আমরা সবাই বলতে চাইব যে একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদাররা হেরে গিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তারপর আমরা নিজেরা কেবলই হেরে যাচ্ছি। অভিজ্ঞতা থেকেই বলা। বক্তব্যটি ভেতর থেকে উঠে আসে, বড় দুঃখে। কিন্তু কার কাছে হারলাম? কে-ই বা হারল?।না, পাকিস্তানিদের কাছে নয়। ওই গৌরব তাদের একেবারেই প্রাপ্য নয়। হার হয়েছে সেই শক্তির কাছে, যারা পাকিস্তানিদের দোসর ছিল এবং রয়েছে এখনো। তাদের বাড়বাড়ন্ত কমেনি, বরং এখন মহীরুহ হয়ে উঠেছে। তাদের টিকে থাকা এবং ফিরে আসা প্রভুর ছত্রচ্ছায়ায়।
প্রভুটির নাম পুঁজিবাদ। পরাজয় ঘটেছে তার কাছেই। আশা ছিল পাকিস্তানি হানাদারদের পতনের সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীনতাবিরোধী এবং তাদের ওই প্রভুরও পতন ঘটবে। ঘোড়া পড়ে গেলে ঘোড়সওয়ারও পড়ে যাবে। কিন্তু তা কি হয়? এই সওয়ারটি অনেক বেশি শক্তি রাখে। তার ক্ষমতা বিশ্বব্যাপী ন্যস্ত; সে কেন পড়ে যাবে খামোখা? একটি ঘোড়া গেছে, অন্য ঘোড়া সহজেই পেয়ে যাবে। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি এই পুঁজিবাদের নতুন ঘোড়া বটে। সওয়ারটি দাবড়ে বেড়াচ্ছে। আর ওই যে আমাদের আশা, তার ভিত্তিটিই বা কী ছিল? ভিত্তি ছিল জনগণের আত্মত্যাগ।
তারা এমনভাবে লড়েছে, এত অধিক মূল্য দিয়েছে এবং এতটা ঐক্যবদ্ধ ছিল যে ভরসা ছিল, পুঁজিবাদের পতন ঘটবে এবং বাংলাদেশের মানুষ কেবল স্বাধীন নয়, প্রকৃত প্রস্তাবেই মুক্ত হবে। কিন্তু কেবল আত্মত্যাগে তো ওই রকমের পরাক্রমশীল শক্তির, নাম যার পুঁজিবাদ, তার পতন ঘটে না। সাময়িকভাবে পিছু হটলে অনতিবিলম্বে সে ফিরে আসে। আমরা তো বুঝতেই পারছি যে আমাদের ক্ষেত্রেও ঠিক ওই ঘটনাই ঘটেছে। সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন এবং পুঁজিবাদ শক্তিমত্তায় ফিরে এসেছে। কেবল ফেরত আসেনি, আগের চেয়ে বেশি নৃশংস হয়ে এসেছে, যেন তাকে বিরক্ত করার দরুন ক্ষিপ্ত সে, শাস্তি দেবে।
বাংলাদেশ একটি রাষ্ট্র বটে, কিন্তু কতটা স্বাধীন? নামে স্বাধীন, ভূখণ্ডে নতুন, কিন্তু স্বভাব-চরিত্রে? না, স্বভাব-চরিত্রে সে এতটুকু বদলায়নি। পুরনো রাষ্ট্রের মতোই রয়ে গেছে, আমলাতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী। হ্যাঁ, শাসক বদলেছে। পুরনো শাসকদের জায়গায় নতুন শাসক এসেছে, কিন্তু তারা রাষ্ট্রকে বদলাবে, এই রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক করবে, ভেঙে দেবে এর আমলাতান্ত্রিক কাঠামো, ঘটাবে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, প্রতিষ্ঠা করবে মানুষে-মানুষে অধিকার ও সুযোগের সাম্য—এসব কেন আশা করব আমরা? আশা অবশ্য করেছিলাম ওই আত্মত্যাগের কারণেই। কিন্তু জনগণের আত্মত্যাগের কি মূল্য আছে এই সাম্রাজ্যবাদ অনুগত শাসক শ্রেণি এবং তাদের স্বার্থ সংরক্ষণকারী আমাদের এই নতুন রাষ্ট্রের কাছে?
কে হারল—এই প্রশ্নের জবাবও এই বাস্তবতার ভেতরই পাওয়া যাবে। হেরে গেছে জনগণ। হেরেছে এই জন্য যে তাদের রাজনৈতিক সংগঠন নেই, নেতৃত্বের রয়েছে অভাব, অভাব ঘটেছে রাজনৈতিক শক্তির। একাত্তরের পর থেকে যে নেতৃত্বকে আমরা পেয়েছি, তারা হারেনি, তারা আত্মসমর্পণ করেছে। হারতে হলে লড়তে হয়। রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বে যারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তারা তো পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেনি। প্রশ্নই ওঠে না লড়াইয়ের। তারা উদগ্রীব ছিল আত্মসমর্পণে। সেটিই তারা করেছে। আত্মসমর্পণের পর এখন চলছে তোয়াজ করার পালা। এখানে তারা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী। জনতার জয় পদপৃষ্ট হচ্ছে বিজয় উদ্ধৃত পুঁজিবাদ ও পুঁজিবাদীদের দাপটের নিচে। এই বিজয়টি যেমন স্থানীয়, তেমনি আন্তর্জাতিক; পুঁজিবাদ একটি বিশ্বব্যাপী ব্যবস্থা বটে। একাত্তরে এ দেশের মানুষের জীবনে যে দুর্ভোগ নেমে এসেছিল, সেটি ছিল অপরিমেয়, কিন্তু যুদ্ধের ভেতর দিয়ে যে গৌরব তারা অর্জন করেছিল, তা-ও ছিল অতুলনীয়। ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি জাতির ইতিহাসে গৌরবের অতি উজ্জ্বল মুহূর্ত, কিন্তু তারপর?
তার পরের ইতিহাস উত্থানের থাকেনি, পরিণত হয়েছে পতনে। আমরা নামছি। কেবলই নামছি। এই নিম্নধাবমানতা নানা ক্ষেত্রে ঘটছে। সবচেয়ে ক্ষতিকরভাবে ঘটেছে মূল্যবোধের ক্ষেত্রে। খুব জরুরি যে মূল্যবোধ, সেটি হচ্ছে দেশপ্রেম। এই দেশপ্রেমেরই চূড়ান্ত প্রকাশ আমরা দেখেছি একাত্তরে; আজ তার অভাব দেখছি পদে পদে। দেশপ্রেমের একটি বড় প্রকাশ ঘটেছিল ১৯০৫ সালে, বঙ্গভঙ্গ রদ করার সংগ্রামে। কিন্তু সেটি ঘটেছিল সীমিত আকারে; সীমাবদ্ধ ছিল মধ্যবিত্তর মধ্যে, যে মধ্যবিত্ত সেদিন ছিল মূলত হিন্দু সম্প্রদায়ের দ্বারা গঠিত। বঙ্গভঙ্গকে প্রতিরোধ করার আন্দোলনে প্রবল দেশপ্রেমের জোয়ার এসেছিল। প্লাবন দেখা দিয়েছিল জাতীয়তাবাদের। মানুষ কারাভোগ করেছে, প্রাণও দিয়েছে, কিন্তু নেতৃত্বের মারাত্মক রকমের ভ্রান্ত পদক্ষেপের দরুন ওই জাতীয়তাবাদ চলে গেল ধর্মীয় পুনর্জাগরণের অন্ধ পথে।
হিসাব করলে সেদিন দেখা যেত বাঙালিদের মধ্যে মুসলমানের সংখ্যা মোটেই অল্প ছিল না। আসলে তারাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। হিন্দু জাতীয়তাবাদের জোয়ার মুসলমানদের সঙ্গে নিতে পারল না, বরং দেখা দিল সাম্প্রদায়িক বিভাজন। পরিণতিতে দাঙ্গা বাধল এবং সাতচল্লিশে দেশ গেল ভাগ হয়ে। সবই ঘটল নেতৃত্বের ব্যর্থতার কারণে।
একাত্তরে দাঙ্গা হয়নি, যুদ্ধ হয়েছে। বাঙালি বিভক্ত হয়নি, ঐক্যবদ্ধ ছিল। এ যেন সাতচল্লিশের সেই ভুলের সংশোধন। এবারে দেশভাগের প্রশ্ন নেই, এবারের প্রশ্নটি রাষ্ট্রকে ভাঙার। রাষ্ট্র ভাঙল। এলো স্বাধীনতা, কিন্তু তারপর? তার পরে দেশপ্রেমের পতন ঘটেছে, কিন্তু কেন? এবারও দায়িত্ব নেতৃত্বেরই। না, যত দোষ নন্দ ঘোষের নয়, পতনের জন্য নেতারাই দায়ী। দোষ তাঁদেরই। তাঁরা লড়াইতে যেতে চাননি। যুদ্ধ নয়, তাঁরা চেয়েছিলেন স্বায়ত্তশাসন, যার অর্থ তাঁদের জন্য অবাধ স্বাধীনতা; অন্য কিছুর নয়, লুণ্ঠনের। তাঁদের আন্তরিক দীক্ষা ছিল পুঁজিবাদে। সেই দীক্ষাটিকে যুদ্ধের সময়ে প্রকাশ না করলেও বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে উন্মোচিত করেছেন। উন্মোচনেরও দরকার হয়নি, আপনা-আপনি বের হয়ে পড়েছে। দেশপ্রেম ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে পুঁজিবাদের দাপটে। যুদ্ধ-পরবর্তী পুঁজিবাদীরা লড়াই করেছেন নিজেদের মধ্যে, ক্ষমতার (অর্থাৎ লুণ্ঠনের অধিকারের) ভাগাভাগি নিয়ে। পাকিস্তানিদের সঙ্গেও তাঁদের লড়াইটি ছিল ওই ভাগাভাগি নিয়েই। আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়েই সাঙ্গ করা যাবে বলে ভরসা করেছিলেন।
জনগণের লক্ষ্যটি ছিল ভিন্ন। তারা ক্ষমতার ভাগ পাবে, এটি আশা করেনি; ওই লোভে যে উত্তেজিত হয়েছে, তা-ও নয়। তাদের আশা ছিল মুক্তির। স্বায়ত্তশাসনের নয়, ক্ষমতা হস্তান্তরেরও নয়, তাদের জন্য স্বপ্নটি ছিল অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির। তারা আশা করেছে এমন একটি সমাজ ও রাষ্ট্র পাবে, যেখানে মানুষে-মানুষে সম্পদ, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা ইত্যাদি নিয়ে বৈষম্য থাকবে না; কেউ কারো শত্রু হবে না, সবাই হবে সবার মিত্র। বলা বাহুল্য জনগণ এই মুক্তি পায়নি।
পুঁজিপন্থীরা কিন্তু স্বাধীনতা পেয়ে গেলেন। তাঁরা আরো ধনী হলেন। তাঁদের ধন-সম্পদ বৃদ্ধি পেল অবিশ্বাস্য গতিতে। তাঁদের সংখ্যাও যে খুব সীমিত রইল তা নয়, বেশ বেড়ে গেল। কিন্তু জনগণের সংখ্যার তুলনায় তাঁরা অবশ্যই অল্প। তবে তাঁদের দাপট অসম্ভব প্রবল। বাংলাদেশ এখন সেই দাপটে থরথর করে কাঁপে।
জনগণ দেখল নতুন রাষ্ট্রের চেহারা আগের রাষ্ট্রের চেয়ে ভয়ংকর। এই রাষ্ট্র শাসক শ্রেণির অধীন তো বটেই, কিন্তু রীতিমতো সন্ত্রাসীও বৈকি। সাতচল্লিশের পর বহু মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছিল, এবারও হলো; নিজের দেশের মধ্যেই তারা গৃহহীন, আশ্রয়হীন। তাদের দেশ নেই, দেশ চলে গেছে অন্যদের হাতে, যাঁদের হৃদয় ও মস্তিষ্কে দেশের জন্য কোনো স্থান অবশিষ্ট নেই। বাংলাদেশে এখন দেশপ্রেমিক বলতে শ্রমজীবী মানুষকেই বোঝায়। এই মানুষরাই উৎপাদন করে। দেশকে তারাই টিকিয়ে রেখেছে এবং দেশের বাইরে তাদের জন্য কোথাও কোনো স্থান নেই। যতই গৃহহারা হোক, এই মানুষরাই গৃহী এবং দেশপ্রেমিক। আর উদ্বাস্তু হচ্ছেন তাঁরা, যাঁদের ধন-সম্পত্তি অনেক। বস্তুত যাঁর বিত্তবেসাত যত অধিক, তিনিই তত বড় উদ্বাস্তু, আমাদের এই বাংলাদেশে। তাঁদের আদর্শ এ দেশ নয়, আদর্শ হচ্ছে পুঁজিবাদী বিশ্ব। মানুষের জন্য সবচেয়ে মূল্যবান বিনিয়োগ হচ্ছে সন্তান-সন্ততি; সেই বিনিয়োগ তাঁরা দেশে করেন না, করেন বিদেশে। সন্তানরা বিদেশে যায় পড়ালেখার অজুহাতে, গিয়ে আর আসে না, এলেও আগমনটা বিদেশির মতোই, অবস্থানও সেই প্রকারেরই। ধনীদের জন্য বাংলাদেশ এখন এক প্রকারের জমিদারি। জমিদারদের তবু সরকারি তহবিলে খাজনা দিতে হতো, তাঁরা সেটিও দেন না।
পুঁজিবাদের দাসানুদাস এই শাসক শ্রেণিই দেশপ্রেমের অবনতির জন্য দায়ী। তারাই হচ্ছে দৃষ্টান্ত। তারা তাদের আদর্শকে জনগণের ভেতর ছড়িয়ে দিয়েছে। মানুষকে যতভাবে পারা যায় উদ্বুদ্ধ করছে আত্মস্বার্থ সর্বস্ব ও ভোগবাদী হতে। উসকানি দিচ্ছে সব কিছু ভুলে কেবল নিজের কথা ভাবতে। মানুষকে নিয়ে এসেছে বাজারে। সর্বোপরি সর্বক্ষণ ব্যস্ত রাখছে জীবিকার সন্ধানে, যাতে অন্য কিছু ভাবার সময় না হয়, বিশেষ করে শাসক শ্রেণির অত্যাচার যেন চোখের বাইরে থাকে।
বাংলাদেশের শাসক শ্রেণি দুটি কাজ খুব দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করেছে—একটি বেকার সৃষ্টি, অন্যটি মাদরাসা শিক্ষার বিস্তার। দুটিই দেশপ্রেমের বিকাশের পথে মস্ত বড় অন্তরায়। এ দেশের ধনীরাই হচ্ছেন শাসক এবং তাঁরা বিনিয়োগ করেন না, লুণ্ঠন করেন। তাঁদের লুণ্ঠন তৎপরতায় বিনিয়োগ নিরুৎসাহ হয়। জনগণের আয় তাঁরা ব্যাংকের মাধ্যমে কিছুটা, কিছুটা নানা রকম প্রতারণার ভেতর দিয়ে আত্মসাৎ করে ফেলেন। ফলে কর্মসংস্থান বাড়ে না। লোক বাড়ছে, কাজ বাড়ছে না; অথচ করার মতো কাজের কোনো অভাব থাকার কথা নয়, আমাদের মতো অনগ্রসর দেশের। সরকার আসে যায়, কিন্তু কোনো সরকারকেই দেখা যায় না কাজ সৃষ্টির ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হতে। পুঁজিবাদ এমনিতেই শ্রমিকবিরোধী, শ্রমঘন উৎপাদনকে যে ঘৃণা করে, তার পক্ষপাত প্রযুক্তিঘন উৎপাদনের প্রতি। বাংলাদেশি পুঁজিবাদ উৎপাদনে বিশ্বাসই করে না, তার নির্ভরতা লুণ্ঠন ও ব্যবসায়। বলা বাহুল্য, ব্যবসা জিনিসটিও লুণ্ঠন ভিন্ন অন্য কিছু নয়।
যে মানুষটি বেকার, তার তো কোনো দেশপ্রেম থাকার কথা নয়। দেশ তো তাকে কিছুই দিচ্ছে না, বিড়ম্বনা ভিন্ন। তার সার্বক্ষণিক চিন্তা নিজেকে নিয়ে। বেকার মানুষের মতো আত্মপ্রেমিক সংসারে সত্যি বিরল। বেকারে যখন দেশ ছেয়ে যাচ্ছে, দেশে তখন দেশপ্রেমের বন্যা বইবে এমনটি আশা করা মোটেই যুক্তিসম্মত নয়।
লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়