উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী: অসাম্প্রদায়িকতার আলোকদূত

মীর রবি

র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী
র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী। ফাইল ছবি

বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়েছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনাবোধের মধ্য দিয়ে। বাঙালি শুধুমাত্র পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শোষণ থেকে রক্ষা পেতে মুক্তিযুদ্ধ করেনি, সাম্প্রদায়িকতা থেকে মুক্তি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাও ছিল এই অঞ্চলের মধ্যবিত্ত শিক্ষিত শ্রেণীর মানুষের অন্যতম প্রধান চাওয়া। বৃটিশ ও বৃটিশ সময়পূর্বে এই অঞ্চলের সাম্প্রদায়িক বিভেদ, বিদ্বেষ ও সংঘাত মানুষকে তার আসল পরিচয় ‘মানুষ’ হতে হিন্দু মুসলিম পরিচয়কে মূখ্য করে তুলেছিল। সেই গৌণ পরিচয় থেকে মানুষ ও বাঙালি পরিচয়ে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিল গণমানুষের জীবন সংগ্রামের মহান আন্দোলন ও প্রতিরোধ ‘মুক্তিযুদ্ধ’। এই মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমেই বাঙালি তার শেকড়ের সন্ধানে ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করে। এই সাংস্কৃতিক লড়াই ১৯৫২ সালে বাঙালির চেতনা জগতে মুক্তির বীজ বপন করেছিল বলেই সম্ভব হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের পেছনে অন্যতম প্রধান কারণগুলোর মধ্যে সাংস্কৃতিক মুক্তিই ছিল বৃহৎ কারণ। সাংস্কৃতিক মুক্তির লড়াইয়ের নেপথ্যে কাজ করেছে বাঙালির চিরায়ত অসাম্প্রদায়িক চেতনাবোধ।

সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান থেকে স্বাধীন স্বার্বভৌম অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন ছিল অপামর ছাত্র-জনতা সকলের। বাংলার হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিস্টানসহ সকলেই ধর্মীয় পরিচয়ের উর্ধ্বে উঠে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। ইতিহাসের এই মানব মুক্তির লড়াইয়ে নিজেকে বঞ্চিত করেননি র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী। মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে। তাঁর মানস চেতনাজুড়ে ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক দর্শন। ছাত্র অবস্থাতেই তিনি বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক চেতনায় উজ্জীবিত হয়েছিলেন। প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনকে বেগবান করতে যুক্ত হয়েছিলেন ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে। যার ফলে ত্যাগী ছাত্রনেতা হিসেবে ১৯৭০ সালে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সম্পাদক হিসেবে পদ পান তিনি।

ছাত্র জীবনেই বাঙালির মুক্তির দর্শনে র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দর্শনে ব্রত হয়েছিলেন। তাঁর অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দর্শনে দীক্ষিত হওয়ার পেছনে ধর্ম সচেতনতাকে মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। তিনি স্পষ্টতই ধর্ম ও ধর্মতন্ত্র যে এক নয়, সে সম্পর্কে শিক্ষা লাভ করেছিলেন সেসময়েই। আলিয়া মাদ্রাসায় পড়ুয়া তরুণ ছাত্র উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর মানবিক চেতনার ভিত্তিই রচিত হয়েছিল ধর্ম পাঠের মধ্য দিয়ে। এজন্যই তিনি ধর্ম ও ধর্মতন্ত্রকে আলাদা করতে পেরেছিলেন, ফলে অসাম্প্রদায়িক চিন্তায় নিজেকে নিমগ্ন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যার ফলে তাঁর রাজনৈতিক সম্পৃক্ততাও হয়েছিল অসাম্প্রদায়িকতায় মহীয়ান। পাকিস্তান আমলের তথাকথিত ইসলামী ভাবধারার কোনো সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে জড়াননি তিনি। বরং নিজেকে উৎসর্গ করেছেন মানুষের রাজনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে, সাম্প্রদায়িক বিভাজনের উর্ধ্বে।

১৯৭১ সালের মে মাসের শেষের দিকে শেখ ফজলুল হক মনি, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ ও সিরাজুল আলম খান– এই চার যুবনেতার উদ্যোগে মুজিব বাহিনী প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই মুজিব বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে তারুণ্যদীপ্ত ছাত্রনেতা উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বিশেষ অপারেশনে গোলাগুলির সময় তিনি গুলিবিদ্ধ হন। তাঁর বাম পা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়। মুক্তিযুদ্ধের এই ক্ষতচিহ্ন তাঁকে আজীবন বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে আমাদের কাছে এটি ক্ষত মনে হলেও তা যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর জন্য গৌরব ও অহংকার। যার অলংকার অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন। সেই স্বপ্নের পথেই তিনি মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে সমানতালে লড়াই জারি রেখেছেন। পবিত্র ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করে যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উত্থান বাংলাদেশে হয়েছে, তা নিয়ে তাঁর মতো প্রতিবাদী ও সুস্পষ্টভাষী তেমন কোনো রাজনৈতিক নেতা এখন আর পাওয়া যায় না।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে অপরাজনীতির সূচনা হয়েছিল। এই সূচনায় সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সংশ্লেষণ রাজনীতিকে শুধু কলুষিতই করেনি, বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূলমন্ত্রকেই ধূলিসাৎ করে দিয়েছিল। যে ক্ষত আজও সারিয়ে তোলা সম্ভব হয়নি। পঁচাত্তরে স্বপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে যে কজন মানুষ সরব ভূমিকা পালন করেছিলেন তাঁদের অন্যতম একজন উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী। বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্নে বিভোর এই মানুষটি বঙ্গবন্ধু হত্যায় শুধু শোকাহতই হননি, সেই সঙ্গে হন্তারকদের প্রতিরোধ করারও শপথ নিয়েছিলেন। দেশব্যাপী গণতান্ত্রিক ছাত্রআন্দোলন ও প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন তিনি। ২০ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিলের নেতৃত্ব দেন উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী। ৪ নভেম্বর ঢাকার রাজপথে প্রথম প্রতিবাদ মিছিলেরও অন্যতম সংগঠকের ভূমিকায় ছিলেন তিনি। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৬ সালের অক্টোবরে তিনি ঘাতকদের মদতপুষ্ট সরকারের বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন। প্রায় ২ বছর কারাবাসের পর ১৯৭৮ সালের সেপ্টেম্বরে মাসে হাইকোর্টের নির্দেশে মুক্তি পান উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রতিরোধ আন্দোলন, দীর্ঘ কারাবাস তাঁকে রাজনৈতিক চেতনায় আরও পরিপক্ক করে তোলে। রাজনৈতিক ধী শক্তির অধিকারী হন তরুণ রাজনৈতিক নেতা উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী।

পঁচাত্তরের পরবর্তী সময় পর্ব থেকেই মেজর জিয়াউর রহমানের রাষ্ট্র ক্ষমতায় আহরণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক চেতনার পুনর্বাসন শুরু হয়। দেশে ফিরতে থাকে পলাতক ধর্মান্ধ ও ধর্ম ব্যবসায়ী রাজনীতিকেরা। বাংলাদেশে আবারও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উত্থান ঘটতে থাকে। স্বাধীনতার চার মূলনীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সংবিধানে জেঁকে বসে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ভূত। এই ভূতকে কখনোই মেনে নিতে পারেননি মোকতাদির চৌধুরী। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী এই মানুষটি সে সময় থেকেই সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছেন। তিনি স্পষ্টভাবেই সবসময় উচ্চারণ করেন, ‘আমরা ধর্ম নিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাস করি। আমরা গণন্ত্রাতিক সমাজে বিশ্বাস করি। আমরা বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামে বিশ্বাস করি। আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করি’। মহান মুক্তিযুদ্ধের এই চেতনাকে মনেপ্রাণে লালন করেন বলেই তিনি বাংলাদেশের সকল সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে যখন হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলা করা হয়, তখন তিনিই এই হামলার প্রতিবাদে নিজের কণ্ঠকে জোরালো করেছিলেন। দলীয় মনোবৃত্তির বাইরে তাঁর অবস্থান ছিল ঘটনার সত্যতায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। হেফাজতের তাণ্ডবের সময়েও তাঁকে সরব হতে দেখা গিয়েছে। তিনি এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে সাম্প্রদায়িকতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। একের পর এক হামলার ঘটনা ঘটছে। নাসিরনগরের সাম্প্রদায়িক তাণ্ডবের বিচার আমরা চেয়েছি, অন্য কেউ বিচার চায়নি। হেফাজতের ঘটনার সময়ও আমরা বিচার চেয়েছি’।

স্পষ্টভাষী রাজনৈতিক নেতা উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর লক্ষ্য মানুষের বাংলাদেশ গড়া। যে দেশ হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানের বাংলাদেশ না, সেটা হবে মানুষের বাংলাদেশ।মধ্যযুগের কবি চন্ডীদাসের ‘সবার উপর মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’ উক্তিকেই জীবন ও কর্মে ধারণ করেছেন তিনি। এই চেতনাবোধ বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকেই পেয়েছিলেন। এ কথা তো ধ্রুব সত্য যে, বাঙালির হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িক ধারায় ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের রূপরেখায় বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে যাঁরা সচেষ্ট, র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী তাঁদের অন্যতম। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে পুরোপুরি ধারণ করে ক্রমাগত নিজেকে গড়ে তুলেছেন তিনি। একটি অসাম্প্রদায়িক, মৌলবাদমুক্ত প্রগতীশীল সমাজ গড়তে আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক নতুন প্রজন্ম সৃষ্টির প্রত্যয়ে তিনি অদম্য।

অসাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী বরাবরই আপসহীন রাজনীতিক। নানা ঘটনা প্রবাহে হেফাজতীরা যখন ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের জানাযার নামাজ না পড়ানোর ঘোষণা দিয়েছিল, সেসময় তিনিই দৃঢ় চিত্তে বলেছিলেন, ‘আমার জানাজার নামাজ তারা পড়াক আমি তা চাইনা। …কোনো মুসলমানের জানাজা নামাজ পড়াতে কোনো মৌলভীর সাহেবের প্রয়োজন নাই। যে কোনো মুসলমান জানাজার নামাজে দাঁড়িয়ে নিয়ত যদি বাংলায়ও করেন, যদি দোয়া না পারেন, তাহলে নামাজে দাঁড়িয়ে বলেন, আমি এই মাইয়াতের ক্ষমা প্রার্থনার জন্য জানাজার নামাজে দাঁড়ালাম তাহলেও হবে। আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বললাম এই কথা।…জানাজার নামাজ নিয়ে আপনারা মাথা ঘামাবেন না। এইখানের (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) মোল্লারা নাকি বলেছেন, ছাত্রলীগের জানাজা নাকি পড়াবেন না। এখানে ছাত্রলীগের যারা আছে তাদের ঘাবড়ানোর কিছু নাই। তোমাদের জানাজার নামাজ তোমার বাবা-ভাই বা প্রয়োজন হলে আমি জানাজা পড়াব। সুতরাং তোমরা জানাজা নিয়ে চিন্তা করবে না’। তাঁর এই বক্তব্যের মাঝে ধর্ম জ্ঞান যেমন সুস্পষ্ট, ঠিক তেমনি সাম্প্রদায়িক ও ধর্ম ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারিও বজ্রকণ্ঠের। ধর্ম জ্ঞান সম্পন্ন মানুষ বলেই তাঁর পক্ষেই এভাবে বলা সম্ভব হয়েছিল। তাঁর ইসলাম ধর্ম সম্পর্কিত জ্ঞান ও সচেতনতা উপলব্ধি করা যায় তাঁর রচিত ‘ইসলাম: সাম্প্রতিক ভাবনা’ বইতে। তিনি এই বইয়ের প্রতিটি প্রবন্ধে নিজের ধর্ম জ্ঞানের বিশুদ্ধতার ছাপ রেখেছেন। দেখিয়েছেন ইসলাম ধর্মের মানবিক দর্শন এবং এই ধর্মকে পুঁজি করে গড়ে ওঠা সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর অমানবিক দর্শন দুই-ই। তিনি চিহ্নিত করেছেন ইসলাম ধর্মের সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ বা জঙ্গি সন্ত্রাসের সম্পর্ক নাই। ইসলাম ধর্মের অপব্যাখ্যা করেই মূলত স্বার্থান্বেষীরা মৌলবাদী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে।

তিনি ‘ইসলাম ও রাজনীতি’ প্রবন্ধে বলেছেন ‘ইসলাম ধর্মের কথা বলে আল্লাহ ও রাসূলের (সা.) আদেশ-নিষেধ অমান্য করা, উপেক্ষা করা বা অপব্যাখ্যা দিয়ে কাজ করা ইসলাম অনুমোদন করে না। যারা ইসলামের নামে বিবাদ-বিসম্বাদ করে, বিভেদ সৃষ্টি করে এবং দলাদলি করে তারা প্রকৃতার্থে ইসলামের দুশমন এবং মোনাফেক। ইসলামকে যারা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য বা ক্ষমতা অর্জনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে তারা যে ইসলাম বিরোধী, আলাহ ও রাসূলের (সা.) আদেশ-নিষেধের আলোকে তা বিচারের দাবি রাখে’।

তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, ‘আমাদের দেশে যারা রাজনীতি ও ক্ষমতার কারণে ইসলামকে টেনে আনে সেসব লোকের কাছে আমাদের জিজ্ঞাসা- কোরআন মজিদে প্রদত্ত আল্লাহর নির্দেশ ও নিয়েধকে তারা কোনভাবে ব্যাখ্যা করবেন? তারা কি অস্বীকার করছেন, না অনুসরণ করেছেন? তারা কি বলবেন যে, ইসলামের নামে বাংলাদেশে যে রাজনীতি চলছে তা শতদলে বিভক্ত কেন? তারা কি বলবেন তাদের কোন দলটি প্রকৃত ও খাঁটি ইসলামপন্থি দল? আদতে ইসলামে রাজনৈতিক দলাদলি ও ক্ষমতার জন্য ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতি করা কতটা কোরআন-সুন্নাহ-সম্মত? ক্ষমতার জন্য রাজনীতি আর রাজ- নীতিতে দলাদলি ও ভিন্নমত পোষণ করা, ভিন্ন ভিন্ন দল করা- এ সবই তো আধুনিক গণতান্ত্রিক রাজনীতির অংশ। এর সঙ্গে ইসলামের সম্পর্ক কতটুকু?’ ইসলাম ধর্মে ভিন্নমত পোষণ করার কোনো সুযোগ নেই।সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে প্রাবন্ধিক উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর প্রশ্নের উত্তর দেওয়া মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক ব্যক্তিদের পক্ষে সম্ভব নয়।

তিনি ‘ইসলামের দৃষ্টিতে সন্ত্রাসবাদ, তথাকথিত ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল, তথাকথিত ইসলামি দলগুলোর ধোঁকাবাজি, জামাতে ইসলামী ও মওদুদী সম্পর্কে আলেম সমাজ, হরতাল ও ইসলাম’ শীর্ষক প্রবন্ধে ইসলাম ও ইসলামকে ব্যবহার করা ধর্মজীবিদের স্বরূপ উন্মোচন করেছেন। দেখিয়েছেন সহজ সরল ধর্ম বিশ্বাসী বাঙালি মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিকে টার্গেট করে অসৎ উদ্দেশ্য হাসিলে প্রতিনিয়ত ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের আখের গুছিয়ে নিচ্ছে। সত্য প্রকাশে নির্ভিক রাজনৈতিক নেতা উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীকে এজন্য কম আক্রমণের শিকার হতে হয়নি। সবসময় তিনি সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছেন নিজের অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। আওয়ামী লীগ নেতা আলাউদ্দিন চৌধুরী নাছিমের মূল্যায়ন এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । তিনি ফেসবুকে লিখেছিলেন, ‘ছোটকাল থেকে ছাত্রলীগের রাজনীতির মাধ্যমে উঠে আসা বিগত ৫৫ বছরে এ দেশের প্রতিটি প্রগতিশীল আন্দোলন-সংগ্রামের সম্মুখযোদ্ধা, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী একজন জীবন্ত কিংবদন্তি।…৭৫-পরবর্তী দুঃসময়ে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ ও ছাত্রলীগ পুনর্গঠনে একজন দক্ষ সাহসী সংগঠক এবং তিনি সারা দেশে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের প্রিয় রবিউল আলম চৌধুরী ছিলেন এক মেধাবী অনলবর্ষী বক্তা। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে উগ্র-সাম্প্রদায়িক হেফাজত বায়তুল মোকাররম থেকে যে সহিংসতা ছড়িয়েছিল, হাটহাজারী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দানবীয় রূপ নিয়ে লাশের রাজনীতি করেছে। রবিউল আলম আপস করেননি বলে এই তালেবানি শক্তি নিজেদের সব সহিংসতার দায় তার ওপর চাপিয়ে দিয়ে বারবার আক্রমণ করেছে’। এই সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই ছিল একার। তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আমি ছাড়াও মন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগের আরও পাঁচজন এমপি আছেন, কেউ হেফাজতিদের বিরুদ্ধে কথা বলছেন না। হেফাজতিদের বিরুদ্ধে শুধু আমি একাই প্রতিদিন ফাইট করছি এবং করে যাব ইনশা আল্লাহ।’ শুধু ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনা নয়, সারাদেশেরই জামায়াত, হেফাজতসহ যে কোনো দলের সাম্প্রদায়িক উস্কানি, হামলা ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন।

বাংলায় অসাম্প্রদায়িক দর্শন চর্চায় অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেছে এদেশের পীর, ফকির, সাধু, সন্ন্যাস ও বাউলেরা। বৈষ্ণব, মরমী ও সহজিয়াদের মাধ্যমে লালিত হয়েছে মানব মিলনের গান। বাউল ফকিরদের কণ্ঠে উঠে এসেছে মানব জাতির মেলবন্ধনের বাণী। এসব বাণী ও গানকে সুর দিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কীর্তিমান সুর সম্রাট আলাউদ্দিন খাঁ। নানা সময়েই সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর আক্রমণের শিকার হয়েছে এই মহান সুর সম্রাটের স্মৃতি চিহ্ন আলাউদ্দিন খাঁ সংগীতাঙ্গন। সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী আলাউদ্দিন খাঁ’র স্মৃতি চিহ্ন রক্ষায় তৎপর হয়েছেন। স্মৃতি সংরক্ষণ ও মানবিকতার চর্চায় তিনি নানা উদ্যোগও গ্রহণ করেছেন। যা সম্ভব হয়েছে তাঁর অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। তাঁর মনন তো তৈরি করে দিয়ে গেছেন আলাউদ্দিন খাঁ’রাই। তিনি তো আলাউদ্দিনেরই ভূমিজ সন্তান। ফলে তাঁর চিন্তা কাঠামোয় মানুষ ভজনার সুর সবসময়ই দীপ্তিমান। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্রাম আজন্ম। বাংলাদেশের প্রগতিশীল রাজনৈতিক আন্দোলনকে সম্মুন্নত রাখতে, মুক্তিযুদ্ধের মূল নীতির বাস্তবায়নে তাঁর সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী অবস্থান ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। এক কথা বলাই যায়, সমাজ ও রাষ্ট্রনৈতিক তত্ত্বে তিনি সফল চিন্তক ও রাজনীতিবিদ। তাঁকে অসাম্প্রদায়িকতার আলোকদূত বলাটা অবান্তর নয়।

লেখক: কবি ও সমাজচিন্তক

শেয়ার করুন