সারাদেশে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হলো সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। দেবী দুর্গাকে বিদায় জানাতে ঢাকাসহ সারাদেশে ভক্তরা ভিড় করেন। অনেকে অশ্রুসজল চোখে দেবীকে বিদায় জানান।
১৩ অক্টোবর (রোববার) রাজধানীর সদরঘাটে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ নদ, টাঙ্গাইলের ঝিনাই নদী ও টেকনাফসেহ সারাদেশে দেবী দূর্গার ভক্তরা প্রতিমা বিসর্জন করেন। এদিন বিকাল থেকেই প্রতিমা বিসর্জনের প্রস্তুতি নেন ভক্তরা। সকালে দর্পণ-বিসর্জনের মাধ্যমে বিদায় জানানো হয় দেবী দুর্গাকে। পরে বিকেল ৪টা থেকে শুরু হয় প্রতিমা বিসর্জনের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম।
দুপুরে রাজধানী ঢাকায় পূজা উদযাপন পরিষদ এবং মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির যৌথ উদ্যোগে বের হয় বর্ণাঢ্য বিজয়া শোভাযাত্রা। বিজয়া শোভাযাত্রা ও প্রতিমা বিসর্জনে অংশ নিতে দুপুর গড়াতেই ভক্তরা রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার পূজামণ্ডপ থেকে ট্রাকে করে প্রতিমা নিয়ে সমবেত হতে শুরু করেন পলাশীর মোড়ে।
পরে শত শত ট্রাক প্রতিমা নিয়ে সদরঘাটের উদ্দেশে রওনা দেয়। ঢাকেশ্বরী থেকে শুরু করে বিজয়া শোভা যাত্রাটি শহীদ মিনার, হাইকোর্ট, পুলিশ হেড কোয়ার্টার্স, গোলাপ শাহ মাজার, কোর্ট এলাকা হয়ে সদরঘাট পৌঁছে।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় উৎসবকে ঘিরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছিলো বিশেষ সতর্কতায়। পুরো আয়োজন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে জোরদার করা হয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা। রাস্তার মোড়ে, বিভিন্ন ভবনের ছাদে ও গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে ছিলো পুলিশের কড়া নজরদারি।
তবে অধিকাংশ মণ্ডপের প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হলেও রাজধানীর ঢাকেশ্বরী মন্দিরের প্রতিমাটি রেখে দেওয়া হয়। কিন্তু পূজার কাজে ব্যবহৃত দেবীর ফুল, বেলপাতা ও ঘট বিসর্জন দেওয়া হয়। এর আগে মণ্ডপে মণ্ডপে সিঁদুর খেলায় মেতে ওঠেন নারীরা।
প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, প্রতি শরতে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে স্বর্গলোক কৈলাস ছেড়ে মর্ত্যে আসেন দেবী দুর্গা। নির্দিষ্ট তিথি পর্যন্ত বাবার বাড়িতে কাটিয়ে আবার ফিরে যান দেবালয়ের কৈলাসে স্বামীর বাড়িতে। দেবীর অবস্থানকালে এই পাঁচ দিন পৃথিবীতে ভক্তরা দেবীর বন্দনা করেন।
বিজয়া দশমীতে পূজা উদযাপনের প্রধান আচারের অংশ হিসেবে এদিন নারীরা সিদুঁর খেলায় অংশ নেন। শহরের মণ্ডপ ও মন্দিরে দুর্গার পায়ে সিঁদুর নিবেদন করেন, যা ঐতিহ্যবাহী সিঁদুর খেলার অংশ। এই আচারটি দেবী দুর্গার শক্তির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে। তারপর হিন্দু নারীরা একে অপরের গায়ে সিঁদুর মাখিয়ে জীবনে সমৃদ্ধি কামনা করেন।
প্রথা অনুযায়ী প্রতিমা বিসর্জনের পর সেখান থেকে জল এনে (শান্তিজল) মঙ্গলঘটে নিয়ে তা আবার হৃদয়ে ধারণ করা হয়। আগামী বছর আবার এ শান্তিজল হৃদয় থেকে ঘটে, ঘট থেকে প্রতিমায় রেখে পূজা করা হবে। রামকৃষ্ণ মিশনে সন্ধ্যা আরতির পর মিশনের পুকুরে প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়। এরপর ভক্তরা শান্তিজল গ্রহণ করেন ও মিষ্টিমুখ করেন।
এদিন প্রতিমা বিসর্জনের জন্য কক্সবাজারের টেকনাফ সমুদ্র সৈকত পয়েন্ট হাজারো মানুষের ঢল নামে। টেকনাফের মেরিন ড্রাইভ সংলগ্ন সমুদ্র সৈকত পয়েন্টে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদ।
আয়োজকরা জানান, এ অনুষ্ঠানে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের ৪টি মন্দিরের ৬টি প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়। এছাড়া একই সময় উপজেলার হ্নীলা ও হোয়াইক্যং ইউনিয়নের তিনটি প্রতিমা নাফ নদীতে বিসর্জন ও বাহারছড়া শামলাপুরের একটিসহ মোট ৪টি স্থানে পৃথক প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়েছে।
এদিকে টাঙ্গাইলের কালিহাতি উপজেলার ঝিনাই নদীতে প্রতিমা বিসর্জন দেন দেবী দূর্গার ভক্তরা। সেখানে ঘটে এক অনাকাঙ্খিত ঘটনা। প্রতিমা বিসর্জন দিতে গিয়ে দুই নৌকার সংঘর্ষে এক কিশোর নিহত হয়। রবিবার বিকালে কালিহাতী পুরাতন থানা ঘাট এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, মানুষের মনের আসুরিক প্রবৃত্তি, কাম, ক্রোধ, হিংসা, লালসা বিসর্জন দেওয়াই মূলত বিজয়া দশমীর মূল তাৎপর্য। এ প্রবৃত্তিগুলোকে বিসর্জন দিয়ে একে অন্যের সঙ্গে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা করাই এ আয়োজনের উদ্দেশ্য।
চন্ডীপাঠ, বোধন ও অধিবাসের মধ্য দিয়ে ষষ্ঠী তিথিতে ‘আনন্দময়ীর’ আগমনে গত ৯ অক্টোবর থেকে দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গোৎসবের সূচনা হয়। পরবর্তী ৫দিন রাজধানীসহ দেশব্যাপী পূজামণ্ডপগুলোতে পূজা-অর্চনার মধ্যদিয়ে ভক্তরা দেবী দুর্গার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেন। দশমী তিথিতে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে উৎসবের শেষ হয়।
সারাদেশে এবছর ৩১ হাজার ৪৬১টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ঢাকা মহানগরে পূজার সংখ্যা ২৫২টি। এসব মণ্ডপে শারদীয় উৎসব নির্বিঘ্নে উদযাপন করার জন্য প্রশাসনের পাশাপাশি প্রতিটি পূজা উদযাপন কমিটিও নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করে। প্রতিটি মণ্ডপে মণ্ডপে লাগানো হয় সিসিটিভি ক্যামেরা এবং স্বেচ্ছাসেবক দলের কমিটি করা হয় মণ্ডপ পাহারার জন্য।