ঢাকায় রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি, পল্লবী থানা যুবলীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৭৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের সদস্য, যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাইফুল ইসলাম মিলন গ্রেপ্তার। জয়পুরহাটের সাবেক পৌর কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতাসহ ১০ জন, বগুড়ায় আটক হন আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের ৭ নেতাকর্মী।
সাবেক সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীদের পাশাপাশি এভাবে রাজধানীসহ সারাদেশে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হামলা, গুলি, হত্যাসহ বিভিন্ন অভিযোগে করা মামলায়। গত দু-তিন দিনে তৃণমূলের অন্তত ১০০ নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন যৌথ বাহিনী ও পুলিশের হাতে। এতে তৃণমূল আওয়ামী লীগে ছড়িয়ে পড়েছে গ্রেপ্তার আতঙ্ক।
হঠাৎ তৃণমূলে গ্রেপ্তার অভিযান বেড়ে যাওয়ার পেছনে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব শারদীয়া দুর্গাপূজার নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও একটি কারণ বলে জানা গেছে। পুলিশের উচ্চ পযায় থেকে বাহিনীর সব স্তরে সর্বোচ্চ সতর্কতার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যাতে পূজামণ্ডপ ও হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর কোনো ধরনের নাশকতার সুযোগ তৈরি না হয়।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেন। আত্মগোপন কিংবা দেশ ছেড়ে পালানোর সময় আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভার অনেক সদস্য ও দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকে ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন। প্রায় প্রতিদিনই কেউ না কেউ আটক হচ্ছেন। তবে বেশির ভাগই এখনো আত্মগোপনে কিংবা দেশের বাইরে অবস্থান করছেন, মাঝে মাঝে যাদের দেখা মেলে সংবাদমাধ্যমে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হামলা, গুলি করে হত্যাসহ বিভিন্ন অভিযোগে সারাদেশে শত শত মামলা হয়েছে শেখ হাসিনাসহ দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। এসব মামলায় জেলা-উপজেলা, সিটি, পৌরসভা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ের দলীয় ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের আসামি করা হয়েছে।
উত্তরায় ছাত্র আন্দোলন দমাতে হামলা চালিয়ে হত্যার অভিযোগে শুক্রবার দুপুরে উত্তরার বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় উত্তরা পশ্চিম থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট মনোয়ার ইসলাম চৌধুরী রবিনকে। এদিন দেশের বিভিন্ন স্থানে আরও বেশ কজন আটক হন পুলিশের হাতে।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর মিরপুর-১০ এলাকায় ইমন হত্যা মামলায় পল্লবী থানা যুবলীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক শেখ মোহাম্মদ ওয়াসিমকে আটক করা হয়। বনশ্রীতে হত্যা মামলায় একই দিন বিকালে খিলগাঁও থেকে গ্রেপ্তার হন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৭৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর মো. আজিজুল হক ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের সদস্য মো. ওবায়দুল ইসলাম রানা। রাতে ফুলবাড়িয়া থেকে যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাইফুল ইসলাম মিলনকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর পুলিশ।
জয়পুরহাটের সাবেক পৌর কাউন্সিলর জাকির হোসেন মোল্লা ও আওয়ামী লীগ নেতাসহ ১০ জনকে আটক করে পুলিশ। বগুড়ায় আটক হন আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের সাত নেতাকর্মী।
একই রাতে গোপালগঞ্জে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের চার নেতাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আর কুমিল্লার বুড়িচংয়ের ময়নামতি ইউনিয়নের সুন্দুরিয়াপাড়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে বিপুল অস্ত্রসহ মো. মোতাব্বির হোসেন জনি (৩৫) নামে এক যুবলীগ নেতাকে আটক করে যৌথ বাহিনী। তার বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয় একটি বিদেশি এয়ারগান, ১৪টি তলোয়ার, একটি লোহার চাকতি, তিনটি চাকু, পাঁচটি স্টিক।
এর আগে বুধবার রাতে ফেনী, সাভার, কক্সবাজার, হবিগঞ্জ, লালমনিরহাট, দিনাজপুর, নেত্রকোনা, নীলফামারী ও বগুড়ায় ৩২ নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হন। তাদের মধ্যে যেমন আছেন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, তেমনি আছেন কৃষক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ এমনকি প্রজন্ম লীগের নেতাকর্মী।
আওয়ামী লীগের পতনের পর ছাত্র-জনতার ওপর হামলার অভিযোগে মামলায় মঙ্গলবার গভীর রাতে এবং বুধবার সকালে নিজ নিজ বাসায় গ্রেপ্তার হন কিশোরগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট এম এ আফজল, তাড়াইল উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আজিজুল হক মোতাহার, সাধারণ সম্পাদক গিয়াসউদ্দিন লাকী, জেলা আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক এনায়েত করিম অমি এবং জেলা আওয়ামী লীগের ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক শামসুল ইসলাম মাছুম।
এসব গ্রেপ্তারের ঘটনায় তৃণমূলের আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, কৃষক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, মহিলা লীগ ও যুব মহিলা আওয়ামী লীগের তৃণমূলের যেসব নেতাকর্মী বাড়িতে অবস্থান করছিলেন, তারা এখন এলাকা ছেড়ে পালাচ্ছেন।
আত্মগোপনে থাকা একজন জেলা পর্যায়ের সভাপতি বলেন, তারা মামলায় গ্রেপ্তারের পাশাপাশি বিএনপি ও জামায়াতের হামলার শিকার হওয়ার ভয়েও আছেন। তৃণমূলে সম্প্রতি এ রকম কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। এ জন্য তারা তৃণমূলের নেতাকর্মীদের নিরাপদ স্থানে থাকতে পরামর্শ দিয়েছেন।
এদিকে একাধিক সূত্রে নিশ্চিত হয়েছে, পুলিশের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব থেকে থানা, সার্কেল, জেলা, রেঞ্জ পর্যায়ে পুলিশকে নির্দেশনা দেওয়া আছে গ্রেপ্তার অভিযান জোরদার করার জন্য। সামনে দুর্গাপূজার নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, পূজামণ্ডপ ও হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর যেকোনো নাশকতা কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ— এসব কিন্তু এর একটা লক্ষ্য হতে পারে।
আওয়ামী লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা জানান, একের পর এক হামলা-মামলা, গ্রেপ্তার, নির্যাতন করে আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার অপচেষ্টা হচ্ছে। যে অভিযোগ অতীতে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে করা হয়েছে, একই অভিযোগে বর্তমানেরাও অভিযুক্ত হবেন। এটিও দেশবাসীর ভেবে দেখার বিষয়। এমনটাই বলছেন ওই নেতা।