রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা হলের আবাসিক শিক্ষার্থীদের একাংশ ওই হলের মেয়েদের পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করেছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক জামিরুল ইসলাম। ওই শিক্ষার্থীদের পুলিশ ও সেনাবাহিনীর মাধ্যমে থানায় দিয়ে চালান দেওয়ারও হুমকি দেন তিনি। এ-সংক্রান্ত একটি অডিও রেকর্ড সাংবাদিকদের হাতে এসেছে।
ওই অডিওতে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে প্রাধ্যক্ষকে বলতে শোনা যায়, ‘তোমাদের বিরুদ্ধে সিরিয়াস অভিযোগ আছে। তোমরা এই হলের মেয়েদের প্রস্টিটিউশনে (পতিতাবৃত্তি) বাধ্য করেছ। কে করেছ, কারা করেছ এসব পরের কথা। তোমরাই করেছ। ছাত্রলীগ করেছে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা হলে ছাত্রী নিপীড়ক ও ছাত্রলীগের পদধারী নেত্রীদের হল ত্যাগের নির্দেশ দেন হল প্রাধ্যক্ষ। তবে যাঁদের আবাসিকতা আছে এবং যাঁদের বিরুদ্ধে কোনো লিখিত অভিযোগ নেই কিন্তু ছাত্রলীগের পদে আছেন, তাঁরা নির্দেশ অমান্য করে হলেই অবস্থান করেন। ফলে হলে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। পরিস্থিতি শান্ত করতে কয়েকজন হল প্রাধ্যক্ষসহ শিক্ষার্থীদের নিয়ে আলোচনায় বসেন বঙ্গমাতা হল প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক লাভলী নাহার।
আলোচনার একপর্যায়ে অধ্যাপক জামিরুল ইসলামকে কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয়। তখন তিনি ওই ছাত্রীদের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ তুলে হুমকি দেন। তাঁর এ ধরনের মন্তব্যকে দায়িত্বজ্ঞানহীন ও অভিভাবকসুলভ নয় বলে উল্লেখ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক ও হল প্রাধ্যক্ষরা।
কথার শুরুতে অধ্যাপক জামিরুল ইসলাম ছাত্রীদের উদ্ভূত পরিস্থিতি বোঝানোর চেষ্টা করেন। তিনি তাঁদের এক মাসের জন্য হলের বাইরে থাকার অনুরোধও করেন। তবে একপর্যায়ে তিনি উপস্থিত ছাত্রীদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ তোলেন। তিনি শিক্ষার্থীদের ধর্ষণের সহযোগী বলে দাবি করেন।
অধ্যাপক জামিরুল ইসলাম ছাত্রীদের হলছাড়া করার হুমকি দিয়ে আরও বলেন, ‘পুলিশ ফোর্স, সেনাবাহিনী সবকিছু রেডি আছে। তোমরা যদি উল্টাপাল্টা কিছু করো, তাহলে প্রত্যেক মেয়েকে এখান থেকে অ্যারেস্ট করে থানায় নিয়ে গিয়ে চালান দেওয়া হবে। সবকিছু আমাদের কাছে আছে।’
যারা ছাত্রলীগের পদধারী, তাদের প্রত্যেককেই চলে যাওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘তুমি পোস্টেড ছিলা কিনা, তুমি দরিদ্র, তোমাকে জোর করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, আজ তোমাদের মুখ থেকে এসব গান বের হচ্ছে। এসব কোনো গান চলবে না। যারা পোস্টেড ছিলা, তাদের চলে যেতে হবে।’
ওই ছাত্রীদের ধর্ষণের সহযোগী আখ্যা দিয়ে প্রাধ্যক্ষ আরও বলেন, ‘তোমরা জানো, এই আন্দোলন করতে গিয়ে কতগুলো মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছে তোমাদের কারণে? শুধু ৫ তারিখের (৫ আগস্ট) আন্দোলনেই কতগুলো মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছে তোমরা জানো? এই ধর্ষণের সহযোগী কারা? তোমরা।’
ওই রেকর্ডে এই শিক্ষককে আরও বলতে শোনা যায়, ‘আমি তোমাদের দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, তোমরা যারা এই পোস্টে আছ, পোস্টে ছিলা, নিপীড়নকারী, মাদক কারবারি, মেয়েদের উত্ত্যক্তকারী, তোমরা দয়া করে এক মাসের জন্য হল থেকে চলে যাও। তোমাদের সব ডকুমেন্ট আমাদের কাছে আছে।’
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান বলেন, ‘এ তো মারাত্মক কথা। একজন শিক্ষক কখনোই এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন কথা বলতে পারেন না। কেউ যদি অভিযুক্ত হয়ে থাকে, তাহলে তদন্ত করে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। তবে রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে কারও বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে এমন অভিযোগ করা সমীচীন নয়।’
একজন হল প্রাধ্যক্ষের এ ধরনের মন্তব্যকে শিক্ষকসুলভ নয় উল্লেখ করে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘এটি কোনো শিক্ষকসুলভ বা অভিভাবকসুলভ আচরণ নয়। এ ধরনের শব্দ প্রয়োগ সঠিক নয়। যদি কোনো প্রমাণ না থাকে, তাহলে আমরা কাউকে এভাবে দোষারোপ করতে পারি না বা অপবাদ দিতে পারি না।’
এক হলের প্রাধ্যক্ষ আরেক হলে গিয়ে শিক্ষার্থীদের শাসন করা ঠিক নয় উল্লেখ করে অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আরও বলেন, ‘এক হল থেকে গিয়ে আরেক হলের শিক্ষার্থীদের শাসন করা ঠিক নয়। তবে কোনো হল প্রাধ্যক্ষ যদি কখনো সংকটে পড়েন, তাহলে আমরা তাঁর পাশে দাঁড়াতে পারি। তার মানে এই না যে আমরা এ ধরনের বাক্য প্রয়োগ করে তাকে আরও বড় ধরনের বিপদের দিকে ঠেলে দেব।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক জামিরুল ইসলাম বলেন, ‘এটা আমার কথা নয়, শিক্ষার্থীদের কথা। শিক্ষার্থীদের অভিযোগের ভিত্তিতে আমি এটা বলেছিলাম। ওই কথাটা আমি ইনফরম্যালি বলেছি। তবে এটা মোটেও ঠিক হয়নি। আমার রিকোয়েস্ট থাকবে, তোমরা এগুলো নিয়ে লিখো না।’
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ হাসান নকীব বলেন, ‘যিনি এ ধরনের মন্তব্য করেছেন, তাঁর কাছে কোনো তথ্যপ্রমাণ আছে কি না, সেটা একটা বিষয়। যদি থাকে তাহলে এক বিষয় আর না থাকলে অন্য বিষয়। তবে বিষয়টি আমি অবগত নই। আমি বিষয়টি দেখব।’