জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের অপচেষ্টা এবারও ব্যর্থ হতে বাধ্য

মইনুল ইসলাম

অঙ্কন : মিতা মেহেদী (সংগৃহীত)

জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির এবং একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ৯০ বছর দণ্ডপ্রাপ্ত প্রয়াত গোলাম আযমের পুত্র অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহিল আমান আযমী সম্প্রতি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেছেন। আমান আযমীর পরিবারের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা বিবেচনা করলে তাঁর পক্ষে এহেন দাবি তোলা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশে এমন কী পরিবর্তন ঘটেছে যে, তাঁর কাছে জাতীয় সংগীত পরিবর্তন অগ্রাধিকার হয়ে দাঁড়াল? তিনি সেটা সাড়ম্বরে প্রকাশের ভরসাই বা পেলেন কাদের কাছ থেকে?

আযমীর এই মতামত অবশ্য হালে পানি পায়নি। এমনকি তাঁর পিতার রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীও আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়ে এ সংক্রান্ত আলোচনা ও আলোচনাকারী থেকে নিজেদের দূরত্ব স্পষ্ট করেছে। আশার কথা, এ সংক্রান্ত আলোচনায় অংশগ্রহণকারী বিপুল অধিকাংশই বর্তমান জাতীয় সংগীত বহাল রাখার পক্ষে মতামত ব্যক্ত করে চলেছেন। আবার কিছু মানুষ যে আযমীকে সমর্থন করছেন না– তা নয়। তবে জামায়াতে ইসলামীর বিবৃতির পর তারাও দৃশ্যত খামোশ হয়ে গেছেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকারের ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে এ সংগীত রচনা করেছিলেন– এটাই জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের পক্ষে উপস্থাপিত যুক্তি। কিন্তু এটি কবিগুরুর অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী একটি গান। এটাও সত্য, গগন হরকরা নামে বাউল গায়ক রচিত একটি বাউল গানের সুরে কথা পরিবর্তন করে তিনি গানটি রচনা করেছিলেন। কিন্তু জাতীয় সংগীতের কথাগুলো শোনার সঙ্গে সঙ্গে সব দেশপ্রেমিক নাগরিকের মনেপ্রাণে যে অপূর্ব ভাবাবেগ জাগ্রত হয়, তার কি কোনো মূল্য নেই?

আমাদের ইতিহাসের ধারাবাহিকতারও মর্যাদা দিতে হবে। উদ্ভট দাবিটির পক্ষের লোকজন ভুলে গেছে– মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই স্বাধীনতা সংগ্রামের ইশতেহার ঘোষণার দিন ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে স্বাধীনতা ইশতেহারের অংশ হিসেবে কবিগুরুর অমর গানকে জাতীয় সংগীত হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল। পুরো গানটির পরিবর্তে শুধু প্রথম ১০টি চরণ বেছে নেওয়া হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর স্বাধীন বাংলাদেশে। আযমীর কাছে এই জাতীয় সংগীতের গ্রহণযোগ্যতা না থাকার প্রধান কারণ কি এই যে, সংগীতটি আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতীক হয়ে উঠেছিল? বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে তাঁর আপত্তিই কি তাহলে জাতীয় সংগীত বিরোধিতার ছদ্মবেশে ব্যক্ত হচ্ছে?

কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বাংলাদেশি’ নন, বরং ‘ভারতীয়’। ফলে তাঁর রচিত সংগীত বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হতে পারে না। বাস্তবতা হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণ ঘটেছে দেশভাগের আগেই; ১৯৪১ সালে। তাঁর কাছে বাংলাদেশ-ভারত আলাদা রাষ্ট্র ছিল না। আর শিকড়ের কথা যদি ধরি, রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষরা আজকের বাংলাদেশ ভূখণ্ড থেকেই কলকাতায় অভিবাসী হয়েছিলেন। বরং কাজী নজরুল ইসলামের জন্মভূমি আজকের ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বর্ধমান জেলার আসানসোলের চুরুলিয়ায়। অবিভক্ত ভারতে জন্মগ্রহণকারী কাজী নজরুল ইসলাম যদি স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় কবি হতে পারেন; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত সংগীত জাতীয় সংগীত হতে দোষ কী? আসল কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত রচয়িতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অমুসলিম। জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের ধুয়া তোলা সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর সেখানেই আপত্তি।

এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর অবৈধভাবে দেশের প্রেসিডেন্ট পদ জবরদখলকারী খন্দকার মোশতাক প্রথম প্রয়াস চালিয়েছিলেন জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের। কিন্তু ৩ নভেম্বর মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে অভ্যুত্থান সংঘটিত হওয়ায় তাঁর সে খায়েশ পূরণ করতে পারেননি।

জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের দ্বিতীয় উদ্যোগ নেওয়া হয় ১৯৭৯ সালে; জেনারেল জিয়াউর রহমানের শাসনামলে। চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধী ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান এক গোপন চিঠিতে লেখেন– ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একটি গান ভারতীয় জাতীয় সংগীত। তিনি বাংলাদেশের নাগরিক নন। আমার সোনার বাংলা গানটি আমাদের সংস্কৃতির চেতনার পরিপন্থি বিধায় জাতীয় সংগীত পরিবর্তন আবশ্যক।’ প্রধানমন্ত্রীর ওই চিঠি পেয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ রেডিও, টেলিভিশন এবং সব সরকারি অনুষ্ঠানে ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ’ গানটি প্রচারের নির্দেশনাও জারি করে। এ সময় রাষ্ট্রপতির অনুষ্ঠানে জাতীয় সংগীতের পাশাপাশি ‘প্রথম বাংলাদেশ’ গানটি গাওয়া শুরু হয়। কিন্তু ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমান নিহত হলে সে উদ্যোগ থেমে যায়।

জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের তৃতীয় দফার উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০০১-২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে।

২০০২ সালে জামায়াতের তৎকালীন আমির ও শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী এবং দলটির তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী আলী আহসান মুজাহিদ জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের লক্ষ্যে একটি যৌথ সুপারিশপত্র প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এই অনুরোধপত্রটি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে পাঠান। জাতীয় সংগীত পরিবর্তন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ার-বহির্ভূত বিষয় বলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়। পরবর্তী সময়ে ওই প্রস্তাবের পরিণতি কী হয়েছে, জানা যায় না।

ওপরের আলোচনা থেকে এটা পরিষ্কার– বারংবার বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের দাবির নেপথ্যে মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরাই অতি উৎসাহী। এবারও দেখা গেল, চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধীর পুত্র স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরও মুক্তিযুদ্ধের প্রতীকগুলো নিয়ে পুরোনো ক্ষোভ ভুলতে পারেননি। কথা হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরা এবারও জাতীয় সংগীত পরিবর্তনে ব্যর্থ হতে বাধ্য।

জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের দিবাস্বপ্নে বিভোর ব্যক্তি ও গোষ্ঠীদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান হওয়ার মানে এই নয়– স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ আমরা ভুলে গেছি। এখন গণঅভ্যুত্থানের সাফল্যের পর যদি জামায়াত-শিবির মনে করে, ভবিষ্যতে সংসদ নির্বাচনে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়ী হবে, তাহলে তাদের জন্য বড় ধরনের দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে। জাতীয় সংগীতের মতো আবেগের বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে জামায়াতের জনসমর্থন কমবে বৈ বাড়বে না– এই বাস্তবতা আবদুল্লাহিল আমান আযমী না জানলেও তাঁর দল জানে বলেই আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়ে এমন দাবির সঙ্গে সম্পৃক্ততা খারিজ করে দিয়েছে।

জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের দাবির সঙ্গে গণঅভ্যুত্থানকালে দেশের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন স্মারক স্তম্ভ এমনকি মুজিবনগরের স্মৃতিসৌধ ভাঙচুরের যোগসূত্র পাওয়া যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ গ্রহণের স্মৃতিবিজড়িত মুজিবনগর কমপ্লেক্সে ভাঙচুরের বিষয়টির সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধিতা ছাড়া আর কী কারণ থাকতে পারে?

অন্তর্বর্তী সকারের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্যদের অতীত অবস্থান থেকে আমরা জানি, মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রশ্নাতীত। ১৯৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালে প্রফেসর ইউনূস মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে নিউজলেটার প্রকাশনাসহ সাংগঠনিক তৎপরতা চালিয়েছিলেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসসহ অন্যান্য উপদেষ্টার প্রতি আমার আহ্বান– অবিলম্বে উপদেষ্টা পরিষদের সভায় সিদ্ধান্ত নিয়ে জাতীয় সংগীত বিষয়ে আপনাদের অবস্থান স্পষ্ট করুন। একই সঙ্গে মুজিবনগরসহ মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন স্থাপনা, স্মারক ও ভাস্কর্য ভাঙচুরকারীদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিন। অন্যথায় বর্তমান সরকারের ব্যাপারে জনসাধারণের মধ্যে ভুল বার্তা যেতে পারে।

লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ; সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি

শেয়ার করুন