ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হওয়ার এক মাস পূর্তি উপলক্ষে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে বক্তৃতায় ৬টি সংস্কার-কমিশন গঠনের ঘোষণা করেন এবং কমিশন প্রধানদের নাম জানান। সেখানে নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান হিসাবে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) নামক একটি এনজিওর সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারের নাম বলেন তিনি। কমিশন প্রধান হওয়ার পর বদিউল একটি অনুষ্ঠানে তাঁর বক্তৃতায় বলেন, “পূর্বে যারা ডামি নির্বাচনের আয়োজন করেছে তারা সুস্পষ্ট ভাবে সংবিধান লঙ্ঘনকারী। সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগে তাদের বিচার হবে। তা না হলে আগামী দিনে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি হবে না। বিচারে যে শাস্তির বিধান হবে, তা ভোগ করে তার পরে ভোট করতে হবে আওয়ামী নেতাদের। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তারা শাস্তিভোগ শেষ করে পুনর্গঠিত হতে না-পারলে তাদের ছাড়াই নির্বাচন হবে। সেই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে না।” আমাদের প্রশ্ন হলো বর্তমান যে সরকারটি দেশ পরিচালনা করছে সে সরকার কী সংবিধান সম্মতভাবে পরিচালিত হচ্ছে। নিশ্চয়ই হচ্ছে না। কেননা সংবিধানে অন্তর্বর্তী সরকার বলতে কোনো সরকারের কথা উল্লেখ নাই। তাছাড়া বৈধতা এবং গ্রহণযোগ্যতা দুটি এক বিষয় নয়; আইনের দৃষ্টিতে ২০১৪, ২০১৮ এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালের নির্বাচন নিশ্চয়ই বৈধ ছিল কিন্তু গ্রহণযোগ্য ছিল কিনা সেটি নিয়ে বিতর্ক করা যেতে পারে।
আমরা ঐ বিতর্কে আজ না গিয়ে মূল বিষয়ে আসি। বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ নির্বাচনে না আসলেও নির্বাচন অগ্রহণযোগ্য হবে না।’ আমরা তার এই উদ্ভট মন্তব্যের সঙ্গে কোনোভাবেই একমত নয়। কারণ, আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে নির্বাচনের আয়োজন করা এই সরকারের দায়িত্ব না। এই সরকারের দায়িত্ব হলো এমন একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করা, যেখানে সকল দল স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হবে এবং সেখানে সবার জন্য নির্বাচনী পরিবেশ সমান থাকবে। বদিউল সাহেব তার মন্তব্যের সপক্ষে একটি যুক্তি দিয়েছেন- “যেহেতু আওয়ামী লীগের দলীয় প্রধান দেশ ছেড়ে চলে গেছেন, নেতারা পলাতক, সুতরাং এ পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে নির্বাচনটি অগ্রহণযোগ্য হবে না।” এখানে আমাদের প্রশ্ন হলো- নির্বাচন কী আগামী ২/৩ মাসের মধ্যে হচ্ছে? নিশ্চয়ই না। ড. ইউনূস নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের জন্য যে কমিশন গঠন করেছেন তারা সেই সংস্কারের জন্যই সময় পেয়েছেন ৩ মাস। তারপর তাদের সুপারিশ নিয়ে হবে আলোচনা এবং তারপর গঠিত হবে নির্বাচন কমিশন। তাহলে তিনি এতো আগে কীভাবে অনুমান করলেন আওয়ামী লীগ সংগঠিত হতে পারবে না? আমরা সকলেই জানি আওয়ামী লীগ রাজপথে আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে গড়ে উঠা একটি ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক সংগঠন। তৃণমূলে এ দলের ভিত্তি খুবই শক্ত। এখন প্রশ্ন হচ্ছে বদিউল আলমরা কী এমন একটি নির্বাচনী ব্যবস্থা সৃষ্টি করতে চান, যে ব্যবস্থায় আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণেরই কোনো সুযোগ থাকবে না? এমনটি করতে চাওয়া দেশের জন্য শুভকর কিছু হবে না।
আমরা মনে করি, প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনী পরিবেশ থাকলে আওয়ামী লীগ নিশ্চয়ই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে। অতীত ইতিহাসও তা-ই বলে। কাজেই আমরা এমন একটি নির্বাচনী পরিবেশ চাই না, যে পরিবেশের কারণে আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপির মতো বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন বয়কট করে। সুতরাং নির্বাচন সংস্কার কমিশনে যারা থাকবেন তাদের প্রত্যেককেই মাথায় রাখতে হবে- প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন কখনোই দেশকে ভালো কিছু দেয় না। আওয়ামী লীগ এবং তার গৃহপালিত বিরোধী দল জাতীয় পার্টিকে নিয়ে বিগত ৩টি নির্বাচন করে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে। কিন্তু ফলাফল কী তা জাতির কাছে স্পষ্ট।
রাষ্ট্র পরিচালনায় যারা ছিলেন, ধরে নিলাম তারা এবং তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি স্বৈরাচার, দুর্নীতিবাজ, অর্থপাচারসহ নানা অপরাধে অভিযুক্ত, তাদের সবাই পালিয়ে গেছেন কিংবা আত্মগোপনে রয়েছেন। কিন্তু সেই দলের আদর্শ যারা বিশ্বাস করেন তারা কী পালিয়ে গিয়েছেন? না, তারা কিন্তু দেশেই আছেন এবং সেই সংখ্যাটিও অনেক বড়।
আমরা সকলেই জানি আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুটি দলেরই প্রায় ৩৫% করে নিজস্ব ভোটার রয়েছে। এতো বৃহৎ একটি দলকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করলে সেটি কী গ্রহণযোগ্য হবে? সেটি নিশ্চয়ই গ্রহণযোগ্য হবে না। হ্যাঁ, আওয়ামী লীগের গত ১৬ বছরের কৃতকর্মের কারণে দলটির জনপ্রিয়তা কিছুটা কমেছে। কিন্তু কতটুকু কমেছে কিংবা কতটুকু বেড়েছে সেটি জানার জন্য প্রয়োজন একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন। আমরা আশা করব অন্তর্বর্তী সরকার সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি করার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। অন্তর্বর্তী সরকার যদি আওয়ামী লীগসহ এক বা একাধিক দলকে বাদ দিয়ে নির্বাচন করে সেটি রাজনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা কখনোই পাবে না। সেটির বিরুদ্ধে এখন যারা নীরব আছে তারা কিন্তু একসময় উচ্চকণ্ঠ হবেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিন্তু ইতোমধ্যে তৎপরতা আমরা লক্ষ করছি, ভবিষ্যতে হয়তো আরও বাড়বে। যারা অপরাধ করেছে তাদের প্রত্যেকের আপনারা বিচার করেন, এতে আমাদের কোনো আপত্তি নাই। কিন্তু একটি রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য সমান সুযোগ না দিতে চাইলে সেখানে আমাদের অবশ্যই আপত্তি আছে।
বদিউল আলম মজুমদারের সংগঠন সুজনের পক্ষ থেকে ২০১৩ সালের ১৬ নভেম্বর বলা হয়েছিল বিএনপিকে ছাড়া নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। কিন্তু সেই সংগঠন সম্পাদক ২০২৪ সালে এসে বললেন আওয়ামী লীগকে ছাড়াও নির্বাচন অগ্রহণযোগ্য হবে না! তার এই বক্তব্যে আমরা খুবই বিচলিত। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের জন্য তিনি যে একজন অযোগ্য ব্যক্তি এটি তিনি তার মন্তব্যের মাধ্যমেই প্রমাণ করেছেন। এখন প্রশ্ন উঠছে, মজুমদার সাহেব নির্বাচন ব্যবস্থার যে সংস্কার করবেন সেটি দেশের মানুষের কাছে কতটুকু গ্রহনযোগ্য হবে? তিনি কী আওয়ামী লীগকে নির্বাচন থেকে বাইরে রাখার জন্য নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার করছেন? কিংবা আওয়ামী লীগ কী তার সংস্কারকে মেনে নিবে? তার বালখিল্য মন্তব্যই জনমনে এধরনের প্রশ্ন সৃষ্টি করছে। এমতাবস্থায় নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধানের দায়িত্ব থেকে বদিউল সাহেবের স্বেচ্ছায় সরে যাওয়াই এসব প্রশ্নের একমাত্র সমাধান।
সবশেষে বলতে চাই, সংস্কার কমিশনসহ অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বশীলদের মনে রাখতে হবে- গণতন্ত্র মানে একদলের শাসন ব্যবস্থা নয়, গণতন্ত্র মানে একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সমর্থনপুষ্ট দলকে নিষিদ্ধ কিংবা দমনমূলক শাসন নয়।
লেখক: কবি ও সাংবাদিক