ব্লুমবার্গের প্রতিবেদন ও সাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ

মীর রবি

ভারতবর্ষ বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে স্বাধীন হলেও এই অঞ্চলের মানুষের মুক্তি আসেনি আজও। ঔপনিবেশিক শাসনের ‘ভাগ কর শাসন কর’ নীতি বহাল তবিয়তেই এই উপমহাদেশকে নানাভাবে বিভক্ত করে চলেছে। সাতচল্লিশে ধর্মভিত্তিক দেশভাগের দরুন ভারত উপমহাদেশে ধর্মীয় বিভাজনকে স্থায়ী করে তোলা হয়। ঐতিহাসিকভাবেই হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্বকে জিয়ে রেখে ভবিষ্যৎ ভারত ও পাকিস্তানকে অস্থিতিশীল করার বীজ বপন করে গিয়েছে সাম্রাজ্যবাদীরা। বিশেষত ধর্মের দোহাই দিয়ে বাঙালি জাতিকে বিভক্ত করতে সক্ষম হয়েছিল তারা। তারপরও সেই বিভাজনের মধ্য দিয়ে মুসলিম জাতীয়তাবাদ বা হিন্দু জাতীয়তাবাদ ধারণার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি। যার ফলে পাকিস্তান সৃষ্টির কয়েক বছরের মধ্যেই ভাষাভিত্তিক জাতীয়তায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বাঙালিরা ‘বাংলাদেশ’ নামক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে।

বাংলাদেশের বাঙালির বৃহৎ অংশ মুসলিম ও ক্ষুদ্র অংশ হিন্দু, এছাড়াও বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী আদিবাসী জনগোষ্ঠীও রয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর প্রথম জাতিগত বিভাজনের তর্ক তোলে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। তাঁর শাসনামলে বাঙালি ও পাহাড়ি আদিবাসী জাতিগত সংঘাত সামনে আসে। আপাত দৃষ্টিতে এটা শুধু জাতিগত বিভাজননীতির অংশ ছিল এমনটা নয়। খুব সুক্ষ্মভাবে চিন্তা করলে দেখা যায় এর পেছনে সাম্প্রদায়িক বিভাজনও ছিল। সাম্প্রতিক পাহাড়ে নতুন করে পুনরায় পাহাড়ি ও বাঙালি সংঘাত শুরু হয়েছে। সংঘাত শুধু বাঙালিতে সীমাবদ্ধ নয়, সংঘাত গড়িয়েছে আদিবাসী বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও বাঙালি মুসলমানে। আধিপত্যবাদী বাঙালি মুসলিমরা আদিবাসীদের ঘরবাড়ি, জায়গাজমি ও উপাসনালয় দখল, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করছে। উপাসনালয় দখল করে মসজিদও বানানো হয়েছে। রাষ্ট্রীয় বাহিনী আদিবাসীদের বিচ্ছিন্নতাবাদী অভিযুক্ত করে দমননীতি অব্যাহত রেখেছে, যা অত্যন্ত নিন্দনীয়।

বৃটিশ পূর্ব বাংলা ও স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে জাতীয়তা ও ধর্ম প্রশ্নে বিভাজনের ক্ষত যেন পেছন ছাড়েনি কখনোই। মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় যাত্রা শুরু করা বাংলাদেশ প্রথমেই হোঁচট খায় পঁচাত্তরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড ও হত্যা পরবর্তী ঘটনা প্রবাহের মাধ্যমে। সেনা কর্মকর্তা থেকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান অসাম্প্রদায়িক চিন্তার বাংলাদেশের সংবিধানে সাম্প্রদায়িক কালিমা লেপন করেন। সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মের ধ্বজায় সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ সংযোজন করা হয়। যুক্ত করা হয় রাষ্ট্রধর্ম ‘ইসলাম’। এর মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাহাত্তরের সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ চেতনাকে ক্ষুন্ন করে জিয়া সরকার। পরবর্তীতে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় এসেও তা বহাল রাখেন। পরবর্তী বেগম খালেদা ও শেখ হাসিনা সরকারও তা পরিবর্তন করেনি। বরং জিয়া থেকে অদ্যাবধি প্রত্যেক সরকারই ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতি এবং স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াতসহ ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে আপোষনিতি গ্রহণের ফলে সাংবিধানিকভাবেই বাংলাদেশ অনেকাংশে সাম্প্রদায়িক যাত্রা শুরু করেছিল।

৭২ এর সংবিধানের মৌলিক চেতনাবিরোধী সিদ্ধান্ত থেকে বাংলাদেশ আর বের হয়ে আসতে পারেনি। ফলে ধর্মের ভিত্তিতে জন্ম নেওয়া পাকিস্তানের ন্যায় ‘রাষ্ট্রধর্ম’ নিয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রনৈতিক অভিযাত্রায় সাম্প্রদায়িক বিভাজন থেকেই যায়। দিনকে দিন সেই বিভাজন ক্রমশ বাড়ছে এবং ইসলামি চরমপন্থার চূড়ান্ত উত্থান ঘটছে। সাম্প্রতিক ৫ আগস্ট ২০২৪, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই সেই চিত্র সুস্পষ্টভাবে দৃশ্যায়ন হয়েছে।

শেখ হাসিনা সরকারের পতন মুহুর্তেই মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান কৌঁসুলি তুরিন আফরোজের বাড়িতে গিয়ে তুরিন আফরোজকে আক্রমণ করে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী মৌলবাদী গোষ্ঠীর কতিপয় তরুণ। ব্লুমবার্গের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘তারা তুরিনের শয়নকক্ষে ঢুকে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন এবং হিজাব না পরায় হম্বিতম্বি করেন। একপর্যায়ে তারা তুরিনের মাথার চুল কেটে দেন। ওই তরুণেরা তুরিন আফরোজকে কয়েক দিন জিম্মি করে রাখেন এবং তাঁকে পেনসিল দিয়ে খুঁচিয়ে আঘাত করেন। তাঁকে ইসলাম বিষয়ে ‘শিক্ষা’ দেন’। শুধু তাই নয়, প্রতিবেদন অনুযায়ী ‘তুরিন আফরোজ তাঁর মেয়ের ধর্ষণ এবং তাঁদের হত্যার আশঙ্কাও করেছিলেন’। তুরিন আফরোজের বাড়িতে গিয়ে অমানবিক নির্যাতন করা এই তরুণেরা স্পষ্টতই সাধারণ কোনো তরুণ নয়। তারা জামায়াতপন্থী উগ্রবাদী।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রায় ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। পাক বাহিনীর এদেশীয় প্রধান দোসর ছিল জামায়াত। একাত্তরে তাদের নির্যাতনের ভয়ে ভারতে পালিয়ে গিয়েছিল অন্তত ১ কোটি মানুষ। তাদের অধিকাংশই ছিল হিন্দু। জামায়াতের দৃষ্টিতে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল পাকিস্তান তথা ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। আর তাদের মতে বঙ্গবন্ধু ছিলেন ভারতের দালাল ও হিন্দুদের দোসর। ফলে ১৯৭১ সালে গণহত্যার শিকার হয় অধিকাংশ হিন্দু, বঙ্গবন্ধু সমর্থক ও আওয়ামী লীগের কর্মী। এর সঙ্গে জড়িতদের বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। তাই ২০০৯ সালে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর বিচারের মাধ্যমে জামায়াতে ইসলামীর কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতাসহ যুদ্ধাপরাধে জড়িতদের মৃত্যুদণ্ড দেন তাঁর সরকার। যে জন্য তাঁর ১৫ বছরের শাসনের অবসানের পর সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে তাঁর সমর্থক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক হামলা বেড়েছে। এসব হামলার সঙ্গে সম্পৃক্তদের অধিকাংশই তরুণ। কিছু সংখ্যক কিশোরও রয়েছে এই দলে।

এসব উগ্রবাদী তরুণের সংখ্যা বাংলাদেশে একেবারেই অল্প নয়। নানামুখী হিপোক্রেসি থাকলেও ইসলাম ও ইসলামের অনুশাসন ব্যক্তি জীবনে নিজে পালন না করলেও অন্যকে পালনে বাধ্য করতে তৎপর তারা। একই সঙ্গে কোনো ধরনের ধর্মীয় আলোচনা-সমালোচনা নিজেদের মনঃপুত না হলে আক্রমণ করতে পিছপা হয় না এসব তরুণ। বাংলাদেশের তরুণদের অধিকাংশই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত মৌলবাদী কন্টেট দ্বারা প্রভাবিত। তাদের ধর্মীয় জ্ঞান খুবই কম, সেই সঙ্গে ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান ও ধর্মীয় পড়াশোনা শূন্যের কোটায় থাকায় তারা মৌলবাদী মাওলানা ও ইসলামী বক্তাদের বয়ানে খুব দ্রুত বিভ্রান্ত ও বিপথগামী হয়। অনেক ক্ষেত্রে কোনো বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা না থাকলেও নিজেকে ইসলামীক প্রমাণ করতে গিয়ে এদেশের তরুণেরা অতি উৎসাহী হয়ে সাম্প্রদায়িক উগ্রবাদী কর্মকান্ডে জড়িয়ে পরছে। সম্পৃক্ত হচ্ছে জামায়াত-শিবিরসহ বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক দলের সঙ্গে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট এক্ষেত্রে তরুণদের অধিকতর ভাবে ইসলামি চরমপন্থীদের দিকে আকৃষ্ট করছে।

সাম্প্রতিক প্রকাশিত ব্লুমবার্গের প্রতিবেদন বলা হয় ‘জনসংখ্যার দিক থেকে পঞ্চম শীর্ষ মুসলিম দেশ বাংলাদেশ ইতিহাসের জটিল সন্ধিক্ষণে রয়েছে। পশ্চিমা দেশ ও ভারতীয় কর্মকর্তাদের আশঙ্কা, চরমপন্থীরা বিশ্বের অস্থির অঞ্চলটিতে পা রাখার দ্বারপ্রান্তে, যেখানে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইসলামিক স্টেটের মতো সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক প্রসার লাভ করেছে। মধ্যপ্রাচ্যে ব্যাপক উত্তেজনা, ইসরায়েলের সঙ্গে লেবানন ও হামাসের যুদ্ধ চরমপন্থীদের দলভুক্ত করার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করেছে’। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয় ‘শেখ হাসিনার পতনের প্রায় অর্ধশতক বছর আগে সংঘটিত গণহত্যা থেকে উদ্ভূত চরমপন্থা বাংলাদেশের রাজনীতিতে জায়গা করে নিয়েছে’। অর্থাৎ একাত্তরের গণহত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ত ইসলামি চরমপন্থী জামায়াতসহ অন্যান্য ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো বর্তমান বাংলাদেশের রাজনীতিতে অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে উঠেছে।

বিএনপি আমলে জামায়াতের পুনর্বাসন, বাংলা ভাইয়ের উত্থান, একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলা ও ২০১৩ সালে ঢাকার শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশ, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে একের পর এক ব্লগার হত্যা, ২০১৬ সালে হোলি আর্টিজানে হামলা এবং পরবর্তী নানা ঘটনা প্রবাহ বাংলাদেশ জঙ্গিবাদীদের উপস্থিতিকে মোটাদাগে চিহ্নিত করে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরপরই তারা আবারও প্রকাশ্যে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করেছে। ইতোমধ্যে ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের নতজানু নীতির ফলে চিহ্নিত সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসী ও ব্লগার হত্যাকাণ্ডসহ নানামুখী জঙ্গিবাদী কার্যক্রমে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে জঙ্গি নিধনে সাহসী পুলিশ কর্মকর্তাদের। বাতিল করা হয়েছে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াত নিষিদ্ধের প্রজ্ঞাপন। প্রকাশ্যে এসেছে হিযবুত তাহরীরের মতো নিষিদ্ধ আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন। যা বাংলাদেশের জননিরাপত্তার জন্য হুমকিই না শুধু, বাংলাদেশের অস্তিত্বের জন্যও তা বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে।

প্রকাশ্যে আসা ইসলামি চরমপন্থীরা দেশব্যাপী নিজেদের উপস্থিতিকে জানান দিতে সভা, সমাবেশ ও মিছিল করছে। হামলা করছে আওয়ামী লীগ সমর্থক, ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ও মন্দিরে। হাজার হাজার হিন্দু এরই মধ্যে তিব্বত ও মিয়ানমার সীমান্তবর্তী ভারতের স্পর্শকাতর এলাকায় পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। শুধু তাই নয় ইসলামি চরমপন্থীরা ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেও বিভক্তি তৈরি করেছে। মুসলমানদের একাংশকে ‘প্রকৃত মুসলিম নয়’ আখ্যা দিয়ে ইসলাম থেকে খারিজ করে দিচ্ছে এবং তাদের উপর আক্রমণ করছে। এমনকি হত্যাকাণ্ডও সংঘটিত করছে তারা‌। কাদিয়ানী, আহলে হাদীস, আহলে সুন্নাত, মাজারপন্থী, সুফি, পীর-ফকির ইত্যাদি মতের অনুসারীদের অমুসলিম ঘোষণা দিয়ে তাদের ওপর হামলার ঘটনা এখন দৈনন্দিন বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতোমধ্যে কয়েক শত মাজার ও আখড়া ভেঙে দিয়েছে উগ্রবাদী এবং তাদের সমর্থকেরা। ভাঙা হয়েছে প্রায় দেড় হাজার ভাস্কর্য ও শিল্পকর্ম। ভাঙচুর করাসহ পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সাংস্কৃতিক চর্চা করা হয় এমন বিভিন্ন জেলার শিল্পকলা একাডেমি, শিশু একাডেমি, সাংস্কৃতিক সংগঠন, সিনেমা হল ও দেশের বিভিন্ন প্রান্তের পাঠাগার। হোলি আর্টিজানে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিহত পুলিশ সদস্যদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধ ভেঙে ফেলে ইসলামি চরমপন্থী একটি গোষ্ঠীর পোস্টার টানানো হয়েছে। দিনাজপুরে আদিবাসীদের কানু-সিধু’র ভাস্কর্য ভেঙে কালেমা চত্বর করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো ধর্মনিরপেক্ষ মনীষীদের নিয়ে অপপ্রচার বৃদ্ধি পেয়েছে, আক্রান্ত হয়েছে লালন আখড়া। শিরকের অভিযোগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা জাতীয় সংগীত বদলানোর দাবিও তোলা হয়েছে। বৃদ্ধি পেয়েছে মুক্তিযুদ্ধপন্থী প্রগতিশীল মানুষদের ‘ইসলাম বিরোধী’ আখ্যা দেওয়ার প্রবণতা। ভিন্নমতাবলম্বীদের ‘নাস্তিক, মুরতাদ, কাফের, আওয়ামী লীগের দোসর, ফ্যাসিবাদের দোসর, আফসোস লীগ, ছাত্রলীগ, ভারতের দালাল, ইসলাম বিরোধী’ ইত্যাদি ট্যাগ দিয়ে মব জাস্টিসের মুখোমুখি পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে।

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে মৌলবাদী শক্তির উত্থানের বড় উদাহরণ হচ্ছে তথাকথিত ইসলামপন্থীদের চাপে জাতীয় পাঠ্যপুস্তক সংশোধন কমিটি বাতিলের ঘটনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন অধ্যাপক কামরুল হাসান ও সামিনা লুৎফাকে ইসলাম বিদ্বেষী অভিধায় তাঁদের বাদ দিয়ে দুজন আলেমকে যুক্ত করার দাবি জানিয়েছে জামায়াত, হেফাজতসহ ধর্মভিত্তিক কয়েকটি দল ও সংগঠন। সেই সঙ্গে জামায়াত মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবস্থানকে অস্বীকার করে পাঠ্যপুস্তক থেকে ‘জামায়াত সংক্রান্ত মিথ্যাচার’ বাতিলের দাবিও তুলেছে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানে কিংবা ইসলাম সম্মত নয় এমন বিষয় পাঠ্যসূচি থেকে বাদ দেওয়ার কথাও উঠেছে। তাদের মতে বিবর্তনবাদ, ট্রান্সজেন্ডার পাঠ ইসলামপরিপন্থী। ইতোমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী অধ্যাপকদের পর্দা করার নির্দেশ দিয়ে চিঠি প্রচারিত হয়েছে। রংপুরের একটি বিদ্যালয়ে হিন্দু শিক্ষার্থীদের হিজাব পরিধান ও কুরআনের সূরা তেলোয়াতে বাধ্য করতেও দেখা গিয়েছে। পর্দা না করার অভিযোগে কক্সবাজারে নারীকে হেনস্থা করা হয়েছে, আক্রান্ত হয়েছন নারী পর্বতারোহীও। ভাসমান যৌনকর্মীদের শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে।

বাংলাদেশে গত কয়েক বছর থেকে নারী বিদ্বেষী মনোভাব বাড়লেও, সেভাবে হেনস্থার দৃশ্য সামনে আসেনি কিংবা প্রকাশ্যে কেউ তেমন আচরণ করেনি কিংবা কোনো ঘোষণাও দেয়নি। কিন্তু বর্তমানে তা বেড়েছে। নারী হেনস্থা, হোমো ফোবিয়া ও ধর্ম পুলিশিং (ম্যোরাল পুলিশিং) এখনকার প্রত্যাহিক ঘটনা। যৌন কেলেঙ্কারিতে বিতর্কিত হেফাজত নেতা মামুনুল হক নারীদের আলকাতরা লাগানোর ঘোষণা দিয়ে বলেছেন ‘একটি মুসলিম রাষ্ট্রে হিন্দুদের এই ধরনের পোশাক (তার মতে অশালীন) সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। আমাদের সংস্কৃতি ও ধর্মের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে শিগগিরই আমরা হিজাব বাধ্যতামূলক করবো। এখানে শুধুমাত্র ইসলামের আদর্শই টিকে থাকবে, এবং অন্য ধর্মের কোনো সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বরদাস্ত করা হবে না’। এই বক্তব্য শুধুমাত্র একজন মামুনুল হকের প্রতিনিধিত্ব করে তা নয়, বরং এই বক্তব্য তাদের পুরো মৌলবাদী গোষ্ঠীর। অর্থাৎ এই ভাষ্যানুযায়ী বাংলাদেশ শুধুমাত্র তাদের মতাদর্শে বিশ্বাসী মুসলিমদের হবে, তাদের সংস্কৃতিই এখানে এককভাবে গণ্য এবং বাংলাদেশের চিরায়ত বহুত্ববাদ, বৈচিত্র্যতা অগ্রহণযোগ্য। তারা এসব বন্ধে যে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করার অধিকার রাখে। তাদের এই মনোভাব শুধু মানবাধিকারই লঙ্ঘন করে না, পুরো মানব সভ্যতার জন্যই তা অমঙ্গলজনক ও সংঘাত পূর্ণ। মৌলবাদী গোষ্ঠীর নানা ধরনের বক্তব্য, আগস্ট থেকে সংঘঠিত বিভিন্ন ঘটনার আলোকে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ বাংলাদেশে শুধু ইসলামি চরমপন্থা বিস্তারের আশঙ্কা তৈরির ইঙ্গিতই প্রকাশ করেনি, ক্ষমতাসীন হওয়ার প্রতিও ইঙ্গিত দিয়েছে। যা এই উপমহাদেশের নিরাপত্তার জন্য বড় চিন্তার বিষয় হয়ে উঠেছে।

আমরা নিজেরাও সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করেলে দেখতে পাই, এদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি থেকে ক্রমাগত দূরে সরে গিয়েছে। মানুষে মানুষে বিভেদ ও বিভাজন বাড়ছে। হারিয়ে যাচ্ছে একে অপরের প্রতি বিশ্বাস ও মহব্বত । মানবিক বোধ হ্রাস পাচ্ছে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ পেরিয়েও বাংলাদেশ যেন দুটো ধারাতেই বিভক্ত— ১. একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধপন্থী ও ২. একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী মৌলবাদপন্থী। এই দুই বিভেদরেখা খুব দ্রুতই দৃশ্যমান হয়েছে। যাতে করে বর্তমান সময়কে ১৯৭০-এর দশকে পাকিস্তানের হাত থেকে স্বাধীনতার লড়াইয়ের সঙ্গেই পুনরায় তুলনা করা যায়।

লেখক: কবি ও সমাজচিন্তক

শেয়ার করুন