১.
‘গেস্টরুমে চোরের হাত বেঁধেছে জালাল। সুমন চোখ বন্ধ করে মেরেছে তাকে। মারতে মারতে ও (তোফাজ্জল) পড়ে গেছে। এরপর পানি এনে তাকে পানি খাওয়ানো হলে সে উঠে বসে। এ সময়ে সবাই হাততালি দেয়।’
হ্যাঁ, এটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চোর সন্দেহে অনেকটা অপ্রকৃতিস্থ তোফাজ্জল নামের এক যুবককে গ্যাং পদ্ধতিতে পিটিয়ে মারার বর্ণনার একাংশ। আধামরা হওয়ার পরে শিক্ষার্থীদের মনে হলো এত মার খেয়েছে, নাহয় কিছু ভাতও খাক। খাইয়ে নিয়ে আবারও মারা হলো তাঁকে। মারতে মারতে তাঁকে মেরেই ফেলা হলো।
এক থালা ভাতের জন্য দৈনিক কে জানে কত মানুষ হাপিত্যেশ করে। কতজনের কপালে বিনা পরিশ্রমে জোটে এক থালা ভাত? তাই খেয়ে ফেলাই শ্রেয়। দেশের মানুষ এর আগে বহুরকম ভাত খাওয়ার দৃশ্য দেখেছে। কিন্তু এত বেদনাদায়ক ভাত খাওয়ার প্রস্তুতি, এত নির্মম লোকমা কেউ কি দেখেছেন কখনো!
২.
যা হোক, গ্যাং বিষয়টা তো এমনই ‘মব’ বা ‘ফিক্ল’। ‘মব মনস্তত্ত্ব’ বড় অদ্ভুত জিনিস। একবার মধ্যরাতে দিল্লিতে এক ঝোঁপের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ে দুজন সাইকেল আরোহী একটা মেয়ের আর্তনাদ শুনতে পায়। সাইকেল থেকে নেমে তারা দ্রুত যায় কল্পিত কোনো জীবজন্তুর হাত থেকে একজন মানুষ কিংবা সমাজে ঊনমানুষ হিসেবে বিচরণকারী কোনো নারীকে উদ্ধার করতে। গিয়ে দেখে সেখানে দশ-বারোজনের গ্যাং তাকে ধর্ষণ করছে। উদ্ধার করার চিন্তা মাথা থেকে সরিয়ে তখন তারা তাৎক্ষণিকভাবে সেই ধর্ষণে অংশ নেয়। ‘মব’ হয় এ রকম, যুক্তি কাজ করে না, বোধবুদ্ধি কাজ করে না।
যে কারণে সেই যে এক নারী, রেণু তার বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তি করাতে এসেছিলেন, ছেলেধরা সন্দেহে তাকে পাশ দিয়ে যে গেছে সে-ই কিল-ঘুষি লাগিয়ে গেছে। কারও জানতে ইচ্ছে করেনি, কাকে মারছে, কেন মারছে। সমাজের অসংখ্য অসংগতির নিষ্পেষণে মানুষের বুকে ক্ষোভের পাহাড় থাকে আইসবার্গের মতো লুকিয়ে। হাত নিশপিশ করে, কাউকে পেলে খুব একহাত দেখে নেওয়া যেত!
ধরুন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নিগ্ধ পরিবেশে আপনি বায়োটেকনোলজি ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েন। কিন্তু আপনার মূল ইচ্ছা ছাত্রলীগের জেনেটিক পরিবর্তন করে দেওয়ার। সে জন্য আপনি বিচারের অপেক্ষা করবেন না। কেন করবেন, আপনার হাতে আছে ইয়া বড় লাঠি। ব্যস, ব্যবহার করুন। মারতে মারতে হয়রান হয়ে গেলে আধামরা ছেলেটিকে নিরাপত্তা শাখায় নিয়ে যান, যেন সেখানে প্রক্টরিয়াল টিমের উপস্থিতিতে আরেক গ্যাংও যেন তাকে মারতে পারে। এরপর তার মৃত্যু হলে প্রতিপক্ষ নিধনের গর্ব তখন বুকে ভর করে।
ঢাকা আর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের আর মুখ দেখানোর জায়গা থাকে না। যেন কী এক পবিত্র স্থান ছিল এগুলো! ঢাকার কথা তো বলাই বাহুল্য, বছর বছর খুনজখম, নারীকে হেনস্থা করা থেকে শুরু করে কিছুই যেখানে বাদ নেই।
জাহাঙ্গীরনগরে প্রায় জন্মলগ্ন থেকে ছাত্রহত্যা শুরু হয়েছে। অন্তত সাতজনকে পিটিয়ে মারা হয়েছে তখন থেকে। ১৯৭৩ সালে প্রথম হত্যা করা হয় জাকসুর প্রথম সাধারণ সম্পাদক জাসদ নেতা বোরহান উদ্দীন রোকনকে। সেই পথ ধরে ১৯৯৪ সালে ইংরেজি বিভাগের ছাত্র দীপুর হত্যাকাণ্ড ভোলার নয়। অনেক পরে আরেকজন জুবায়ের হত্যাকাণ্ড তো বিচারের কাঠগড়ায় প্রায় পৌঁছেও গেছিল। কিন্তু বিচার…সে এক সোনার হরিণ নাকি ডুমুরের ফুল!
৩.
কিন্তু আগের দিনের কথা আর আজকের কথা এক নয়। এদিকে মাত্র কয়েক দিনে কী কী হলো তার কিছু মনে করে নিই। গত ৬ আগস্ট চাঁদপুর সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়ন পরিষদের বহুল সমালোচিত উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, সেলিম খান, যিনি কিনা চলচ্চিত্র পরিবেশক ও নির্দেশক, তাঁর ছেলে অভিনেতা শান্ত খানসহ দুইজনকে গণপিটুনি খেয়ে মরতে হলো। চাঁদপুর থেকে বালু পদ্মা-মেঘনার মোহনা অঞ্চলে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের দায়ে সেলিম খানকে জেলেও যেতে হয়েছিল। দুদকে তাঁর বিরুদ্ধে মামলাও ঝুলছে। কিন্তু তাই বলে তাঁকে কি রাস্তায় পেলেই পিটিয়ে মারা যায়?
আগের দিনের কথা আর আজকের কথা এক নয়।
গত ১১ আগস্ট দুজন মানুষ—শুভ মেরাজ (২০) ও তারেক (২৭) দিনাজপুর সদর উপজেলায় একটি অটোরিকশা ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে অটোরিকশাওয়ালাকে উপর্যুপরি ছুরিকাহত করছিলেন। এ রকম সময়ে আশপাশে থাকা মানুষ ছুটে এসে শুভ ও তারেককে পিটিয়ে মেরে ফেলেছেন। মানুষ পুলিশি কায়দায় ঘোরাফেরা করছে। যার চোখে যা অন্যায় মনে হবে, সংশ্লিষ্ট মানুষকে শুধু পিটিয়ে মেরে ফেললেই হলো।
৪.
একটা দেশে যেকোনো অবস্থায় যেকোনোখানে যখন সাংবিধানিক বিচারবিহীন হত্যাকাণ্ড ঘটে, তখন তা সেই দেশের সার্বিক আইন পরিস্থিতির দুর্বলতা প্রকাশ করে। এভাবেই আমরা দীর্ঘকাল চলেছি। আমরা যে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি, তার অজস্র উদাহরণ ঠিক এ রকমের অজস্র হত্যা আর গুম। সেই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসব বলেই আমরা নতুন ভাবনায় জাগ্রত হয়ে একটি সরকার প্রতিষ্ঠা করেছি।
আজ তাই কেবল ‘পুলিশ নিষ্ক্রিয়’ ভেবে নিলেই সমাস্যার সমাধান হয় না। পুলিশ এখন রোদ-বৃষ্টির অজুহাতে দায়িত্বের জায়গার কাছাকাছি কোথাও নিরাপদ স্থান দেখে হাত-পা ছড়িয়ে বসে থাকে। মানুষের সামনে আসতে ভয় পায়। তাদের নিয়ে হয়তো বহু কাজ করার আছে। সময় প্রয়োজন। কিন্তু আমরা আগে যেমনটা বলতাম, একটি বিচার করুন। অন্তত একটি বিচার করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন। মানুষের ‘যা খুশি তাই’ করার মানসিকতার গোড়ায় রাশ টেনে ধরুন। আজও তাই বলছি, অন্তত একটি বিচার করুন। তার পর থেকে অনেক কিছুই হয়তো বদলে যাবে। আমাদের ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা কমে আসবে।
এ দেশের মানুষ কে জানে কত দিন ধরে কেবল ‘বিচার চাই বিচার চাই’ বলে জিকির করছে। একটা বিচার কি এতটাই অধরা! নানা রকমের বিচারের প্রতিশ্রুতি নিয়েই তো আজ একটা সম্ভাবনাময় রাস্তার মোড়ে এসে পৌঁছেছি আমরা। এখানে দাঁড়িয়ে নিজেদের বুকে হাত দিয়ে প্রশ্ন করতে হবে, আমরা কি ন্যায়বিচারের দিকে যেতে চাই? তবে সব বাধা অতিক্রম করে আমাদের সেদিকেই যেতে হবে। সেদিকটা নিশ্চয় সহজ হবে না। ন্যায়ের পথ কখনো সহজ হয় না। সহজে একজনকে পিটিয়ে মেরে ফেলা যায়। বিশেষ করে দলবদ্ধ হলে তো কথাই নেই। কিন্তু শিকার যত বড় অপরাধী হোক না কেন, হিংসা বা ক্রোধের বশবর্তী হয়ে আর একটিও বিচারবিহীন হত্যাকাণ্ড যেন না ঘটে, তার ব্যবস্থা করা মোটেও তত সহজ হবে না। কিন্তু কঠিন কাজ করা হবে বলেই তো মাসব্যাপী এত মৃত্যু, এত আয়োজন হয়েছিল!
৫.
অভিজিৎ রায় হত্যার পরে তাঁর বাবা অজয় রায় স্যার বলেছিলেন, ‘বিচার চাই না। মানুষের শুভবুদ্ধির উদয় হোক।’ বিচার তো হয়ইনি, শুভবুদ্ধির উদয়েরও কোনো সম্ভাবনা দেখা যায়নি। মানুষ দিনে দিনে ক্ষমতার উন্মত্ততায় হিংস্র, অমানবিক সাইকোপ্যাথে রূপান্তরিত হয়েছে। ফ্রয়েডের শিক্ষায় যেমন ‘বেসিক ইন্সটিংক্ট’ আর সুপার ইগো মিলে মানুষকে ‘ইগো’ পর্যায়ে ঝুলিয়ে রাখে, এ যেন পুলিশ তথা আইনবিহীন সময়ের এমন এক বাস্তবতা, যেখানে সুপার ইগো হারিয়ে মানুষ কেবল বেসিক ইন্সটিংক্টের দিকে ধাবিত হচ্ছে। তাই তার ভেতর থেকে কলুষিত মেজাজের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। হায়, মানুষ কবে মানুষ হবে?
না, নিচে থেকে কিছু ওপরের দিকে যায় না। পরিবর্তন মাধ্যাকর্ষণ বিশ্বাসী নীতি। ওপরে পরিবর্তন ঘটলে ধীরে ধীরে নিচে ঘটবে। এখনো আশা করছি, পরিবর্তন ঘটবে। সব শান্ত হবে, অন্তত একটা বিচার করুন। যেদিন বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষের ন্যূনতম আস্থা ফিরে আসবে, সেদিন মানুষ আর আইন নিজের হাতে তুলে নেবে না। সেই পুরোনো বহিষ্কার আর তদন্ত কমিটির চক্কর, হরেদরে মামলা—এসব কেবল আশাহত পুনরাবৃত্তি। জবাবদিহিমূলক আইনের শাসন ফিরে আসুক। বিক্ষিপ্ত হয়ে যাওয়া দেশ আবারও কোনো একভাবে উঠে দাঁড়াবে—এই বিশ্বাস অটুট থাকুক।
লেখক: সাহিত্যিক ও অনুবাদক