মহান মুক্তিযুদ্ধে দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ এই সংগ্রামে ‘জয় বাংলা’ ও ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান ছিল বাঙালি জাতির ঐক্যবদ্ধ কণ্ঠস্বর। এই কণ্ঠস্বরকে আরও সুসংহত করেছিল বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি। মুক্তিযোদ্ধা থেকে শুরু করে স্বাধীনতাকামী প্রত্যেক মানুষের মানসচেতনায় প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল এই দুই স্লোগান ও এই সংগীত। এই সংগীত ও স্লোগানে মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় মানুষ যেমন উজ্জিবিত হয়েছিল, তেমনই পাকিস্তানের শোসক গোষ্ঠী ও তাদের এদেশিয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আল শামস ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় তারা ‘জয় বাংলা’ ও ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান শুনলে যেভাবে ক্ষিপ্ত হতো, ঠিক একইভাবে রবীন্দ্রনাথের এই সংগীত তাদের পাকিস্তানী সত্ত্বাকে দুমরে মুচড়ে ভেঙে দিত। ফলে পাকিস্তানী চেতনায় বিশ্বাসী এ দেশিয় মানুষদের এই স্লোগান ও সংগীত নিয়ে আপত্তি থাকবে তা খুবই স্বাভাবিক।
আমরা জানি, বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও এদেশ পাকিস্তানপন্থী রাজাকারদের হাত থেকে মুক্তি পায়নি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে ঘাপটি মেরে থাকা এই গোষ্ঠী প্রথম স্বগর্বে প্রকাশ্যে আসে পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার পরপরই। বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী খন্দকার মোশতাক, জিয়াউর রহমান, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ থেকে শুরু করে যে কটি সরকার গঠিত হয়, তার প্রত্যেক সরকারের হাতেই বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব পায় একাত্তরের ঘাতক শ্রেণি। এমনকি স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগও শেখ হাসিনা আমলে এদের পৃষ্ঠপোষক হয়ে উঠেছিল। এর প্রধান অংশজুড়েই রয়েছে জামায়াত। পঁচাত্তরের পর স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত জামায়াতের নানামুখী তৎপরতা এখন পর্যন্ত বিদ্যমান। তারা সুযোগ পেলেই একাত্তর প্রসঙ্গে নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করতে অতি উৎসাহী হয়ে ওঠে। একাত্তরে তাদের অবস্থানকে বৈধতা দিতে নানামুখী বয়ান হাজির করার ইতিহাসও কম নয়। বিশেষত তাদের এই আলোচনার সিংহভাগে থাকে মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবস্থান, ইসলাম, বঙ্গবন্ধু ও তাঁর কর্মকাণ্ড, মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা এবং রবীন্দ্রনাথ। জামায়াত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে ইসলামের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছিল যেমন সত্য, তেমনই পাকিস্তানের সঙ্গে এক হয়ে এদেশে গণহত্যা চালিয়েছিল এও সত্য। এও সত্য যে, বাঙালি সংস্কৃতিকে মেরে ফেলতে তারা নজরুল ও রবীন্দ্রনাথকে প্রতিদ্বন্দ্বী করে তুলেছে বারবার। অথচ বাঙালির অসাম্প্রদায়িক চেতনার পুরোটা জুড়েই রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। এই কথা কোনোভাবেই স্বীকার করা যায় না, রবীন্দ্রনাথ-নজরুল কোনোভাবে কেউ কারও প্রতিদ্বন্দ্বী কিংবা বাঙালি থেকে বিচ্ছিন্ন সত্ত্বা। বরং তাঁরা উভয়ই বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশে সম্পূরক হিসেবে প্রতিয়মান।
ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, বাঙালিকে সাংস্কৃতিকভাবে পঙ্গু করতে রবীন্দ্র সংগীত বন্ধের নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল পাকিস্তান সরকার। প্রথম ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তৎপরতা শুরু করে তারা। সেসময় রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালনে সরকার গুমোট পরিস্থিতি সৃষ্টি করে, যে কারণে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যে কোনো আয়োজনই প্রতিকূল পরিবেশর সম্মুখীন হতো। এর ঠিক চার বছর পর ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধাবস্থায় রবীন্দ্রনাথের গানকে অলিখিতভাবে সরকারি মাধ্যমে প্রচার নিষিদ্ধ করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৬৭ সালে তা নিষিদ্ধ হয় লিখিতভাবে। পাকিস্তান সরকারের এ রকম বিরোধিতা সত্ত্বেও, বাঙালি সমাজে রবীন্দ্র-অনুরাগ ছড়িয়ে পড়তে থাকে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ও আন্দোলন পরবর্তী নানান রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে যে বাঙালিয়ানার উন্মেষ ও বিকাশ ঘটেছিল, তার সিংহভাগ জুড়ে রবীন্দ্রনাথ ঐক্যতানের সুর হয়ে উঠেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের প্রতি সেই অনুরাগই তুঙ্গে ওঠে ১৯৬০-এর দশকের শেষ দিকে এবং তা মুক্তিযুদ্ধের সূচনাকালেই পাকাপোক্ত স্থান করে নেয়। মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়জুড়ে রবীন্দ্রনাথের গান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রবীন্দ্র পাঠক মাত্রই জানেন, তাঁর সাহিত্য কর্মে বাংলাদেশ বৃহৎ একটি প্লট দখল করে নিয়েছে। ফলে তিনি যেভাবে স্ব-শিল্প সত্ত্বায় বাংলাদেশকে উপস্থাপন করেছিলেন তা আজও প্রাসঙ্গিক। বাংলাদেশ ভাবনায় বাঙালি ও বাঙালি সংস্কৃতির ধারাবাহিকতায় রবীন্দ্রনাথ প্রধান চরিত্র হয়ে উঠেছেন, যা কখনো খন্ডন করা সম্ভব নয়। বিধায় একাত্তরের পরাজিত শক্তি যখন বাংলাদেশে হানা দেয়, তার প্রথম আক্রমণের শিকার হন রবীন্দ্রনাথ ও তার রচিত বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত।
বাংলাদেশের ইতিহাসে জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের প্রথম উদ্যোগ নেওয়া হয় বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর, খন্দকার মোশতাক আহমেদের সরকার কর্তৃক। সেসময় পাকিস্তানী চেতনার মানুষদের সমন্বয়ে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়। তারা ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটিকে বাদ দিয়ে কাজী নজরুল ইসলামকে মুসলিম চেতনার কবি হিসেবে উপস্থাপন করে তাঁর ‘চল চল চল’ (বর্তমানে বাংলাদেশের রণ সংগীত) অথবা পাকিস্তানপন্থী কবি ফররুখ আহমেদের ‘পাঞ্জেরী’ কবিতার কোনো একটিকে জাতীয় সংগীত হিসেবে রাখার প্রস্তাব করেন। রাজনৈতিক অস্থিরতায় এ প্রস্তাব সেসময় কার্যকর হয়নি। এরপর ১৯৭৯ সালে সেনা শাসক জিয়াউর রহমানের শাসনামলে, ‘আমার সোনার বাংলা’ পরিবর্তন করে ‘প্রথম বাংলাদেশ, আমার শেষ বাংলাদেশ’ গানটিকে জাতীয় সংগীত করার প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান এক গোপন চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ভারতের নাগরিক হিসেবে দেখিয়ে জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের প্রস্তাব দেন। কিন্তু ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমান নিহতের ঘটনায় এ উদ্যোগও থেমে যায়।
পরবর্তীতে ২০০১-২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এলে জাতীয় সংগীত নিয়ে পুনরায় আলোচনা শুরু হয়। এই আমলে জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের তৃতীয় দফার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ২০০২ সালে একাত্তরের রাজাকার, জামায়াত নেতা, তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী আলী আহসান মুজাহিদ যৌথভাবে তখনকার প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার কাছে জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের সুপারিশপত্র জমা দেন। তবে, এ প্রস্তাবও কার্যকর হয়নি। ফলে জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের রাজনীতি দীর্ঘদিনের মতো বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যাওয়া এই আলোচনা আবারও শুরু হয়েছে। গত ৫ই অগাস্ট ২০২৪ তারিখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর জাতীয় সংগীত নিয়ে আপত্তি তোলা হয়। জুলাই আন্দোলনের সময় থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীত নিয়ে আপত্তিকর প্রচারণা শুরু হয়েছিল। ৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে এই প্রচারণার পালে আনুষ্ঠানিক জোর হাওয়া লাগান মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত জামায়াত নেতা, রাজাকার গোলাম আযমের ছেলে— সাবেক সেনা কর্মকর্তা আব্দুল্লাহিল আমান আযমী। রাজাকারপুত্র আমানের ভাষ্যমতে, ‘আমাদের এখন যে জাতীয় সংগীত রয়েছে সেটি আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বের পরিপন্থি। এটা দুই বাংলা এক করার জন্য বঙ্গভঙ্গ রদের সময়কে উপস্থাপন করে। যে সংগীত দুই বাংলা এক করার জন্য করা হয় সেটা কীভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হতে পারে? এই সংগীত ১৯৭১ সালে ভারত আমাদের ওপরে চাপিয়ে দিয়েছিল’।
‘আমার সোনার বাংলা গানটি রচিত হয় ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে’ এর সত্যতা পাওয়া খুবই কঠিন। কেননা গানটির পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়নি, তাই এর সঠিক রচনাকাল আমাদের কাছে অজানা। রবীন্দ্র গবেষকদের দাবি অনুযায়ী দুটি ভিন্ন ভাষ্য পাওয়া যায়। সত্যেন রায়ের রচনায় উল্লেখ রয়েছে, ১৯০৫ সালের ৭ আগস্ট কলকাতার টাউন হলে আয়োজিত এক প্রতিবাদ সভায় এই গানটি প্রথম গাওয়া হয়েছিল। এই বছরই ৭ সেপ্টেম্বর (১৩১২ বঙ্গাব্দের ২২ ভাদ্র) ‘সঞ্জীবনী’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের স্বাক্ষরে গানটি প্রকাশিত হয় বলে জানা যায়। একই বছর ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার আশ্বিন সংখ্যাতেও গানটি মুদ্রিত হয়। তবে সত্যেন রায় উল্লেখিত ৭ আগস্ট সভায় এই গানটি গীত হওয়ার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। রবীন্দ্রজীবনীকার প্রশান্তকুমার দাবি করেন, ‘আমার সোনার বাংলা’ ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ আগস্ট কলকাতার টাউন হলে ‘অবস্থা ও ব্যবস্থা’ প্রবন্ধ পাঠের আসরে প্রথম গীত হয়। এসব ঘটনা ‘আমার সোনার বাংলা’র রচনাকালকে নির্দেশ না করলেও আলোচনায় আসার সময়পর্বকে নির্দেশ করে ঠিক। কিন্তু তার মানে এই নয় গানটি বঙ্গভঙ্গ রদের প্রেক্ষাপটেই রচিত, তার কোনো প্রমাণও নেই। সেই সঙ্গে গানের কোনো কথা বঙ্গভঙ্গকে ইঙ্গিত করে না, বরং বাংলাদেশের চিরায়ত আবহকেই চিত্রায়িত করে বারবার। যদি আমরা ধরেও নিই, রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গের প্রেক্ষাপটে এই গান লিখেছেন, তারপরও সামগ্রিক বিচারে বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান ও পরিবেশ-প্রকৃতির চিত্রায়নে এই গান খুবই প্রাসঙ্গিক এবং অদ্বিতীয়। কেননা এই গানের সুরে লেগে রয়েছে এই অঞ্চলের লোকায়ত জ্ঞান ও জীবন। গগন হরকরা রচিত ‘আমি কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যে রে’ এর সুরের আবহে গীত হওয়া ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি বাংলাদেশের লোকজ সুর ও সংগীতের ধারাবাহিকতাকে বহন করছে। যে জন্য এই গান আমাদের সকল শ্রেণি পেশার মানুষের মাঝে পরম আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ। তাই, রাজাকার পুত্র ও তার মতো পাকিস্তানী চেতনাগোষ্ঠীর দাবি কোনো যৌক্তিকতা রাখে না। তাদেরও এটা অজ্ঞাত নয় মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বাঙালি এই গানকে স্বস্ফুর্তভাবে গ্রহণ করেছিল। এর জন্য ভারতকে চাপিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন হয়নি, ভারতের সেই প্রচেষ্টাও ছিল না।
১৯৭১ সালের পহেলা মার্চ মুক্তিকামী ছাত্ররা ‘স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করে। পরে এই সংগ্রাম পরিষদই ৩ মার্চ ঢাকার কেন্দ্রস্থল ‘পল্টন ময়দানে’ অনুষ্ঠিত জনসভা শেষে ঘোষিত স্বাধীনতার ইশতেহারে ‘আমার সোনার বাংলা’কে জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে ঘোষণা দেয়। পরবর্তীতে ১৭ই এপ্রিল মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারও তাঁর শপথ অনুষ্ঠানে এই গানকে জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে স্বীকৃতি দেয় এবং জাতীয় সংগীত হিসাবে আনুষ্ঠানিকভাবে গাওয়া হয়। আমাদের মুক্তিযোদ্ধাগণ এই সংগীতকে মনে-প্রাণে ধারণ করেই যুদ্ধ করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে ক্যাম্পে বেজেছে এই সংগীত। অসংখ্য মানুষ এই গান গেয়েই স্বাধীনতার সংগ্রামে জীবন উৎসর্গ করে গিয়েছেন। এই সংগীতকে ঘিরেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও আমাদের স্বাধীনতা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে রয়েছে। একে অস্বীকার কিংবা এর পরিবর্তন করার অর্থই মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করা।
পাকিস্তানের দোসররা একাত্তরের ইতিহাস মুছে দিতে বদ্ধপরিকর। এই অপচেষ্টা থেকেই তারা বারবার আমাদের জাতীয় সংগীতকে আক্রমণ করে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পরপরই এই চেষ্টা আবারও দৃশ্যমান হয়েছে। ধানমন্ডির ৩২-এ বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন পুড়িয়ে ফেলা তারই একটি বড়ো উদাহরণ। নানা প্রক্রিয়ায় তারা বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের বাইনারি তৈরির চেষ্টাতেও লিপ্ত। ফলে তারা ছাত্র-জনতার গণ অভ্যুত্থানকে বিপ্লব আখ্যায়িত করে ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ’ ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ ‘আমরা দেশ স্বাধীন করেছি’ ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ ‘চব্বিশের মুক্তিযোদ্ধা’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করছে। এরই মধ্যে তারা আওয়ামী লীগের অপশাসনের দরুন ‘রাজাকার’ শব্দকে অনেকাংশে নরমালাইজ করতে পেরেছে, কিন্তু সফলতা এখনও আসেনি। এমতাবস্থায় তারা জাতীয় সংগীত ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে বাহাস শুরু করেছে। এসবের মাঝে তাদের যে দূরভিসন্ধি রয়েছে, তা সুস্পষ্ট। মুক্তিযুদ্ধের পর ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে যে মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তা নিয়ে আমান আযমীর মিথ্যাচারও একই ইঙ্গিত বহন করে। তারা জাতীয় সংগীত নিয়ে যে আপত্তি তোলে, তা মূলত একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বিরোধী চেতনার অংশ। তাদের সকল ভয় বাঙালিয়ানায়, রবীন্দ্রনাথে এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রাণ সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’র ওপরে। কেননা এই সংগীত বেজে উঠলেই রাজাকার চেতনার মানুষদের মাঝে পরাজিতের গ্লানি ভর করে। তারা এ থেকে নিস্তার পেতেই জাতীয় সংগীতের পরিবর্তন চায়। এই পরিবর্তন শাধিত হলে মুক্তিযুদ্ধের অনেক ইতিহাসকে মুছে ফেলা সহজ হবে বলে তাদের ধারণা। নতুন প্রজন্ম এই অপচেষ্টা রুখে দিবে এমনটাই প্রত্যাশা। অন্যথায় একসময় জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের অর্জন মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের জাতীয় চেতনাকে পরাজিত করার ফলপ্রসূ ষড়যন্ত্র হিসেবেই আখ্যায়িত হবে।
লেখক : কবি ও সমাজচিন্তক