একদিকে সহকর্মী হত্যার ঘটনায় ‘দায়মুক্তি’, আরেক দিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় পুলিশ সদস্যরা কে কোথায় দায়িত্ব পালন করেছেন তা জানতে চাওয়া হয়েছে। এই দুই বিষয় নিয়ে হতাশা বিরাজ করছে পুলিশ প্রশাসনে। পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, যে কোনো হত্যাকাণ্ডেরই বিচার হওয়া উচিত। প্রকৃত দোষীদের খুঁজে বের করে বিচারের আওতায় আনা উচিত। তা না হলে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হবে না। কিন্তু শুধু আন্দোলনে নিহতদের বিচার করা হচ্ছে। পুলিশ সদস্য হত্যাকাণ্ডের বিচার হওয়া নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।
গত ১৪ অক্টোবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা এক নির্দেশনায় ১৫ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত ঘটনায় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সম্পৃক্ত কারও বিরুদ্ধে মামলা, গ্রেফতার ও হয়রানি না করার কথা বলা হয়েছে। এরপরই প্রশ্ন উঠেছে, ওই সময়ে যেসব পুলিশ সদস্য হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন তারা ন্যায়বিচার পাবেন কিনা? এছাড়া ৫ আগস্ট থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশে হত্যা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার শিকার ব্যক্তিরাও ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হবেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সম্প্রতি নোয়াখালীতে ৩ কিশোর-তরুণকে গ্রেফতারের পর দায় মুক্তির বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। ৫ আগস্ট নোয়াখালীতে দুই পুলিশ সদস্য হত্যার ঘটনায় তাদের গ্রেফতার করা হয়। এসময় তাদের কাছ থেকে নিহত পুলিশ সদস্যদের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনও উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছিল জেলা পুলিশ। গ্রেফতাররা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছে। তবে এই ঘটনায় সমন্বয়কদের কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গ্রেফতারের সমালোচনা করে স্ট্যাটাস দেন। অবশ্য একদিন পরই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম তার ফেসবুকে গুজব ও বিভ্রান্তি উল্লেখ করে জানান, নোয়াখালীতে গ্রেফতার হওয়া কিশোর-তরুণরা সমন্বয়কদের কেউ নয়। তারা ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সঙ্গেও সম্পৃক্ত ছিলেন না। এমনকি তারা স্থানীয়ভাবে বুলেট নামে একটি কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ওই ঘটনার জের ধরেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ১৫ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত এক ধরণের দায় মুক্তি দিয়ে নির্দেশনা দেয়। পুলিশ সদর দফতর জানায়, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় পুলিশের ৪৪ জন সদস্য নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ৪ আগস্ট সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানাতেই নিহত হয়েছেন অন্তত ১৫ জন পুলিশ সদস্য। এনায়েতপুর থানায় আক্রমণ ও হত্যাকাণ্ড নিয়ে মামলা দায়ের হলেও নিহত পুলিশ সদস্যদের পক্ষ থেকে কয়টি মামলা হয়েছে তা জানাতে পারেনি পুলিশ সদর দফতর। এনায়েতপুর থানায় দায়ের হওয়া মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক (তদন্ত) এস এম কামাল জানিয়েছেন, ওই ঘটনায় কাউকে গ্রেফতার করা যায়নি।
একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, হত্যাকাণ্ডের শিকার সব পুলিশ সদস্য যে ডিউটিরত অবস্থায় নিহত হয়েছেন তা কিন্তু নয়। কেউ কেউ কর্মস্থল থেকে সাদা পোশাকে বাসায় ফেরার পথেও হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। কাউকে কাউকে বাসার নিচেও নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
পুলিশ সূত্র জানায়, গত ১৯ জুলাই রামপুরায় আন্দোলনকারীদের নির্মম পিটুনিতে নিহত হন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআই’র ইন্সপেক্টর মাসুদ পারভেজ ভূঁইয়া। তিনি পিবিআইয়ের নারায়ণগঞ্জ জেলায় কর্মরত ছিলেন। ঘটনার দিন তিনি ছুটিতে বাসায় অবস্থান করছিলেন। সন্ধ্যার সময় বাসার নিচে গেলে উচ্ছৃঙ্খল জনতা তাকে পিটিয়ে হত্যা করে। ওই ঘটনায় ২৩ জুলাই মাসুদ পারভেজের স্ত্রী মেরিনা আক্তার বাদী হয়ে খিলগাঁও থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীসহ অজ্ঞাতনামাদের আসামি করা হয়। কিন্তু ওই হত্যাকাণ্ডের ঘটনাতেও এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করা যায়নি। এখন ওই মামলার ভবিষ্যতও অনিশ্চিত বলে মনে করছেন সহকর্মীরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানান, হত্যাকাণ্ড একটি ফৌজদারি অপরাধ। এটি কখনও তামাদি হয় না বা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় কখনও দায়মুক্তির সুযোগ নেই। তাহলে ভিকটিম পরিবারের প্রতি অবিচার করা হবে। কিন্তু এখন এসব মামলায় ভিকটিম পরিবার ন্যায়বিচার পাবে বলে মনে হয় না। এসব মামলা অনিশ্চয়তার মধ্যে আটকে গেছে।
ট্রাইব্যুনালের চিঠি নিয়েও পুলিশে তোলপাড়
এদিকে, গত ৩ অক্টোবর ও ৬ অক্টোবর আলাদা দুটি চিঠির মাধ্যমে পুলিশের কাছে ১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত রাজধানী ঢাকায় দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের তালিকা চেয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কো-অর্ডিটেনটর মাজহারুল হক স্বাক্ষরিত ৩ অক্টোবরের চিঠিতে বলা হয়েছে, গত ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ডিএমপির সকল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, পরিদর্শক (তদন্ত) ও ডিবিতে কর্মরত উপপরিদর্শক (এসআই) থেকে পরিদর্শকদের তালিকা; ১৮-১৯ জুলাই ও ৩ থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ডিএমপির সকল বিভাগ ও ইউনিট থেকে মোতায়েনকৃত ফোর্সদের সিসির সত্যায়িত কপি; কোনও অস্ত্রের ব্যালাস্টিক পরীক্ষার প্রতিবেদন থাকলে তার কপি চাওয়া হয়। এছাড়া ৬ অক্টোবর পাঠানো চিঠিতে ডিএমপির ক্রাইম ও অপারেশন বিভাগের অর্গানোগ্রাম ও ১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সময় পর্যন্ত কর্মরত অফিসারদের নাম-পদবী ও দায়িত্বের বিস্তারিত বিবরণ পাঠাতে বলা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা বলছেন, পুলিশের মধ্যম সারি থেকে কনস্টেবল পর্যন্ত সবাই ডিএমপি কমিশনারের নির্দেশনায় কাজ করে থাকে। পুলিশ কমিশনার যাকে যেখানে দায়িত্বের রোস্টার বানিয়ে দিয়েছেন, তা উপেক্ষা করার সুযোগ নেই কোনো পুলিশ সদস্য বা কর্মকর্তার। কারণ দায়িত্ব পালন না করলে তাকে বরখাস্ত বা বদলি করে দেওয়া হতো। এছাড়া পুলিশ সদস্য বা কর্মকর্তারা কমিশনারের লিখিত আদেশ মানতেও বাধ্য। সেখানে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যের তালিকা নিয়ে হয়রানি করার সুযোগ তৈরি হতে পারে।
ওই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, এছাড়া পুলিশ সদস্যরা কি করতে পারে তা পুলিশ রেগুলেশন বুক বা পিআরবিতে বলা আছে। বেআইনি মৌখিক নির্দেশ না মানার কথা বলা হলেও পুলিশ কালচারে ঊর্ধ্বতনদের মৌখিক নির্দেশ শোনার রেওয়াজ রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে ওই কর্মকর্তা বলেন, কোনও একটি সংঘর্ষের ঘটনা নিয়ন্ত্রণের জন্য বলপ্রয়োগের ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মৌখিক আদেশ দেবেন এটাই স্বাভাবিক। কারণ লিখিত আদেশ দেওয়া পর্যন্ত সময় নেওয়ার সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের গুলির ব্যবহারও করতে হয়। এছাড়া আইনেই বলা রয়েছে, সরকারি সম্পত্তি বিনষ্ট প্রতিরোধ বা নিজে আক্রমণের শিকার হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হলে পুলিশ সদস্যরা গুলি করতে পারবে। তাহলে কেন মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের এভাবে হয়রানি করা হচ্ছে?
একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা বলছেন, পুলিশের প্রধান সমস্যা হলো এর রাজনীতিকরণ। অতিমাত্রায় রাজনীতিকরণের কারণে অনেক কর্মকর্তা বেপরোয়া আচরণ করেন। তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। ঢালাওভাবে ব্যবস্থা নিলে বাহিনী হিসেবে পুলিশ আবার ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন হয়ে যাবে। কারণ সামনের দিনগুলোতে দুর্বৃত্তপনা ঠেকাতে বা বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে কেউ দায়িত্ব পালন করতে চাইবে না।