বিধান অনুসারে, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, কোনো অফিসার ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ছাড়াই থানার সীমানার মধ্যে সংঘটিত ঘটনার তদন্ত করতে পারেন। গুরুতর অপরাধ হলে পুলিশকে এজাহারের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। যে কোনোভাবে জানতে পারলে পুলিশ তদন্ত শুরু করতে পারে। পুলিশের তদন্ত বিচারকার্য বলা যায় না এ কারণে যে, পুলিশ সাক্ষীকে শপথ দিতে পারে না। পুলিশ যে কোনো প্রশ্ন করতে পারে এবং যাকে পুলিশ প্রশ্ন করবে, তিনি উত্তর দিতে বাধ্য; কিন্তু সত্য না বললে তার জন্য তাঁকে শাস্তি দেওয়া যায় না।
জনগণের শান্তি ও নিরাপত্তার গুরুদায়িত্ব পুলিশের ওপর ন্যস্ত। মিথ্যা মামলায় যাতে নিরীহ মানুষ হয়রানির শিকার না হয়, পুলিশকে তা দেখতে হবে। অপরাধী বলে যাদের চিহ্নিত করা সম্ভব, তাদের আদালতে সোপর্দ করা পুলিশের কাজ। সাক্ষী তৈরি বা স্বীকৃতি আদায় করা পুলিশের কাজ নয়। নিরীহ মানুষকে জেল দেওয়ার মতলবে তদন্ত করা ঠিক নয়। তদন্তের সময় পুলিশ কর্মকর্তা ঘটনাস্থলের মানচিত্র সূচিপত্রসহ তৈরি করবেন এবং আদালতে জমা দেবেন। ঘটনার সব পরিচয়, আলামত ও বিবরণ আদালতের সামনে তুলে ধরা তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তার দায়িত্ব। ঘটনাস্থলে গিয়ে সাক্ষ্য-প্রমাণ নিয়ে পরিস্থিতি কী দাঁড়ায়, তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা কে, তা গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে। তিনি যদি দেখতে পান, মামলাটি আদালতে টিকবে না কিংবা মামলাটি যেভাবে সাজানো হয়েছে তা ঠিক নয়, তাহলে তিনি সেভাবে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে রিপোর্ট দেবেন। তাঁকে নিরপেক্ষ হতে হবে। ঘটনা সম্পর্কে তাঁর অধিক আগ্রহ থাকা ঠিক নয়।
তদন্তে বিলম্ব করা উচিত নয়। তদন্তে বিলম্ব কর্তব্যে অবহেলা করার শামিল। তদন্তে বিলম্বের কারণে ঘটনা সম্পর্কে ভুল ধারণার অবকাশ থাকে। ঘটনার ওপর রং লাগানোর আশঙ্কা থাকে। অনেক ক্ষেত্রে নতুনভাবে ঘটনা সাজানো হয়। কয়েকজন সাক্ষী নেওয়ার পর তদন্ত স্থগিত রাখা হলে অন্যান্য প্রস্তাবিত সাক্ষী আগের সাক্ষীদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে কথা বলার চেষ্টা করতে পারে। ঘটনাস্থলে জব্দ তালিকা এবং উপস্থিত নিরপেক্ষ সাক্ষীদের স্বাক্ষর নিতে হবে। সাদা কাগজে সাক্ষীদের স্বাক্ষর নিয়ে পরবর্তী পর্যায়ে জব্দ তালিকা তৈরি করলে সন্দেহের জাল সৃষ্টি হতে পারে। এটা করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
গত জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং তাদের অস্ত্রধারী ক্যাডার বাহিনীর গুলিতে শত শত মানুষের প্রাণহানিসহ অনেকে গুরুতর জখম হয়েছে। এসব ঘটনার বিবরণ সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিশদভাবে প্রচারিত হয়েছে। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিদিনই মামলা হচ্ছে এবং দিন দিন এর পরিধি বাড়ছে। থানা ও কোর্ট থেকে দায়েরকৃত মামলার এজাহার, ঘটনাস্থলের বিবরণ, আলামত উদ্ধার, সাক্ষীর জবানবন্দি গ্রহণ, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ভিডিও ফুটেজ, প্রিন্ট মিডিয়ার পেপার কাটিং ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যাবলি অতিদ্রুততার সঙ্গে সংগ্রহ এবং মামলার আলামত হিসেবে জব্দ করার প্রয়াস চালাতে হবে। এসব মূল্যবান তথ্য অতিসতর্কতার সঙ্গে যাচাই-বাছাই করে আইনের কাঠামোর মধ্যে আদালতে জমা দিতে হবে। দিন যত যাবে এসব বহু মূল্যবান তথ্য মুছে যাওয়া এবং বেহাত হওয়ার আশঙ্কা আছে।
আইনের কাঠামোর মধ্যে এবং পেশাদারিত্বের সঙ্গে এসব কাজ সম্পন্ন করতে হবে। মামলা মনিটরিং সেলের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করতে হবে। বিগত সময়ে কিছু অসাধু ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা রাজনৈতিক নেতাদের যোগসাজশে অধীনস্থ পুলিশ কর্মকর্তাদের মাধ্যমে ভিন্নমতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে বোমাবাজি, অস্ত্র ও গুলি উদ্ধার, জঙ্গি নাটক সাজিয়ে নিরীহ লোকদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন এবং বিনা বিচারে জেল হাজতে রেখেছেন। যারা কাজটি করেছেন, কমিশন বসিয়ে তাদের আইনের আওতায় আনা জরুরি। এসব অসাধু কর্মকর্তা পুলিশ বিভাগকে একেবারে তলানিতে নামিয়ে দিয়েছেন, যা পুনরুদ্ধার করতে বহুদিন লেগে যেতে পারে বলে আমি মনে করি। তারা তদন্তের নামে প্রহসন এবং উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে বিডিআর হত্যা মামলাসহ অন্যান্য মামলার অভিযোগপত্র দিয়েছেন। এসব মামলার নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া উচিত।
থানায় রাইটার, ওয়্যারলেস অপারেটর দ্বারা এজাহার ড্রাফট, প্রোফরমা বানিয়ে আসামি ও সাক্ষীদের নাম সন্নিবেশিত করা থেকে বিরত থাকতে হবে। বিগত দিনে এ প্রথা চালু ছিল। সে সময় পুলিশের পেশাদারিত্ব জলাঞ্জলি দিয়ে আর্থিক লাভবান হয়ে প্রভাবশালী মহলের ইশারায় মিথ্যা বানোয়াট মামলা রুজু ও গ্রেপ্তার, নামে-বেনামে এমনকি মৃত, বিদেশে অবস্থানরত ব্যক্তি, কিছু ক্ষেত্রে জেল হাজতে থাকা ব্যক্তির নামেও থানায় মামলা করা হয়েছে–যা গুরুতর অপরাধ এবং আইনবহির্ভূত কাজ।
মো. রুহুল আমিন, পিপিএম (বার): বিশেষ পুলিশ সুপার (অব.)