চলমান দমবন্ধ পরিবেশে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাহেব এবং দলটির নেতাদের সকাল-বিকাল ডিগবাজি খাওয়ার দৃশ্য জনগণকে বিনেপয়সাতে বিনোদনের খোরাক জোগাচ্ছে। বিএনপি নেতারা ঘুম থেকে উঠে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারকে আর সময় দেয়া যাচ্ছে না, নির্বাচিত সংসদ ও সরকারই সংস্কার করবে। সুতরাং দ্রুত নির্বাচন দাও। আর বিকেলে বলছে, সবাইকে একটু শান্ত থাকতে হবে, এই সরকারকে টিকিয়ে রাখতে হবে, আমরা তাদেরকে সংস্কারের জন্য যৌক্তিক সময় দিতে চায়! এই ধৈর্য হারা হয়ে যাচ্ছে, পরক্ষণেই একটি প্রভাবশালী পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের চোখ রাঙানিতে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ধৈর্যের পরম পরাকাষ্ঠা দেখাচ্ছে!
বাংলাদেশসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ইতিহাস ঘেটে সঞ্চিত অভিজ্ঞতা থেকে আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক এতটুকু বুঝতে পেরেছে- সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই দুর্নীতি ছিল, বর্তমানেও আছে এবং ভবিষ্যতেও এটি থেকে মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ! আর গণতন্ত্র, সেটির চরিত্রেও রাষ্ট্রভেদে ভিন্নতা লক্ষণীয়। পুঁজিবাদের জন্য গণতন্ত্রের সংজ্ঞা একরকম, সমাজতান্ত্রিকদের জন্য গণতন্ত্রের সংজ্ঞা আরেক রকম। যার জন্য বাইডেন-ম্যাঁক্রো সাহেবদের দেশের গণতন্ত্রের সঙ্গে পুতিন-শি জিং পিং সাহেবদের দেশের গণতন্ত্রের মধ্যে আকাশপাতাল তফাৎ। দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোয় ‘আধা গণতন্ত্র ও আধা স্বৈরাচার’-এই পদ্ধতি চর্চা বিদ্যমান। আমাদের দেশে জিয়াউর রহমানের সরকার, এরশাদের সরকার কিংবা খালেদা জিয়ার সরকার, এদের কেউই পশ্চিমা গণতন্ত্রের ধারক ছিলেন না। সবারই গণতন্ত্র শুধু তাদের নিজেদের সমর্থকদের জন্য ছিল, আর স্বৈরাচার ছিল বিরোধীদের জন্য। অর্থাৎ “অর্ধেক গণতন্ত্র আর অর্ধেক স্বৈরতন্ত্র”।
সেই পথ ধরেই বেগম খালেদা জিয়া ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি একতরফা নির্বাচন করেছিলেন কিন্তু দেড় মাসও টিকতে পারেননি। সুষ্ঠু নির্বাচন দিয়ে শেখ হাসিনার হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য হন। তারপর ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে বিরোধীদের ওপর শুরু করেন ব্যাপক দমন-পীড়ন এবং নিজেদের ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে নানা ফন্দিফিকির আঁটতে থাকেন। ২০০৬ সালে পুনরায় ক্ষমতায় আসার জন্য পাঁচ-ছয় স্তরের পরিকল্পনা করেছিলেন, সফল হতে পারেননি।
২০০৯ সালে যখন ক্ষমতা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে তখন আমাদের সমুদয় সম্পদের পরিমান ছিল ৯৫ বিলিয়ন ডলারের মতো। সেটা ২০২৪ সালে একটি প্রভাবশালী পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের অর্থায়নে কৃত্রিম আন্দোলন সৃষ্টি করে হাসিনাকে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়ার সময় বেড়ে দাড়িয়েছিল প্রায় ৫০০ বিলিয়ন ডলার। কভিড এসে সারা বিশ্বকে বিধ্বস্ত না করে দিলে এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু না হলে হয়তো এই অংকটা ৮০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতো। টানা চারবার প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় শেখ হাসিনার মধ্যে কিছু স্বৈরাচারী মনোভাব বাসা বেঁধেছিল, তিনি হয়ে উঠেছিল অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী ও অহংকারী, যার কারণে তিনি সমালোচিত হয়েছেন। কিন্তু শত সমালোচনা থাকলেও তার আমলে সারাদেশে যে উন্নয়ন অগ্রগতি সাধিত হয়েছে সেটিও নিশ্চয়ই ইতিহাস থেকে মুছে যাবে না।
কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গিয়ে গত দেড় মাসে ইউনূস সাহেবরা উন্নয়নের গতিপথকে বেশ নিম্নগামী করেছে। গত একমাস আগে অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন সাহেব বলেছিলেন, আমাদের অর্থনীতি দৃঢ় ভিত্তির উপর আছে এবং ঋণ শোধের জন্য পর্যাপ্ত রিজার্ভ আছে। আর গতকাল বললেন, হাসিনা অর্থনীতির বারোটা বাজিয়ে গেছে! তার মানে কী দাড়ালো? তারা এই দেড় মাসেই এদেশের অর্থনীতির বারোটা বাজিয়েছেন।
ইউনূস দেড় মাসে “অর্ধেক গণতন্ত্র আর অর্ধেক স্বৈরতন্ত্র” এই নীতিকে দেশে আরো শক্তিশালী করেছেন। সেটি সম্প্রতি তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া পৃথক ৩টি হত্যাকাণ্ডের গতিপথের দিকে নজর দিলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে। প্রথমটি মাসের শুরুতে (৭ সেপ্টেম্বর) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা পঙ্গু মাসুদকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা। যার মাধ্যমে এতিম করা হয়েছে তার সদ্য জন্মানো কন্যাকে। মৃত্যুর আগে মাসুদ পানি চেয়েছিল, সেটিও পায়নি। হত্যার পেছনে ছাত্রশিবির, ছাত্রদল ও সমন্বয়ক! কিন্তু এ বিষয়ে মানবাধিকার কমিশনসহ রাষ্ট্রের সবাই নীরব, এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তারের খবর আমরা পাইনি।
দ্বিতীয়টি গত ১৯ সেপ্টেম্বর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক নেতা শামীম মোল্লাকে দফায় দফায় পিটিয়প হত্যা, নেপথ্যে ছাত্রদল, ছাত্রশিবির ও ইউনূসকে নিয়োগ দেওয়া সমন্বয়কেরা, তাই সেটিও খবর থেকে লাপাত্তা! একই তারিখে তৃতীয়টি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন তোফাজ্জলকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা। এখানেই বৈষম্য স্পষ্ট! আমরা কী দেখতে পেলাম? যখনই জানা গেল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিটুনি খেয়ে নিহত তোফাজ্জল ছাত্রলীগ ছিলনা, তখন থেকেই তাকে নিয়ে টিভি ও পত্রিকায় সে কি ঝড়! এটাই বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রকৃত চরিত্র। নিজ দলের সমর্থকদের জন্য গণতন্ত্র তথা মানবাধিকার এবং বিরোধীদের জন্য বঞ্চনা ও অত্যাচার! আর ত্রাণের টাকা লুটপাট, বদলি বাণিজ্য, টেন্ডার বাণিজ্য? এসব প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে- ১৫ বছর কোথায় ছিলেন? মানে ১৫ বছর যেহেতু দুর্নীতি হয়েছে সুতরাং এখনও সেটি চলমান থাকার ওপেন লাইসেন্স দিতে হবে! আমাদের প্রশ্ন হলো, উত্তর যদি এমনই হয়, তাহলে হাসিনার স্বৈরাচার থেকে ইউনূসের স্বৈরাচারের পার্থক্য কোথায়?
লেখক: সমাজ চিন্তক