গত এক সপ্তাহে সারাদেশে সাত হাজারের বেশি ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট ও রেঞ্জ। তাদের মধ্যে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হতাহতের ঘটনায় করা মামলার পাশাপাশি মাদক, খুন, ছিনতাই, ডাকাতিসহ অন্যান্য অপরাধের আসামিও রয়েছেন। পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও দলের নেতা–কর্মীদের বিদেশে পালিয়ে যাওয়া নিয়ে সমালোচনার মুখে পড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ ছাড়া চিহ্নিত অস্ত্রধারীদের গ্রেপ্তারে ধীরগতিরও সমালোচনা রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের দুই মাসের মাথায় এসে আসামি গ্রেপ্তারে পুলিশের তৎপরতা কিছুটা বেড়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, গত সপ্তাহে ঢাকায় প্রতিদিন গড়ে গ্রেপ্তার হয়েছেন এক শর বেশি। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে স্বাভাবিক সময়ে রাজধানীতে বিভিন্ন ধরনের মামলায় প্রতিদিন ২৫০-৩০০ জন আসামি গ্রেপ্তার হতেন। কোনো আন্দোলন বা বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এই গ্রেপ্তারের সংখ্যা আরও বেড়ে যেত। তখন রাজনৈতিক নেতা–কর্মী ছাড়া অন্যান্য গ্রেপ্তারের সংখ্যা হতো নামমাত্র।
পুলিশের আটটি মহানগর ইউনিট, নয়টি রেঞ্জ (রেলওয়ে রেঞ্জসহ) ও র্যাবের হাতে গ্রেপ্তারের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত এক সপ্তাহে (১ থেকে ৭ অক্টোবর) সারা দেশে মোট গ্রেপ্তার হয়েছেন ৭ হাজার ১৮ জন। সবচেয়ে বেশি গ্রেপ্তার হয়েছেন চট্টগ্রাম রেঞ্জে, ১ হাজার ২৪৯ জন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেশি গ্রেপ্তার হয়েছেন ঢাকা রেঞ্জে, ১ হাজার ৩৩ জন। গ্রেপ্তারে সংখ্যায় তৃতীয় রাজশাহী রেঞ্জ। তারা মোট ৮৬৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। মহানগর পুলিশের ইউনিটগুলোর মধ্যে ঢাকা মহানগর পুলিশ সর্বোচ্চ ৭৬৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। আর সারা দেশে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) গ্রেপ্তার করেছে ৪০০ জনকে।
গ্রেপ্তার হচ্ছেন কারা
গ্রেপ্তারসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে হতাহতের ঘটনায় করা মামলার গুরুত্বপূর্ণ আসামিদের গ্রেপ্তারে এখন সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। এসব মামলায় বিগত সরকারের অনেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, আলোচিত নেতা ও সাবেক সরকারি কর্মকর্তারা আসামি হয়েছেন। যাঁদের অনেকের বিরুদ্ধে ইতিপূর্বে বড় ধরনের অপরাধ ও দুর্নীতির অভিযোগও রয়েছে।
এরপর গ্রেপ্তারে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে ছাত্র–জনতার আন্দোলনে হামলাকারী, বিশেষ করে অস্ত্রধারীদের। আন্দোলন দমনে আওয়ামী লীগ ও এর অন্যান্য সংগঠনের যাঁরা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন কিংবা হামলাকারীদের সংগঠিত করেছেন, তাঁদেরও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অন্তত ২২২টি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ১৯০টি হত্যা মামলা। বেশির ভাগ মামলায় শেখ হাসিনা ছাড়াও তাঁর সরকারের সাবেক মন্ত্রী, আওয়ামী লীগের নেতা, সাবেক আইজিপি, ডিএমপির সাবেক কমিশনারসহ পুলিশের বিভিন্ন পদমর্যাদার কর্মকর্তা ও সাবেক কর্মকর্তাদের আসামি করা হয়।
এখন পর্যন্ত মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশার শীর্ষস্থানীয় ৪৫ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। এর মধ্যে রোববার সাবেক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী ও নারায়ণ চন্দ্র চন্দ, সাবেক মুখ্য সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান নজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর আগের দিন শনিবার সাবেক সংসদ সদস্য ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর বাইরে গত এক সপ্তাহে আরও কয়েকজন সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য, সাবেক সরকারি কর্মকর্তাসহ বেশ কয়েকজন গ্রেপ্তার হন।
সরকার পতনের দুই মাসের মাথায় অক্টোবরের শুরুতে এসে গ্রেপ্তারের এমন তৎপরতার জন্য কয়েকটি কারণের কথা জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিগত সময়ে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়েছেন—এমন অনেকেই অবৈধভাবে দেশত্যাগ করেন। এ নিয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন মহল থেকে সরকারের ভূমিকা নিয়ে সমালোচনা হয়। এ জন্য গ্রেপ্তার অভিযান জোরদারের চেষ্টা করা হচ্ছে। এর বাইরে দুর্গাপূজা ঘিরে বাড়তি নিরাপত্তার বিষয়টিও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গুরুত্ব দিচ্ছে।
এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমনে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহারের চিত্র বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসেছে। কিন্তু তাঁদের অনেকে গ্রেপ্তার হননি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে নানা সময়ে দাবি জানানো হয়েছে। ফলে সরকারও বিষয়টি গুরুত্বসহকারে নিয়েছে। তবে পুলিশের ভঙ্গুর অবস্থার কারণে এত দিন গ্রেপ্তার অভিযান জোরদার করা যায়নি।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানিয়েছে, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বেশ কয়েক দিন পুলিশের তেমন কোনো কার্যক্রম ছিল না। সরকার পতনের ১০ দিন পর সব কটি থানার (মোট ৬৩৯) কার্যক্রম শুরু হলেও অনেক থানায় তা ছিল নামমাত্র। আন্দোলনের সময় হামলার কারণে কিছু থানা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাহিনীর সদস্যদের মনোবলও ভেঙে যায়। ফলে পুলিশ কার্যত বড় ধরনের অভিযানে যেতে পারছিল না। দুই মাসের মাথায় এ অবস্থা থেকে অনেকটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে পুলিশ।
পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) ইনামুল হক বলেন, ‘থানা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এবং অনেক গাড়ি নষ্ট হওয়ায় শুরুতে পুলিশি কার্যক্রমে আমরা বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছি। তবে এখন মাঠপর্যায়ে নতুন নেতৃত্বে সে অবস্থা থেকে অনেকটা কাটিয়ে উঠছে।’
বর্তমানে গ্রেপ্তারের চিত্র নিয়ে ইনামুল হক বলেন, যেসব এলাকায় অপরাধ বেশি, সেসব এলাকায় গ্রেপ্তার বেড়েছে। তবে অস্ত্র উদ্ধার ছাড়া বিশেষ কোনো অভিযান চলছে না।