দেশে এখন চলছে ‘ভাঙনের উৎসব’। যে যা পারে তাই যেন ভেঙে ফেলছে। কেউ বুঝে ভাঙছে, কেউবা না বুঝে। কেউ আক্রোশে ভাঙছে; কেউ আবার ভাঙার জন্যই ভাঙছে। যেমন শিশুরা ভাঙে খেলার ছলে। স্থাপনা থেকে ঐতিহ্য– বাদ যাচ্ছে না কিছুই। রাজধানীর বুকেই প্রকাশ্য দিবালোকে শত শত উৎসুক জনতার চোখের সামনে স্বনামধন্য এক কলেজের ছাত্ররা বীরদর্পে আরেক কলেজের সাইনবোর্ড ভেঙে নিয়ে মিছিল করেছে রাজপথে। যেন কোনো টুর্নামেন্টে ট্রফি জিতেছে। ভাঙনের এমন আনন্দ জাতি আগে কখনও দেখেছে বলে মনে হয় না।
শুরু হয়েছিল গণভবন, জাতীয় সংসদ ভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় দিয়ে। তারপর একে একে সব ভাস্কর্য। প্রধান লক্ষ্য অবশ্য ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামাঙ্কিত স্থাপনা। বাদ যায়নি তাঁর পিতা ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি, ম্যুরাল, ভাস্কর্য। যেখানে যত ছিল– সব। রাজধানী ছাড়িয়ে জেলা, উপজেলা, এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়েও। ভাঙনের জোয়ার থেকে বাদ যায়নি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রিসভার প্রথম শপথ নেওয়ার ঐতিহাসিক স্থান মুজিবনগরের স্মৃতি। রেহাই পায়নি সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে স্থাপিত ‘থেমিস’। বীর মুক্তিযোদ্ধা ও জাসদ নেতা মইনউদ্দীন খান বাদলের কবরেও হামলা হয়েছে।
দ্বিতীয় পর্যায়ে শুরু হয়েছে মাজার ও দরবার ভাঙার পালা। বীরদর্পে ভাঙন সৈনিকরা মাজার ভেঙে চলেছে। এসব মাজার ও দরবারের কোনো কোনোটির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এ দেশে ইসলাম প্রচারের ইতিহাস। সিলেটের শাহপরাণের মাজারও হামলা থেকে রক্ষা পায়নি। ভাঙন সৈনিকদের হামলায় একজন ভক্ত মারাও গিয়েছেন সেখানে। অথচ শাহপরাণ এ দেশের মুসলিম ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ১৩০৩ সালে হজরত শাহজালালের নেতৃত্বে সিলেট বিজয়ে তিনি ছিলেন সম্মুখসারির সৈনিক। এ ভূখণ্ডে ইসলাম প্রচারে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখা ৩৬০ আওলিয়ার অন্যতম। অথচ তাঁরই মাজার গুঁড়িয়ে দিল এক দল মুসলমান!
মাজারগুলোকে কেবল ধর্মীয় স্থাপনা হিসেবে দেখলে ভুল হবে। হাজার বছর ধরে এ দেশে পীর-আওলিয়ার মাজারকে কেন্দ্র করে এক ধরনের সংস্কৃতি জন্ম নিয়েছিল। লড়াইটা সেই সংস্কৃতির বিরুদ্ধে। যেমন লড়াই ছিল এবং চলছে ইরান তথা পারস্যের সঙ্গে আরবের। আজকের ইরানের সঙ্গে আরবের যে দ্বন্দ্ব, তা তো এই সংস্কৃতি নিয়েই। ইরানিরা আরবের ধর্ম গ্রহণ করলেও তাদের সংস্কৃতিকে কখনোই গ্রহণ করেনি। তাই তো আজও ইরানের সবচেয়ে বড় জাতীয় উৎসব ‘নওরোজ’ বা নববর্ষ। বাংলাদেশেও লড়াইটা ওই সংস্কৃতির বিরুদ্ধেই।
শুধু স্থাপনা, মাজার বা ভাস্কর্য নয়; ভাঙচুরের হাত থেকে প্রতিষ্ঠানও রেহাই পাচ্ছে না। এই যে সচিবালয়ে জেলা প্রশাসক পদে পদায়নের জন্য হাতাহাতি, হট্টগোল, সিনিয়র কর্মকর্তাদের আটকে রাখা কিংবা ১০ বছর আগে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের চাকরিতে পুনর্বহাল– এসবও এক ধরনের ভাঙন। নিয়মের ভাঙন, প্রতিষ্ঠানের ভাঙন। সেই ১৭৭২ সালে ওয়ারেন হেস্টিংসের চালু করা আমলাতন্ত্রে গত আড়াই শতাব্দীতে এমনটি ঘটেছে বলে শোনা যায়নি। জেলা প্রশাসক পদে নিয়োগ কোনো পদোন্নতি নয়; পদায়ন– কে না জানে! সরকারের উপসচিব পদমর্যাদার যে কাউকে সরকার জেলা প্রশাসক হিসেবে পদায়ন করতে পারে। এটা সরকারের প্রাধিকার। এতে কারও বঞ্চিত ভেবে বেদনা পাওয়ার কিছু নেই। তবুও সবাই জেলা প্রশাসক হতে চায়। কেন হতে চায়? হতে চায় কারণ, এই পদটিতে মাঠ পর্যায়ে ক্ষমতার দাপট দেখানোর প্রভূত সুযোগ রয়েছে। সেই সঙ্গে হয়তো অপব্যবহারেরও। তাই তো এত হট্টগোল; নিয়মের ভাঙনের প্রয়াস।
প্রায়শ খবর হচ্ছে– দেশের বিভিন্ন স্থানে ছাত্ররা তাদের শিক্ষকদের জোর করে পদত্যাগ করাচ্ছে। এমনটি এই দেশের কেন, অন্য কোনো দেশে ঘটেছে বলে জানা যায় না। তবে অতীতে বিচ্ছিন্নভাবে দু’একটা ঘটনা যে একেবারেই ঘটেনি, এমন বলা যাবে না। কিন্তু এভাবে অনেকটা গণহারে ছাত্রদের চাপে শিক্ষকের পদত্যাগ আসলেই অভূতপূর্ব। এ-ও এক ধরনের ভাঙন। ঐতিহ্যের ভাঙন, সম্পর্কের ভাঙন, মূল্যবোধের ভাঙন।
ভাঙনের কালে ইতিহাসও ভাঙে। এই যে ঢাকায় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হয়ে গেল, সেটাও এক ধরনের ভাঙন। এই ভাঙনটা ইতিহাসের, চেতনার। দীর্ঘ ২৪ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে ইতিহাস রচিত হয়েছিল ১৯৭১ সালে, সেই ইতিহাস ও ইতিহাসের চেতনাকে ভেঙে ফেলার প্রয়াস। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ি ধ্বংস তারই প্রকাশ। কারণ ৩২ নম্বরের বাড়িটি শুধু শেখ হাসিনার পিতৃগৃহ নয়; বাংলাদেশের স্বাধিকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামের অমর সাক্ষী।
সত্য, ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়েই গড়ে ওঠে নতুন ইতিহাস। ১৭৫৭ সালে সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পরও ইতিহাসের অনেক বয়ান তৈরি হয়েছিল। বলা যায়, তৈরি করা হয়েছিল। অনেক বছর লেগেছে সেই ইতিহাসের থিতু হতে। ১৮৫৭ সালের সিপাহি অভ্যুত্থানও তার থেকে মুক্ত ছিল না। বিদ্রোহ থেকে অভ্যুত্থান, অভ্যুত্থান থেকে স্বাধীনতা সংগ্রাম। এখনও চলছে সেসব ইতিহাসের নির্মাণ আর পুনর্নির্মাণ। মার্ক্সবাদীরা একেই বলেন দ্বান্দ্বিকতা।
এও মনে রাখতে হবে, আজকের ভাঙন উৎসব পূর্বপ্রস্তুতিরই ফসল। ফাটল তৈরির কাজটা শুরু হয়েছিল অনেক আগেই; স্বাধীনতার অব্যবহিত পর থেকেই। অর্থাৎ ৫৩ বছর ধরেই তা চলছিল। কিন্তু গত ১৫ বছরে তা তীব্র হয়েছে। কেউ বুঝতে পারেনি। কারণ এই সময়ে সরকার ছিল নিজের ও স্তাবক বাহিনীর আখের গোছানোর ক্ষেত্র প্রস্তুতে ব্যস্ত। শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসন অহংকারে এতই মত্ত ছিল যে, কিছুই দেখতে পায়নি, বুঝতে পারেনি। সরকারের সব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে বিরোধী মত দমনে। আর শেখ হাসিনার স্তুতিবাদী পারিষদ তাঁকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল, তিনি কিছুই বুঝতে পারেননি। যখন বুঝতে পারলেন তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। অনেকটা রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ নাটকের যক্ষপুরীর রাজার মতো। যে রাজা এক পর্যায়ে তাঁর পারিষদকে বলছেন, ‘আমার নিজের যন্ত্র আমাকে মানছে না।’
মনে পড়ে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এমনিভাবেই ভেঙে পড়ছিল– ঐতিহ্যগত মূল্যবোধ, কাঠামো সব। কেউ কাউকে মানতে চাচ্ছে না; কেন্দ্র বলতে কিছু নেই; সবকিছুই চলে যাচ্ছে নিয়ন্ত্রণের বাইরে। আইরিশ কবি ডব্লিউ বি ইয়েটস ১৯১৯ সালে লিখলেন তাঁর কালজয়ী কবিতা ‘দ্য সেকেন্ড কামিং’। লিখলেন– ‘বিস্তীর্ণ চক্রে ঘুরে বারবার/ বাজপাখি মালিকের কথা শোনে না যে আর/ ভেঙে পড়ে সব কেন্দ্রীভূত থাকে না কিছু/ পৃথিবীতে কেবল নৈরাজ্যই করে বিরাজ।’
কী ভয়ানক সাযুজ্য আজকের বাংলাদেশের সঙ্গে! তবে প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ কি ১০৫ বছর আগের ইয়েটসের কালেই ফিরে যাবে, নাকি পাবলো পিকাসোর মতো আশাবাদী হয়ে বলবে– এভরি অ্যাক্ট অব ক্রিয়েশন বিগিন্স উইথ অ্যান অ্যাক্ট অব ডেস্ট্রাকশন? দেখার বিষয় এখন সেটাই।
লেখক: সাবেক জাতিসংঘকর্মকর্তা ও কলামিস্ট