একটি রাষ্ট্র সফল নাকি ব্যর্থ তা নির্ভর করে সেই রাষ্ট্রে সুশাসন অর্থাৎ আইনের শাসন কতটুকু নিশ্চিত করা হচ্ছে তার উপর। সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে সেই রাষ্ট্রে কখনোই স্থিতিশীলতা আসে না। আইনের শাসনের ব্যত্যয়ের ফলে একসময় সেটি অকার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত হয়। এখন প্রশ্ন আসতে পারে, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে বাংলাদেশে কী আইনের শাসন নেই? আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কোন পর্যায়ে রয়েছে? এটি কী একটি সুশাসন বিহীন অকার্যকর রাষ্ট্রের দিকে এগুচ্ছে? এসব প্রশ্নের উত্তর এখনই দেওয়া সম্ভব নয়, তবে চলমান অবস্থা যদি আরও দীর্ঘায়িত হয় তাহলে সেই সম্ভাবনা উঁকি দেওয়ার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে।
রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘিরে সহিংসতা হলে নেতা-কর্মীদের নামে গণহারে মিথ্যা মামলা দেওয়া এদেশের অনেক পুরনো সংস্কৃতি। যাঁরা রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে থাকেন, তাঁরা এর অন্যতম ভুক্তভোগী। কিন্তু ক্ষমতার মসনদে বসলেই তাঁরাই আবার এটিকে বিরোধীদের শায়েস্তার অস্ত্র করে তুলতে কোনো রকম কার্পণ্য করেন না। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরেও এই সংস্কৃতি থেকে বের হতে না পারা আমাদের জন্য নিঃসন্দেহে একটি লজ্জাজনক বিষয়।
প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার এই পুরনো অপকৌশল গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা পদত্যাগের পরে ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। দলটির নেতাকর্মীদের নামে সারাদেশে প্রতিদিন গণহারে হত্যা মামলাসহ বিভিন্ন মিথ্যা ও বানোয়াট মামলা দায়ের করার উৎসবে মেতে উঠেছে বিএনপি-জামায়াত-হেফাজতসহ ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা সুবিধাভোগী পক্ষ। সেসব মামলায় আসামি করা হচ্ছে রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, খেলোয়াড়, অরাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, সাবেক মন্ত্রী-এমপি, সাবেক প্রধান বিচারপতি, বিচারপতি, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল, সংস্কৃতি কর্মী এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষকে। এমনকি এসব গায়েবি মামলায় আসামি করা হচ্ছে মৃত ব্যক্তিদেরকেও! যারা ৫ আগস্ট কবর থেকে উঠে মারামারি করে আবার কবরে চলে গেছেন! এছাড়া মব জাস্টিসের নামে হত্যা করা হচ্ছে হাজার হাজার আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ-যুবলীগসহ বিভিন্ন অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের। আদালতে হামলার শিকার হচ্ছেন মামলায় গ্রেফতার হওয়া আসামিরা। এমন পরিস্থিতি চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় সময় পার করছে দেশবাসী। এই অবস্থার লাগাম টেনে ধরা জরুরি।
আমরা উদ্বেগের সাথে লক্ষ করেছি, গত ১০ সেপ্টেম্বর হেফাজতে ইসলামের সমর্থক হিসেবে পরিচিত জনৈক ব্যক্তি বাদী হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর মডেল থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। সেখানে আসামি করা হয়েছে প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ, মাউশি প্রাক্তন মহাপরিচালক ও ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের প্রাক্তন চেয়ারম্যান প্রফেসর ফাহিমা খাতুনকে। তিনি ২০২০ সাল থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আমরা যতটুকু জানি, প্রফেসর ফাহিমা খাতুন কখনোই কোনো দলের সঙ্গে জড়িত হননি। তিনি সবসময় নিজেকে শিক্ষা ও সমাজ সেবামূলক কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত রাখতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন। একটি বুদ্ধিবৃত্তিক প্রজন্ম গড়ে তোলার নিমিত্তে তিনি গড়ে তুলেছেন চিনাইর শিশু মেধাবৃত্তি ফাউন্ডেশন। যে ফাউন্ডেশনটি দীর্ঘ ১৯ বছর যাবৎ শিশু মেধাবৃত্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রকৃত মেধাবীদেরকে বৃত্তি প্রদান করে আসছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষ তাকে ঐ অঞ্চলের বেগম রোকেয়া হিসেবেও অবহিত করেন। তাঁর এতসব পরিচয়ের বাহিরেও আরেকটি পরিচয় রয়েছে- সেটি হচ্ছে, তিনি সাবেক গণপূর্তমন্ত্রী এবং কিংবদন্তি রাজনীতিবিদ যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এমপির সহধর্মিণী! একজন রাজনীতিবিদের সহধর্মিণী হওয়ার অপরাধে একজন মানুষকে মিথ্যা মামলায় হয়রানি করা কোনো সভ্য সমাজ সমর্থন করতে পারে না। এধরনের উদ্দেশ্য প্রণোদিত ও অনাঙ্ক্ষিত মামলার সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। একইসঙ্গে রাজনৈতিক মামলা গ্রহণের ক্ষেত্রে থানাকে নিরুৎসাহিত করার জন্য উর্ধতন কর্তৃপক্ষের আশু নির্দেশনা জরুরি। অন্যথায় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার যে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, সেটি প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
আমরা আরও লক্ষ্য করছি, সারাদেশে দায়েরকৃত মামলাগুলোর এজাহারে উল্লেখিত ঘটনার বাস্তব অস্তিত্বই নেই, সেখানে কীভাবে মামলা হতে পারে? সেটি নিয়েও প্রশ্ন তোলার অবকাশ তৈরি হচ্ছে। যদিও মামলাগুলো গায়েবি, কিন্তু এসব মামলায় যাঁদেরকে আসামি করা হচ্ছে, তাঁরা বাস্তবের রক্তমাংসের মানুষ এবং তাঁদের হয়রানি ও ভোগান্তিটাও বাস্তব। এমতাবস্থায়, ছাত্রজনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে এধরনের গায়েবি মামলার প্রত্যাবর্তন সুস্থ ধারার রাজনীতি এবং স্থিতিশীল বাংলাদেশের জন্য মোটেও ভালো দৃষ্টান্ত নয়। এধরনের অস্তিত্বহীন ঘটনায় মামলা ও হয়রানি শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক বিদ্বেষ ও অসহিষ্ণুতাকেই উসকে দিতে পারে।
সবশেষে বলতে চাই, কেউ যদি প্রকৃতপক্ষেই সহিংসতা ও হত্যাযজ্ঞে জড়িয়ে পরে, তবে তার বিরুদ্ধে পুলিশের ব্যবস্থা নেওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে কাউকে হয়রানির লক্ষ্যে কারো বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা দিয়ে শায়েস্তা করার অপকৌশল থেকে অবশ্যই রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদেরকে বেরিয়ে আসতে হবে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছাত্র নেতারাও কিন্তু এ ব্যাপারে পরিষ্কার বক্তব্য দিয়েছেন। মানুষ জীবন দিয়েছে কোনো একটি দলকে সমর্থন করে নয়, অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে। কিন্তু এখন যা হচ্ছে দেশের ভবিষ্যতের জন্য একটি অশনিসংকেত। অনেক মানুষ কিন্তু সেকথা বলতে শুরু করেছে, সেটা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে কান পেতে শুনতে হবে।
লেখক: কবি ও সমাজ চিন্তক