জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের কাছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ৫ আগস্টের আগে ও পরে সংঘটিত সহিংসতায় মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে নিরপরাধ মানুষের নামে মিথ্যা মামলা দায়েরসহ সার্বিক পরিস্থিতির সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরেছেন সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসন থেকে টানা চারবার বিজয়ী হওয়া সংসদ সদস্য, যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী।
১ অক্টোবর ‘বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘ প্রেরিত তদন্তানুষ্ঠান কমিটির বরাবরে একটি আবেদন’ শিরোনামে প্রেরিত চিঠিতে তিনি তাঁর বক্তব্য তুলে ধরেন।
মত ও পথ-এর পাঠকদের জন্য তাঁর সেই বক্তব্যটি তুলে ধরা হলো-
“মহোদয়,
শুভেচ্ছা নিবেন। বাংলাদেশের পদত্যাগী শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে ২০২৪ সনের কোটা বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে সরকার বিরোধী আন্দোলনের সময়ে (জুলাই থেকে আগস্ট ২০২৪ এর ৫ তারিখ পর্যন্ত/১৫ তারিখ পর্যন্ত) সংঘটিত দমনপীড়নে নিহত ও আহতদের বিষয়ে তদন্তানুষ্ঠানে আগত জাতিসংঘের তদন্তানুষ্ঠান কমিটির বাংলাদেশে আগমনকে আমরা স্বাগত জানাই। আমরা অবগত আছি যে ফিলিস্তিন, লেবানন অঞ্চলে প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের চরম ব্যর্থতা এই মুহূর্তে বৈশ্বিক প্রেক্ষিতে বড় খবর। এ দেখে মনে প্রশ্নও জাগে, জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন কি কার্যত ঠুটোঁ জগন্নাথ বৈ কিছু নয়? তবু এই কমিশনের “স্পিরিট”-কে সামনে রেখে কিছু কথা পেশ করতে চাই।
প্রথমত জুলাই ও আগস্ট মাসে ঘটে যাওয়া মানবাধিকার লঙ্ঘনের তদন্তের দায়িত্ব নেওয়াকে স্বাগত জানাই। একই সাথে, এই কমিটির বরাবরে ৫ আগস্ট ২০২৪ থেকে শুরু করে আজ অব্ধি বাংলাদেশে প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে যে অরাজক পরিস্থিতি বিরাজ করছে, যে আইন শৃংখলার অবনতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে সে সম্পর্কে একটি বিবরণ তুলে ধরে কমিটির তদন্তের আওতায় নেওয়ার জন্য জোর দাবি জানাচ্ছি।
১. ৫ আগস্ট ২০২৪-এ প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন “গণভবন”, জাতীয় সংসদ ভবন, ঢাকার বিখ্যাত ৩২ নং সড়কের “বঙ্গবন্ধু (যাদুঘর) ভবন, খুলনার “গণহত্যা যাদুঘর” ভবনসহ সারাদেশে কয়েকশত আওয়ামী লীগ দলীয় অফিস, রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের বাসভবন, খ্যাতিমান শিল্প-কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদিতে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর চালানো হয়। ছাত্র জনতার বিক্ষোভের পাশাপাশি নানা প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি রাজপথ দখল করে নেয়, যার ফলে ভিন্ন মতাবলম্বীদের অবস্থান খুবই দুর্বল হয়ে দাঁড়ায় এবং সারাদেশে একটা অরাজক পরিস্থিতি বিরাজ করতে থাকে।
২. আইনের শাসনের বিন্দুমাত্র অবস্থান না থাকার ঘটনার সাথে সম্পর্কহীন রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের নামে এবং মামলা বাণিজ্যের সুবিধার্থে একেকটি মামলায় শত শত বেনামী অন্তর্ভুক্তি দিয়ে মামলা করা হচ্ছে, যা সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে তথাকথিত সমন্বয়কেরা সবাই জানেন।
৩. ৫ তারিখ (আগস্ট ২০২৪) থেকে শুরু করে অদ্যাবধি শতাধিক রাজনৈতিক কর্মীকে, নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গকে হত্যা করা হয়েছে। তন্মধ্যে রাজশাহী, ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি “মর কিলিং” বিশেষভাবে ন্যক্কারজনক। পত্রিকাসূত্রে জানা যাচ্ছে এইসব কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত আছে তথাকথিত শিক্ষার্থী সমন্বয়কেরা। তাদের অধিকাংশই আইনের আওতার বাইরে। এই গোষ্ঠীটি বাদে আরও একটি গোষ্ঠী যারা শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসানে নিজেদেরকে ক্ষমতাসীন ভাবছে, তাদের নিজেদের দ্বন্দ্ব সংঘাতেও প্রচুর লোক মারা যাচ্ছে, যে সব ঘটনা মামলা মোকদ্দমার বাইরে থেকে যাচ্ছে এবং অপরাধীদের প্রায় সকলেই ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়ে যাচ্ছে। আইন-শৃংখলার দায়িত্বে নিয়োজিত থানা ও অন্যান্য জায়গায় কর্তব্যরতগণ মনে করছেন যে, দোষী না হলেও আওয়ামী পন্থী বা তাদের সহমর্মী বা প্রগতিশীল যে কোনো মানুষই অপরাধীর তালিকাভুক্ত হতে পারে। আর ছাত্র আন্দোলনের সাথে সম্পর্ক থাকুক বা না থাকক, আওয়ামী বিরোধী হলে অপরাধ করেও অপরাধী নয়।
৪. মামলা মোকদ্দমা দায়েরের ক্ষেত্রে এবং থানায় নিবন্ধন করার সময়ে জীবনে রাজনীতির সাথে সম্পর্কযুক্ত নন এমন শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, ক্রীড়াবিদ, ক্রীড়া সংগঠক, সংস্কৃতিজন, বুদ্ধিজীবী, মুক্ত চিন্তার অধিকারী আইনজীবী প্রমুখদেরকে খুনের মামলায় পর্যন্ত ফাঁসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এমনকি জুলাই-আগস্টের সহিংসতার অভিযোগ এনে আসামি করা হচ্ছে বছর পূর্বে মৃত ব্যক্তিদেরকেও!
৫. বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুলের শিক্ষকদের সাথে দুর্ব্যবহার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে, তাদেরকে জোরপূর্বক পদত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে। পুরো শিক্ষা ব্যবস্থায় এক ধরনের বিপর্যয় নেমে এসেছে।
৬. শিল্প-কারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্য ধ্বংসে সরকারের পৃষ্ঠপোষকদের সহায়তায় অপকর্ম অব্যাহত আছে।
৭. সারাদেশে মন্দির-মসজিদ-মাজার (ধর্মীয় একটি গোষ্ঠির প্রতিষ্ঠান, যার সংখ্যা সারাদেশে ১০ হাজারেরও বেশি হবে) ধ্বংসের কাজ চলছে অব্যাহতভাবে। নেই কোনো প্রতিকার। এই পর্যন্ত কয়েকহাজার মাজার ও মন্দির ভাঙ্গচুর হয়েছে, অগ্নিসংযোগ হয়েছে। অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না।
৮. পার্বত্য চট্টগ্রামে যে অবস্থা বিরাজ করছে তা আদিবাসী ও পাহাড়ী জনগোষ্ঠির জন্য মোটেও স্বস্তিদায়ক নয়।
৯. প্রচলিত বিধি বিধান উপেক্ষা করে “মনের মাধুরী” মিশিয়ে সরকার পরিচালনা করা হচ্ছে। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দানের ক্ষেত্রে আইনগত ভিত্তিটা কি, তা দেখা হচ্ছে বলে মনে করার কোনোই কারণ নেই।
১০. যে সমস্ত মামলা চলে আসছে দীর্ঘদিন যাবৎ হঠাৎ করে সে গুলো উবে যাচ্ছে।
১১. কাল্পনিক মামলায় যাদেরকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে তাদের নিরাপত্তা দিতে পারছে না বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। গ্রেপ্তারের পর কোনো না কোনো মামলার সাথে যুক্ত করে দিচ্ছে কোনোরূপ যাচাই বাছাই বা প্রাথমিক তথ্যানুষ্ঠান ব্যতীতই। আদালতে নেয়া হচ্ছে আর একটি বিশেষ গোষ্ঠীর আইনজীবী বলে পরিচিতি এমন বর্বর লোকজন অভিযুক্তদের সাথে (এমনকি নারী অভিযুক্ত) যাচ্ছেতাই ব্যবহার হচ্ছে। দেখার কেউ নেই। না আদালত, না আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ। এক কথায়, চরম নৈরাজ্য।
উপরে অতি সংক্ষেপে বাংলাদেশে বিরাজমান পরিস্থিতি জাতিসংঘ প্রেরিত তদন্ত টিমের সুবিধার্থে এবং সরকারের মধ্যে শুভবুদ্ধি সম্পন্ন যাঁরা আছেন, তাঁদের জ্ঞাতার্থে তুলে ধরা হলো। উল্লেখ্য যে, বিদায়ী শেখ হাসিনা সরকারের মন্ত্রিসভার একজন সদস্য হয়েও আমি ব্যক্তিগতভাবে কোটা বিরোধী আন্দোলনের একটি যৌক্তিক সমাধান চেয়েছিলাম এবং যা সম্ভবও ছিল। কিন্তু সরকারের অভ্যন্তরের কর্তৃত্ববাদী অংশ বলপ্রয়োগের পন্থা অবলম্বন করায় সরকারের করুণ পতন হয়েছে। সরকারের পতনে কোনো আক্ষেপ নেই। তারপরে যে lawlessness বা নৈরাজ্য চলছে, তা একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমার এবং আমাদের মনোবেদনার কারণ; সে আলোকে জাতিসংঘের তদন্ত টিমকে তার কার্যবিধির আওতায় বিষয়গুলো নিতে সবিনয় অনুরোধ করা হলো।”