বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে চলে যাওয়ার পর ক্ষমতা গ্রহণ করে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার। এই পরিস্থিতিতে বেশ অস্থির সময় পার করছে বাংলাদেশ। ব্লুমবার্গের প্রতিবেদন বলা হয়েছে, এই অস্থির সময়ের সুযোগ নিয়েই বাংলাদেশে শক্তিশালী হচ্ছে ইসলামপন্থীরা।
শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকার পরিবর্তনের পর গত মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনায় এশিয়াজুড়ে ইসলামী চরমপন্থীদের বিস্তারের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের কিছুক্ষণ পর মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজের বাড়ির শয়নকক্ষে ঢুকে একদল যুবক হিজাব না পরার জন্য তার সাথে দুর্ব্যবহার করতে শুরু করে এবং একপর্যায়ে তুরিনের চুল কেটে দেয়। তারা তুরিনকে জিম্মি করে এবং পেনসিল দিয়ে খুঁচিয়ে আঘাত করতে থাকে। তারা তাকে ইসলাম বিষয়ে জ্ঞান দিতে থাকে। তার কিশোরী মেয়ের ক্ষতি হতে পারে ভেবে তুরিন উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তুরিন বলেন, আমি ভেবেছিলাম, তারা হয়তো আমাকে হত্যা করবে। আমি খুবই ভয় পেয়েছিলাম।
এতে বলা হয়, শেখ হাসিনার সরকারের ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসানের পর। একটি গণতান্ত্রিক ও পরিচ্ছন্ন সরকারের আশায় ছিল বাংলাদেশিরা। শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারকে সমর্থন দিয়ে সেই আশাকে আরও শক্ত করেছে সেনাবাহিনী।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, তবে প্রায় অর্ধশতক বছর আগে সংঘটিত গণহত্যা থেকে উদ্ভূত চরমপন্থীরা বাংলাদেশের রাজনীতিতে জায়গা করে নিয়েছে। শেখ হাসিনা তার শাসনামলে এই চরমপন্থীদের কঠোরভাবে দমন করেছেন। ১৯৭১ সালে গণহত্যার সাথে জড়িতদের বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি। তাই ২০০৯ সালে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর বিচারের মাধ্যমে বিরোধী দল জামায়াতে ইসলামীর কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতাসহ যুদ্ধাপরাধে জড়িতদের মৃত্যুদণ্ড দেন তিনি।
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা গবেষক পল স্ট্যানিল্যান্ডের ব্লুমবার্গকে বলেন, এই ধরনের বিপ্লবোত্তর পরিবেশ অবিশ্বাস্য রকম নাজুক। ফলে চরম অনিশ্চিত রাজনৈতিক পরিবেশের মধ্যে ইসলামী চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোর মাথাচাড়া দেওয়ার ঝুঁকি আছে।
ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রায় এক দশক আগে ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে যুক্ত চরমপন্থীরা ধর্মনিরপেক্ষ ব্লগারদের ওপর লাগাতার ছুরি হামলা চালায়। ২০১৬ সালে ইসলামী চরমপন্থীদের একটি দল গুলশানের হোলি আর্টিজন বেকারিতে ঢুকে জিম্মি করে নির্বিচার গুলি চালায়। তখন এক ডজনেরও বেশি বিদেশিকে হত্যা করা হয়। ব্যাপক বলপ্রয়োগের মাধ্যমে এর জবাব দেন হাসিনা সরকার।
এতে বলা হয়, শেখ হাসিনা ভারতে চলে যাওয়ার পর দুর্বৃত্তরা হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দিরে আগুন দিয়েছে, ভেঙে ফেলেছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো ব্যক্তিত্বদের ভাস্কর্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী অধ্যাপকদের পর্দা করার নির্দেশ দিয়ে চিঠি পাঠানোর মতো ঘটনা ঘটেছে। জামায়াতে ইসলামীর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়েছে এবং হোলি আর্টিসান বেকারিতে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিহত পুলিশ সদস্যদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধ ভেঙে ফেলে ইসলামী চরমপন্থী একটি গোষ্ঠীর পোস্টার লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সেনাবাহিনীর সমর্থনে অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্ররা ড. ইউনূসের হাতে দেশ পুনর্গঠনের দায়িত্ব তুলে দেয়। দরিদ্রদেরকে নিয়ে ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির জন্য হাসিনা ড. ইউনূসকে প্রকাশ্যে ‘রক্তচোষা’ বলেছেন বছরের পর বছর। তার আমলে ড. ইউনূসকে অর্থপাচার ও ঘুষের অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডও দেওয়া হয়। কিন্তু ড. ইউনূস ক্ষমতায় আসার পর পরই সেসব অভিযোগ তুলে নেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, শেখ হাসিনা সরকারে পতনের আগে সংঘটিত রক্তপাতের নিন্দা করেছেন ড. ইউনূস। অল্প সময়ের মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারবেন বলে আত্মবিশ্বাসও ব্যক্ত করেছেন তিনি। কিন্তু স্বাধীনতার পর অর্ধশতকে দুই ডজনেরও বেশি সামরিক অভ্যুত্থানের এই দেশে জীবন-মৃত্যুর রাজনীতির আনুষ্ঠানিক অভিজ্ঞতা তার নেই। তার ১৯ উপদেষ্টার সবাই মূলত শিক্ষাবিদ, অ্যাকটিভিস্ট ও ছাত্র। তারা কেউই শেখ হাসিনার মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের অধিকারী নন।