক গণসংগঠন। আর তাই এ দলটি সৃষ্টিলগ্ন থেকেই জনগণনির্ভর জাতীয়তাবাদী, দেশপ্রেমিক, নির্ভীক, ত্যাগী, উদার অসাম্প্রদায়িক সুনির্দিষ্ট লক্ষে ধাবমান। এই নিবন্ধে আমি সংগঠনটির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস আপনাদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করব।
১৯৪৯ সালে ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশে চলছিল ম্যালেরিয়ার প্রকোপ, খাদ্যাভাব প্রকট হয়ে উঠেছে। এপ্রিলের শুরু থেকেই ঢাকা শহরে পানির অভাব, নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যের দাম দফায় দফায় বেড়ে যাচ্ছিল, উর্দু রাষ্ট্রভাষার ব্যাপারেও জনরোষ। এ পরিস্থিতিতে ২৩ জুন সকাল ১০টায় কেএম দাশ লেনের বশির সাহেবের রোজ গার্ডেনের বাসভবনে মুসলিম লীগ কর্মী, নেতা এবং অন্যান্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সম্মেলন শুরু হয় অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। সম্মেলনে সভাপতি নির্বাচিত হন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সহ-সভাপতির পদে মনোনীত হলেন আতাউর রহমান খান অ্যাডভোকেট, সাখাওয়াত হোসেন, আলী আহমেদ এমএলএ, আলী আমজাদ খান অ্যাডভোকেট, আবদুল সালাম খান অ্যাডভোকেট। সাধারণ সম্পাদক টাঙ্গাইলের শামসুল হক, যুগ্ম সম্পাদন একজনই ছিলেন তিনি শেখ মুজিবুর রহমান।
আওয়ামী মুসলিম লীগের আত্মপ্রকাশের দিন ১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন উপলক্ষে দলের সাধার সম্পাদক শামসুল হক আওয়ামী লীগের প্রথম ম্যানিফেস্টো পেশ করেন। এটির নাম ছিল ‘মূলদাবি এতে যেসব দাবি উত্থাপন করা হয় সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- ১. ব্যক্তি স্বাধীনতা ২. ধর্মের স্বাধীন ৩. সংখ্যালঘুদের ন্যায্য অধিকার ৪. আইনের চোখে সমতা ৫. মানুষের সমান অধিকার ৬. কাজ কর অধিকার ৭. শিক্ষার অধিকার ৮. স্বাস্থ্যের অধিকার ৯. নারীর অধিকার ১০. দেশ রক্ষার অধিকার ১ বয়স্কদের ভোটাধিকার ১২. বৈদেশিক নীতি, ইসলাম রাষ্ট্র ও কৃষ্টি পুনর্গঠন ১৩. শিল্প বিপ্লব ইত্যািদি।
আওয়ামী লীগের প্রথম ম্যানিফেস্টোটি কৃষি ব্যবস্থা পুনর্গঠন সম্পর্কে যেসব দাবি উত্থাপিত হয়েি তা আজও সমভাবে প্রযোজ্য। যেমন-
১. সমস্ত কর্ষিত ও কৃষি উপযোগী অকর্ষিত জমি কৃষকদের মধ্যে সমভাবে বণ্টন করে দিতে হবে। ২. রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে অবিলম্বে সমবায় ও যৌথ কৃষি প্রথা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ৩. সেচ ব্যবস্থার সুবিধা ও সার প্রস্তুতের পরিকল্পনা তৈরি। ৪. উন্নত ধানের বীজ ও বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ। ৫. সহজ ঋণদান ও কৃষি ঋণ হতে কৃষকদের মুক্তিদান। ৬. ভূমিকর শতকরা ৫০ ভাগ কমানো। ৭. ভূমিকরের পরিবর্তে কৃষি আয়কর বসানো। ৮. খাদ্যশস্য প্রভৃতি জাতীয় ফসলের সর্বনিম্ন ও সর্বউর্ধ্ব দর নির্ধারণ করে দিতে হবে এবং সর্বনিম্ন দর বেঁধে দিতে হবে। ৯. খাদ্যশস্যের ব্যবসা সরকারের হাতে একচেটিয়া থাকা উচিত। ১০. এ ছাড়াও সকল জমি রাষ্ট্রের মালিকানায় নিয়ে আসার কথা বলা হয়। ১১. শিল্প-কলকারখানা ও যানবাহন রাষ্ট্রায়ত্ত করার কথা বলা হয়েছিল।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের নেপথ্যের নায়ক তরুণ আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫৩ সালে আওয়ামী লীগকে পূর্বপাকিস্তানের সকল মানুষের দলে পরিণত করার জন্য অর্থাৎ অসাম্প্রদায়িক দলে রূপদান করার উদ্যোগ নেন মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমান। সেসময় দলটি আওয়ামী মুসলিম লীগের পরিবর্তে আওয়ামী লীগ নাম ধারণ করে সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনের পূর্বে যুক্তফ্রন্ট গঠন করা হয় এবং নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠন করে। তবে ঐ সরকার বেশি দিন দায়িত্ব পালনের সুযোগ পায়নি।
১৯৫৬ সালের ২১ মে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটিতে অভিযোগ তোলা হয়েছিল যে, দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কোনো মন্ত্রী দলের সাংগঠনিক কমিটির দায়িত্ব পালন করতে পারবে না। ১৯৫৬ সালের ২১ মে’তেই যারা যারা মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন তাদের সবাই দলের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে পদত্যাগ করেন। রাষ্ট্রপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৬ সালের ৩১ মে মন্ত্রীদের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। একই সঙ্গে তিনি সাধারণ সম্পাদকের পদেই রয়ে গেলেন। তার ওই সিদ্ধান্ত যে কতটা জরুরি ছিল তা তখন না বোঝা গেলেও স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি মুহূর্তে জাতি উপলব্ধি করেছে।
১৯৫৭ সাল আওয়ামী লীগের জন্য একটি ক্রান্তিলগ্নের বছর। নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে দলের ডানপন্থিদের এবং মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে বামপন্থিদের মধ্যে প্রত্যক্ষ শক্তি পরীক্ষা হয়। ঐতিহাসিক কাগমারি সম্মেলনে দলের ভাসানীপন্থি গ্রুপ দলত্যাগ করে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি নামে নতুন দল গঠনের উদ্যোগ নেন। হঠাৎ করে মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার ফলে একটি বড় রকমের ধাক্কা আসে দলে। জেলা মহকুমা ও থানার শাখা কমিটিগুলোর অনেকেই চলে গেল মওলানা ভাসানীর সঙ্গে। কেউ কেউ আবার ফিরেও এলেন। সাতান্নতেই হাল ধরতে হলো শেখ মুজিবকে, মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব নিলেন। তখন থেকেই মুজিবের আওয়ামী লীগ বলে দলের পরিচিতি লাভ করেছিল।
বামপন্থিদের জোটবদ্ধভাবে দলত্যাগের ফলে আওয়ামী লীগ সম্পূর্ণভাবে আপসবাদী ডানপন্থিদের হাতে চলে যাবে এই আশঙ্কা দেখা দেয়। পূর্ব পাকিস্তানে গণতন্ত্র ও স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায় এবং পাকিস্তানের সামরিক জান্তা তার সুযোগ গ্রহণ করে। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর দেশে মার্শাল ল’ জারি করেন জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা। ২৭ অক্টোবর জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জাকে তাড়িয়ে পাকিস্তাদের সর্বময় ক্ষমতা দখল করে বসেন জেনারেল আইয়ুব খান। আওয়ামী লীগ ও ন্যাপ দু’দলের নেতাদেরই জেলে নিক্ষেপ করা হয়। সেসময় মুচলেকা দিয়ে অনেক নেতা মুক্তি পান। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান মুচলেকা দেননি, তিনি মুক্তি পান ১৯৫৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর।
আইয়ুব খান প্রথমে গণতন্ত্রের ওপর হস্তক্ষেপ করেন। নিজের ক্ষমতাকে সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে মৌলিক গণতন্ত্র নামে তিনি একধরনের নির্বাচন চালু করেছিলেন। আওয়ামী লীগের অনেকেই এ সময় রাজনীতি থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন, আর মুসলিম লীগের তাদের হারানো ক্ষমতা আবার ফিরে পেয়ে অনেক ভালো অবস্থানে ছিল। ক্রমেই এ দেশের বামপন্থী নেতারা আইয়ুব খানের সঙ্গলাভের চেষ্টা করেছিলেন। আইয়ুব খান মওলানা ভাসানীকে জেলে পুরে আবার মুক্তি দিয়ে ধানন্ডির একটা ভবনে নজরবন্দী করে, পরে করাচি নিয়ে গিয়ে রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি হিসেবে চীনে পাঠান ।
বস্তুত, ১৯৫৭ সালেই আওয়ামী লীগে মুজিব-নেতৃত্বের প্রকৃত অভ্যুদয়। কেউ কেউ বলেন, সেসময় মওলানা ভাসানীর সঙ্গে শেখ মুজিবও আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে ন্যাপে যোগ না দেওয়ায় দেশের ক্ষতি হয়েছে। এ কথাটি সঠিক নয়। পরবর্তীকালে ইতিহাস সেটি প্রমাণ করেছে, দলের এবং দেশের সেই ক্রাইসিস মুহূর্তে শেখ মুজিব আওয়ামী লীগ ছেড়ে না গিয়ে বিরাট রাজনৈতিক বিচক্ষণতা দেখিয়েছেন। তিনি দল ছেড়ে ন্যাপে যোগ দিলে আওয়ামী লীগ সম্পূর্ণভাবে ডানপন্থিদের কব্জায় গিয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর সামরিক শাসক ও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা বহুল ব্যবহৃত হয়ে মুসলিম লীগের দশা প্রাপ্ত হতো।
শেখ মুজিব তা হতে দেননি, তার রাজনৈতিক বিচক্ষণতা তাকে রক্ষা করেছে। তিনি আওয়ামী লীগকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী যুগের আপসবাদী রাজনীতির লেগাসি থেকে মুক্ত করে মধ্যবাম রাজনীতির লড়াকু ধারায় নিয়ে আসেন। তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বের দিকে দেশের তরুণ প্রজন্ম প্রবলভাবে আকৃষ্ট হয়। মুজিবের ডাইনামিক নেতৃত্বের কাছে পরাজিত হয়ে প্রবীণ ডানপন্থী নেতারা জোট বেঁধে দল ত্যাগ করেন। আওয়ামী লীগের চরিত্র-বদল ঘটে। বাংলাদেশে যে শিক্ষিত নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির ততদিনে বিপুলভাবে আবির্ভাব ঘটেছে এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্রকাঠামোতে যারা ছিল বৈষম্যপীড়িত ও সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত, আওয়ামী লীগ তাদের লড়াকু প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে।
এই লড়াকু প্রতিষ্ঠানের দেওয়া ৬-দফা ছিল বাঙালির ম্যাগনাকার্টা। এই ৬-দফা দাবি আদায়ের সংগ্রামে নেমে শেখ মুজিব বাঙালির জাতীয় নেতায় পরিণত হন। তিনি শেখ সাহেব থেকে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেন। বিশ্বের ইতিহাসে সম্ভবত এই প্রথম একটি গণতান্ত্রিক, নিয়মতান্ত্রিক দলের নেতৃত্বে একটি সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রাম পরিচালিত হলো। একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের কাঠামো ভেঙে জন্ম নেয় স্বাধীন সার্বভৌম সেকুলার বাংলাদেশ। বিস্ময়করভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে সন্নিবেশ করা হয় জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র এ চারটি রাষ্ট্রীয় মূল আদর্শ। রাষ্ট্রপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন, স্বাধীনতা এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার আস্বাদ উঠতি মধ্যবিত্তের সামনে প্যান্ডোরার বাক্স খুলে দিয়েছে। তারা এখন বাঙালি আদমজী, বাওয়ানি হয়ে উঠতে চায়। লুটেরা নব্যধনী হতে চায়। যদি তাদের বাধা দেওয়া না হয়, তা হলে বাংলাদেশ সন্ত্রাস ও দুর্নীতিময় একটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হবে; তাঁর স্বপ্নের সমাজতান্ত্রিক সোনার বাংলা হবে না। এই সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যেই তিনি বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ গঠন দ্বারা আওয়ামী লীগের চরিত্র আবার সম্পূর্ণ পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন। নব্যধনী, শহুরে সুবিধাভোগী চাটুকার শ্রেণিগুলোর বদলে দলে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থ ও অধিকারকে অগ্রাধিকার দিতে চেয়েছিলেন।
তিনি শোষকদের স্বার্থের প্রহরী পশ্চিমা গণতন্ত্রের বদলে শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। এই শোষিতের গণতন্ত্রে কলোনিয়াল ব্যুরোক্রেসির বদলে তৃণমূল পর্যায়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা, পেশাভিত্তিক বৈষম্য ও শ্রেণিভেদ দূর করা এবং রাষ্ট্রকে কিছুকালের জন্য তথাকথিত বহুদলীয় ব্যবস্থার বদলে সম্মিলিত একটি গণ মোর্চা দ্বারা পরিচালনার প্রাথমিক পদক্ষেপ ছিল। তাঁর এই পদক্ষেপ নেওয়া সফল হয়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশি-বিদেশি চক্রান্তে বাংলাদেশের ভেতরে প্রতিক্রিয়াশীল সামাজিক আর্থিক ধর্মীয় সংস্থাগুলো জোটবদ্ধ হয়। কলোনিয়াল সামরিক ও অসামরিক আমলাচক্র তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়। নব্য ধনী এলিট ক্লাস, সুশীল সমাজ, তাদের মিডিয়া তলে তলে এই চক্রান্তের সঙ্গে হাত মেলায়। ফলে স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র সাড়ে ৩ বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধুসহ জাতীয় ৪ নেতাকে (তাজউদ্দীন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এএইচএম কামরুজ্জামান) নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। বাকশাল- তথা আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হয়। জাহাজ নিমজ্জিত দেখলে ইঁদুর যেমন সকলের আগে জাহাজ ছাড়ে; তেমনি বাকশালকে ক্ষমতাচ্যুত দেখে বামপন্থিরা সর্বাগ্রে বাকশাল ছেড়ে দিয়ে সামরিক শাসকদের কাছে দরখাস্তের রাজনীতিতে দীক্ষা নেন। তাদের কেউ কেউ সামরিক শাসকদের ‘খাল কাটার বিপ্লবে’ গিয়ে অংশ নেন।
এই ভয়ঙ্কর দুঃসময় কাটিয়ে আওয়ামী লীগের আবার সহসা জেগে ওঠার কথা নয়। কিন্তু আওয়ামী লীগ দুঃসময় কাটিয়ে আবার জেগে উঠে এবং জেগে উঠে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। টানা ৪৩ বছর নেতৃত্ব দিয়ে তিনি আওয়ামী লীগকে পাঁচবার রাষ্ট্রক্ষমতায় আনেন এবং দলটি অপ্রতিদ্বন্দ্বী বৃহৎ পার্টিতে পরিণত হয়। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করেছি, টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলের শেষ দিকে এসে তিনি গণনির্ভশীলতার চেয়ে চাটুকার আমলা ও বিভিন্ন সংস্থা নির্ভরশীলতার প্রবণতার দিকে ঝুঁকে পড়েন। দেশে চরিত্রহীন নব্যপুঁজিপতি শ্রেণির অসম্ভব ক্ষমতাশালী হয়ে উঠা ঠেকাতেও তিনি ব্যর্থ হন। ফলাফল সর্বগ্রাসী বিশ্বপুঁজিবাদের ভয়ঙ্কর ঝড়ো বাতাসের মুখে বাংলাদেশে শেখ হাসিনার লড়াইয়ের অবসান। পঁচাত্তর পেরিয়ে ৭৬ বছরে সূচনালগ্নে চরম বিপর্যয়ের মুখে আওয়ামী লীগ। পঁচাত্তরের মতো চব্বিশেও সুবিধাভোগী গোষ্ঠী গিরগিটির মতো নিজেদের অবস্থান পাল্টাতে ব্যতিব্যস্ত।
সবশেষে বলতে চাই, ইতিহাস সাক্ষী- আওয়ামী লীগের বিপর্যয় আছে, ধ্বংস নেই। বরং ধ্বংসের মুখেই আওয়ামী লীগ নতুন করে জেগে ওঠে। তার মধ্যে সংগ্রামী প্রেরণা দেখা দেয়। এই দলটির মূল শক্তি হচ্ছে তৃণমূল (কৃষক, শ্রমিক ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির নাগরিক), যারা এখনও ইস্পাত কঠিন মনোবল নিয়ে লড়াই করতে প্রস্তুত। স্বৈরশাসক আইয়ুব খান থেকে শুরু করে অদ্যাবধি আওয়ামী লীগকে বারবার ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে, কিন্তু কেউ সফল হয়নি। এবারও যারা এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন তারাও ব্যর্থ হবেন। ফিনিক্স পাখির মতো বারবার ধ্বংস স্তুপ থেকে জেগে উঠাই আওয়ামী লীগের ইতিহাস। আমরা সকলেই জানি, আওয়ামী লীগের দীর্ঘ ৭৫ বছরের রাজনৈতিক পথচলায় তার মৌলিক নীতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। এই নীতি বাংলাদেশকে অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় ধরে রাখা। আওয়ামী লীগ তার এই নীতি এবং বাঙালিত্ব নিয়ে আরও বহুকাল বেঁচে থাকবে এবং জাতিকে নেতৃত্বে দেবে।
লেখক: কবি ও সাংবাদিক