৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর পাল্টে যায় দেশের দৃশ্যপট। পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দেড় দশকের বেশি সময়ের পর স্বস্তি ফেরে বিএনপিতে। উজ্জীবিত হন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। কিন্তু, কিছু নেতাকর্মী শৃঙ্খলা পরিপন্থি কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ায় বিব্রত বিএনপির হাইকমান্ড।
এমন পরিস্থিতিতে দলের শৃঙ্খলা রক্ষায় হার্ডলাইনে হাইকমান্ড। কেউ দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গেলে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দলের শৃঙ্খলা ফেরাতে অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। কিন্তু তার এ পরিশ্রম ম্লান করে দিচ্ছেন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব ও সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দিন নাছিরের বেপরোয়া অনুসারীরা। দলের শৃঙ্খলা ফেরাতে কঠোর ছাত্রদলের শীর্ষ নেতারাও।
বলা হচ্ছে, বিশৃঙ্খলাকারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেও লাভ হচ্ছে না। ছাত্রদলের দায়িত্বশীলরা বলছেন, সামান্য অভিযোগ পেলেও সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এটা হচ্ছে সংগঠনের অবস্থান। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ‘ব্লেম গেম’ও হচ্ছে বলে পাল্টা অভিযোগ তাদের।
বিভিন্ন পর্যায়ের ‘অবাধ্য’ নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের স্তূপ পড়েছে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের কাছে। অভিযোগের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, রাজধানীর সরকারি তিতুমীর কলেজ শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম সম্পাদক রিমু হোসেনের নেতৃত্বে সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক চয়ন, ছাত্রনেতা আরিয়ান সৌরভ, শাওন, ছাত্রলীগ থেকে অনুপ্রবেশকারী এস এম শাকিল ও মুন্নাসহ ২০-২৫ জন বনানীতে জনশক্তি রপ্তানিকারক ব্যবসায়ী রাশেদুল ইসলামের কাছে চাঁদা দাবি করেন। তিনি চাঁদা দিতে অস্বীকার করলে ছাত্রদল নেতারা তাকে মারধর করে গুরুতর আহত করেন এবং তার অফিস থেকে তিনটি ল্যাপটপ, ৪০টির মতো পাসপোর্ট ও পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে যান।
তিতুমীর কলেজ শাখা ছাত্রদলের সিনিয়র নেতারা ছাত্রলীগ থেকে অনুপ্রবেশকারীদের প্রশ্রয় দেওয়া নিয়ে রিমুকে মৌখিকভাবে বার বার সতর্ক করলেও তিনি বিষয়টি এড়িয়ে যান। এ বিষয়ে তিতুমীর কলেজ শাখা ছাত্রদলের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ দায়িত্বশীল কয়েকজন নেতা কেন্দ্রীয় সংসদের কাছে গত ৫ সেপ্টেম্বর অভিযোগ দিলেও এখনো কোনো সুরাহা হয়নি।
অভিযোগ রয়েছে, রিমু ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দিন নাছিরের আশীর্বাদপুষ্ট হওয়ায় তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
এছাড়া তেজগাঁও কলেজ শাখা ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক ইয়াসিন ভূঁইয়া, সহ-সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমানের নেতৃত্বে জি এম ফারুক হোসেন নামে এক ব্যক্তিকে অস্ত্র দেখিয়ে প্রাইভেটকারে (ঢাকা-মেট্রো-ঘ-১৫-৮৬৯৫) তুলে দিয়ে যাওয়া হয়। এসময় সঙ্গে থাকা একটি স্যামসাং মোবাইল, অপো মোবাইল, ল্যাপটপ, তিনটি কম্পিউটার, সাত হাজার টাকা, ২০০ মার্কিন ডলার ছিনিয়ে নেয়। এরপর তাকে তেজগাঁও কলেজের পাশে ইন্দ্রপুরী ইন্টারন্যাশনাল হোটেলের ৪১১ নম্বর রুমে আটকে রাখেন। একপর্যায়ে সেখান থেকে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে ভুক্তভোগী জি এম ফারুক আদাবর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে গেলেও তা নেওয়া হয়নি। পরে বাদী ও বিবাদীকে থানায় ডেকে নিয়ে বিষয়টির মীমাংসা করা হয়। যুবদলের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সদস্য সচিব রবিউল ইসলাম নয়নের মাধ্যমে মধ্যস্থতা হয় বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
অভিযোগ রয়েছে, ইয়াসিন ও আব্দুর রহমান ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছিরের ঘনিষ্ঠজন হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
চট্টগ্রামের মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন নামের এক ব্যবসায়ীর অভিযোগ, গত ৩০ আগস্ট দুপুর আড়াইটার দিকে চট্টগ্রাম শহরের সেন্ট্রাল প্লাজার সামনে থেকে খুলশী থানা ছাত্রদলের সদস্য সচিব মো. নুর আলম সোহাগের নেতৃত্বে তাকে অপহরণ করা হয়। চোখ বেঁধে একটি গলিতে নিয়ে বেধড়ক মারধর করে সঙ্গে থাকা দুটি মোবাইল ছিনিয়ে নেয়। পরে তাকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। এসময় ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে তিনি প্রাণে রক্ষা পান বলে অভিযোগ করেন। বিষয়টি নিয়ে ছাত্রদলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বরাবর অভিযোগ দিলেও অভিযুক্ত নুর আলম সোহাগের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
অভিযোগ রয়েছে, নুর আলম সোহাগ সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দিন নাছিরের ঘনিষ্ঠজন হওয়ায় তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
গত ৪ সেপ্টেম্বর এক ব্যবসায়ীর কাছে চাঁদা চাওয়ার অভিযোগে কলাবাগান থানা ছাত্রদলের আহ্বায়ক ওবায়দুল ইসলাম সৈকতকে সাংগঠনিক পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়। তিনি ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিবের অনুসারী বলে জানা গেছে।
অভিযুক্তদের বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দিন নাছির বলেন, ‘তিতুমীরের ঘটনায় রিমুর সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি। ইয়াসিনের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ সেটা পরিষ্কার না। আর চট্টগ্রামের বিষয়ে কেউ অভিযোগ করলে আমরা দেখবো। সংগঠনের যে কোনো পর্যায়ের নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সামান্যতম অভিযোগ থাকলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এটাই সংগঠনের অবস্থান। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ব্লেম গেমও চলছে।’
ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব বলেন, ‘সংগঠনের নেতাকর্মীকে অনুসারী বানানোর যে কথাটা বলা হচ্ছে এটা খুবই দুঃখজনক। আমি ছাত্রদল সভাপতি, সবাই ছাত্রদল করেন। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তদন্তসাপেক্ষে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বিষয়টি অচিরেই জানানো হবে।’