এই লেখার জন্য আমি আক্রান্ত হতে পারি, দূরতম সম্পর্ক নেই এমন কোন মামলায় অভিযুক্ত হতে পারি। তবু কেনো লিখছি, সেই উল্লেখ থাকছে একেবারে শেষে।
❝সুপ্রীম অথরিটি❞ বলে একটি অবস্থান থাকে। যার এই অথরিটি থাকে তাঁকে দায়িত্ব নিতে হয়। মধ্য জুলাই থেকে ৫ আগষ্ট পর্যন্ত প্রতিটি হত্যার দায় তখনকার সুপ্রীম অথরিটি- তখনকার সরকার প্রধান শেখ হাসিনার। এই হত্যাযজ্ঞে আন্দোলনকারী, আন্দোলনের বিরোধীতাকারী, আন্দোলন নিরপেক্ষ মানুষ মারা গেছেন সকলেই বাংলাদেশের নাগরিক৷ প্রতিটি নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায় তাঁর ছিলো। তিনি সেটুকু পালন করেননি, এই অপরাধে তাঁর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতা বিরোধী অপরাধে মামলা হয়েছে। মামলা প্রমানিত হলে তিনি শাস্তি পাবেন।
৫ আগষ্ট দুপুরের পর থেকে এখন পর্যন্ত এই রাষ্ট্রের সুপ্রীম অথরিটি অন্য কেউ। আগের অথরিটিকে যদি তাঁর সময়ের কৃতকর্মের দায় নিতে হয়, বর্তমান অথরিটিকেও তো বর্তমান সময়ের নিতে হবে। তাইনা? সংবিধান, জনগন কাউকে তো দায়মুক্তি দেয়নি।
এই ছয় সপ্তাহে আগের তিন সপ্তাহের মতোই বিপুল উদ্যমে হত্যাযজ্ঞ ঘটেছে। হত্যাযজ্ঞ মানেই মানবতা বিরোধী অপরাধ। এ সময়ে হত্যাযজ্ঞের পাশাপাশি আরো অনেক কিছু ঘটেছে। এই ❝অনেক কিছু❞র একটা প্যাটার্ণ আছে। সরাসরি আক্রান্ত হয়েছেন একটি ধর্মীয় গোষ্ঠী এবং আরেকটি ধর্মীয় উপগোষ্ঠী। হিন্দুদের বাড়িঘর ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান আক্রান্ত হয়েছে সহস্রাধিক। শতাধিক মাজার আক্রান্ত হয়েছে, মাজারপন্থীরা নিহত ও আহত হয়েছেন, যারা নিজেদেরকে মুসলমানদের অংশ দাবী করেন। ধানমন্ডী ৩২ নম্বর জাদুঘর ধ্বংস, খুলনা গণহত্যা জাদুঘর আক্রান্ত, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙচুর, শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সমাধি এবং প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধার কবর আক্রান্তের ঘটনা ঘটেছে, ভস্মীভূত করা হয়েছে গ্রন্থাগার। এসব জাদুঘর, ভাস্কর্য, সমাধি- বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী জনগোষ্ঠী তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক স্থাপনা বলে মনে করেন। হিন্দু, মাজারপন্থী মুসলমান, বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের পাশাপাশি আক্রান্ত হয়েছেন নৃতাত্বিক জনগোষ্ঠীও।
কোন জনগোষ্ঠী যদি তার ধর্মীয়/জাতিগত/ নৃতাত্বিক পরিচয়ের কারণে আক্রান্ত হয় এবং হত্যার পাশাপাশি তাদের সাংস্কৃতিক স্থাপনা ও চিহ্ন সমুহ ধ্বংসের চেষ্টা করা হয় তাহলে সেটি আরেকটি আন্তর্জাতিক অপরাধ। সেই অপরাধের নাম হচ্ছে জেনোসাইড। জেনোসাইড কেবল গণহত্যা নয় বরং গণহত্যা++। গুগলে সার্চ দিলেই ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ প্রণীত জেনোসাইড কনভেশনে এসব কথা স্পষ্টভাবে পাওয়া যাবে।
যে বিশ্ববিদ্যালয়ে গতকাল একজন নিরীহ মানুষকে ঠান্ডা মাথায় পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে সেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমার একটি ডিগ্রি নেয়া আছে- ❝জেনোসাইড স্টাডিজ❞ এ। এই বিষয়ের একজন ছাত্র হিসেবে আমার দায় আছে যেখানেই জেনোসাইডের চিহ্ন ফুটে উঠে সেখানে এর প্রতিরোধে সক্রিয় হওয়া। যদি তা নাও পারি, অন্তত: ফ্ল্যাগ রেইজ করা। এই লেখার মাধ্যমে আমি পরেরটুকু করলাম মাত্র। প্রতিরোধের সামর্থ আমার মতো সামান্য মানুষের নেই।
এখানে জেনোসাইডের চিহ্ন ক্রমশঃ স্পষ্ট হচ্ছে। যারা এখন রাষ্ট্রের দায়িত্বে আছেন- আশা করি তাঁরা এটা অনুধাবন করবেন। জেনোসাইড ইজ দ্যা ক্রাইম অফ অল ক্রাইমস। এক একটা জেনোসাইডে শুধু রাষ্ট্র নয়, গোটা সমাজ ধ্বংস হয়ে যায়।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান গবেষক, ১৯৭১ গণহত্যা আর্কাইভ