রাষ্ট্র তারুণ্যকে ভয় করে; সমাজও যে তারুণ্যকে পছন্দ করে, তা নয়। তারুণ্যকে দমিত করার সব ব্যবস্থা রাষ্ট্র নিজের অভ্যাসবশতই করে থাকে; সমাজও তাতে যোগ দেয়। যেমন গণতন্ত্রের প্রাথমিক শিক্ষা তরুণরা পেতে পারত শিক্ষায়তনিক ছাত্র সংসদ থেকেই। ছাত্র সংসদ আগে ছিল; এমনকি সামরিক শাসনকালেও ছাত্র সংসদকে বিলুপ্ত করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু ১৯৯১ সালে, স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের পর থেকে ‘গণতান্ত্রিক’ সরকাররা যখন ক্ষমতায় আসা-যাওয়া শুরু করল, তখন থেকেই ছাত্র সংসদ লুপ্ত হয়ে গেল। চলল ক্ষমতাসীন দলীয় ছাত্র নামধারীদের স্বৈরাচার।
এই যে ‘অগ্রগতি’; এর তাৎপর্য কী? তাৎপর্য হলো, রাষ্ট্র আরও বেশি স্বৈরতান্ত্রিক হয়েছে, যাত্রা করেছে ফ্যাসিবাদের অভিমুখে, যার আপাত-চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটেছিল পতনপূর্বে শেখ হাসিনার জমিদারতন্ত্রে। তরুণরা গুন্ডা-বদমাশ হোক, মাদকের পাল্লায় পড়ুক, তারুণ্য গোল্লায় যাক, কিশোর গ্যাং গঠিত হোক– কোনো কিছুতে আপত্তি তো নেই-ই, বরং সাগ্রহ অনুমতি আছে। কারণ তরুণ যত তার তারুণ্য খোয়াবে, শাসকদের গদি ততই পোক্ত হবে। সোজা হিসাব!
বৈষম্য-বিরোধিতার আওয়াজটা কিন্তু মোটেই নতুন নয়। এটি বঞ্চিতদের অতি পুরোনো রণধ্বনি; কিন্তু তাকে বারবার তুলতে হয়। কারণ বৈষম্য দূর হয় না। হবেও না যদি ব্যবস্থা না বদলায়। ব্যবস্থা না বদলালে বৈষম্য বাড়তেই থাকবে এবং বাড়ছেও।
ঊনসত্তরের ব্যবস্থা-কাঁপানো ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানের পর মওলানা ভাসানী তাঁর সেই অসামান্য তরুণ কণ্ঠে আওয়াজটা নতুন করে তুলেছিলেন। বলেছিলেন, ‘কেউ খাবে আর কেউ খাবে না, তা হবে না তা হবে না’। বিশ্ববরেণ্য এক কবিতার বুঝি প্রথম পঙ্ক্তি। ওই ঊনসত্তরেই ভাসানীপন্থি তরুণ আসাদ যখন স্বৈরাচারী আইয়ুব খানের লেলিয়ে দেওয়া পুলিশের গুলিতে শহীদ হন, তখন তাঁর সহযোদ্ধারা স্লোগান দিয়েছিলেন, ‘আসাদের মন্ত্র জনগণতন্ত্র’। একই আওয়াজ, ভিন্ন শব্দগুচ্ছে। আসাদের পূর্বসূরি বায়ান্নর শহীদ বরকতও ছিলেন একই রাজনৈতিক ধারার। সে ধারাও বৈষম্য-বিরোধিতারই; রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে।
ওই ধারা জয়যুক্ত হয়নি। যে জন্য বারবার আমাদের আন্দোলনে যেতে হচ্ছে; ঘটাতে হচ্ছে নতুনতর অভ্যুত্থান। অভ্যুত্থান জনগণই ঘটায়, কিন্তু ক্ষমতায় রয়ে যায় বুর্জোয়ারাই। নতুন পোশাকে, নতুন নামে, নতুন ভাষায় তারাই আসে; বারবার ফিরে ফিরে ঘুরে ঘুরে। পরের শাসক আগের শাসকের তুলনায় অধিকতর নির্মম হন।
বুর্জোয়া শাসনের পতন কোনোকালেই ঘটবে না, যদি না পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বিদায় নেয়। আমাদের দেশে রাজনীতিতে দল অনেক, কিন্তু ধারা মাত্র দুটি। একটি বুর্জোয়াদের, অপরটি জনগণের। বুর্জোয়া ধারাটিই প্রধান। আওয়ামী লীগ, বিএনপি থেকে শুরু করে জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম– সবাই এর অন্তর্ভুক্ত। অতিশয় ভদ্র উদারনৈতিকরা যেমন ভয়াবহ রকমের, রক্ষণশীলরাও তেমনি এ ধারার অন্তর্গত। বাইরে যা হোন না কেন, অন্তরে তারা সবাই ব্যক্তিমালিকানা ও ব্যক্তিগত মুনাফায় বিশ্বাসী এবং পুঁজিবাদের সমর্থক।
এই ধারার বিপরীতে এবং সম্পূর্ণরূপে বিপক্ষে রয়েছে জনগণের পক্ষের রাজনৈতিক ধারা। সেটি সমাজতান্ত্রিক। সমাজতন্ত্রীরা চান সামাজিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ব্যক্তিমালিকানার অবসান ঘটিয়ে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে মানুষের সঙ্গে মানুষের অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে। সামাজিক সম্পর্কগুলোকে মানবিক করতে ও টিকিয়ে রাখতে। কিন্তু আমাদের দেশের সমাজতন্ত্রীদের প্রধান দুর্বলতা ঐক্যের অভাব। পুঁজিবাদীদের জন্য কিন্তু সেই সমস্যাটা নেই। তাদের মধ্যে ঝগড়া আছে অবশ্যই, খুনোখুনিও ঘটে; কিন্তু আদর্শগত লক্ষ্যে তারা ঐক্যবদ্ধ। সে লক্ষ্যটা হলো পুঁজিবাদী ব্যবস্থা চালু রাখা। এ ক্ষেত্রে তারা একাট্টা এবং তাদের সবার সুনির্দিষ্ট শত্রু হলো সমাজতন্ত্রীরা। বুর্জোয়াদের সাধনা শোষণ ও নিপীড়নের মধ্য দিয়ে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনকে ছিন্নভিন্ন করে দেওয়ার।
দ্বন্দ্বের ওই নাটকটা চলছে, অভ্যুত্থানও ঘটছে, কিন্তু বৈষম্য ঘুচছে না। ক্ষমতা রয়ে যাচ্ছে নিপীড়ক বুর্জোয়াদের হাতেই। হাতবদল ও হাতসাফাই-ই ঘটছে শুধু, খেলার তাসের মতো। সেই ক্ষমতা ধরে রাখার প্রয়োজনেই বুর্জোয়ারা রাষ্ট্রযন্ত্রকে দানবে পরিণত করতে চায়। নিষ্ঠুরতা বৃদ্ধি পায়; কারণ বিক্ষুব্ধ মানুষের সংখ্যা বাড়ে, তারা বিক্ষোভ করে, বিদ্রোহে অংশ নেয় এবং সম্ভাবনা দেখা দেয় পুঁজিবাদবিরোধী সংগ্রামটা জোরদার হওয়ার। আমাদের দেশের সমাজতন্ত্রীরা সব গণঅভ্যুত্থানেই থেকেছেন, অভ্যুত্থানের চালিকা শক্তি হিসেবে কাজও করেছেন; কিন্তু তারা নেতৃত্ব দিতে পারেন না, বিভক্তি ও বিভ্রান্তির কারণে।
এবারের গণঅভ্যুত্থানে তারুণ্যের জয় হয়েছে। রাস্তার পাশে দেয়ালে দেয়ালে যেসব লেখা ফুলের মতো ফুটে উঠেছে, তাতে দেখি সেই তারুণ্যের প্রকাশ, যাকে দমন করে রাখা হয়েছিল। দেয়ালে অপেশাদার হাতে যেসব ছবি ও লেখা দেখা যাচ্ছে; তাদের ভাষা, বক্তব্য ও আঙ্গিকে বিভিন্নতা আছে। বৈচিত্র্য লক্ষ্য করার মতো। বাগানে যেন নানা রঙ ও রকমের ফুল ফুটে উঠেছে, সাত সকালে। ওইসব দেয়াল আগে বিভিন্ন ধরনের বিজ্ঞাপনে আচ্ছন্ন থাকত। তরুণরা যেসব লেখা লিখছে তাতে ব্যবসার বিজ্ঞাপন গেছে মুছে, এবং যা প্রকাশ পাচ্ছে তাতে বাণী একটাই– সেটা বিদ্রোহের। দেয়াল ভাঙার গানে দেয়াল এখন মুখরিত। যদিও দেয়ালের লিখন শাসক শ্রেণি পড়তে জানে না; কারণ তারা পড়তে চায় না।
দেয়াল আগেও ছিল; কিন্তু বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর যত দেয়াল উঠেছে, তত দেয়াল এ দেশের মানুষ আগে কখনও দেখেনি। দেয়ালে দেয়ালে পাহারাও দিনে দিনে বাড়ছিল এবং দেয়ালের কানও ছিল। সবটাই ব্যক্তিগত সম্পত্তি রক্ষার আয়োজন। দেয়ালের নতুন লিখন এখন যেন সামাজিক মালিকানার পক্ষে অবস্থানের ঘোষণা। যেন বিচ্ছিন্নতাকে ‘না’ বলা। সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার জন্যই পুরোনো সব লেখা ও ছবি মুছে ফেলে দিয়ে নতুন অঙ্কন চলে এসেছে। ওই অঙ্কনের সৌন্দর্য ভিন্ন রকমের; এর আঁকাবাঁকা হরফে, কার্টুনে, ছবিতে, স্লোগানে, রঙের যে দুঃসাহসী প্রয়োগ তার সৌন্দর্য জীবন্ত হয়েছে ভেতরের প্রাণবন্ততায়।
লিটল ম্যাগাজিন যেমন গ্রেট হয়ে ওঠে প্রতিষ্ঠিত বাণিজ্যিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর কারণে, দেয়ালের লেখাও তেমনি এবং একই বিদ্রোহের কারণে আশা জাগানিয়া। পত্রপত্রিকা থেকে কার্টুন কিন্তু একেবারেই উধাও হয়ে গিয়েছিল। কার্টুন আঁকা কতটা যে বিপজ্জনক হয়ে পড়েছিল. তার সাক্ষী কার্টুনিস্ট কিশোর এবং ক্যাপশন লেখক মুশতাক আহমদ। কোনো রাজনৈতিক নেতার নয়; একজন ব্যবসায়ীকে নিয়ে কার্টুন আঁকার অপরাধে ২০২১ সালের ২ মে কিশোরকে এবং ৪ মে মুশতাক আহমদকে তুলে নিয়ে যায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গ্রেপ্তারের পর ১০ মাসে ছয়বার জামিনের আবেদন করে ব্যর্থ হন তারা। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে কাশিমপুর কারাগারে মারা যান মুশতাক আহমদ; পরের মাসে জামিন পান কিশোর।
ব্যঙ্গ করা হয়েছিল; ব্যবসায়ী তিনি নিশ্চয়ই সরকারি দলের লোক ছিলেন; নইলে অত ক্ষমতা পেলেন কোথা থেকে? স্বৈরাচার নিজের জয়ধ্বনি শুনতে চায়, ব্যঙ্গবিদ্রূপ দেখলে বা শুনলে ক্ষিপ্ত হয়ে উদ্যত হয় প্রহারে। দেয়ালে এখন ব্যঙ্গচিত্র এঁকেছে তরুণরা, ওই চিত্র যখন দেয়াল থেকে দক্ষ হাতে অঙ্কিত হয়ে পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় চলে আসবে, তখন আমরা আশ্বস্ত হবো যে অবস্থার কিছুটা বদল ঘটেছে।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইমেরিটাস
অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়