মুক্তির যুদ্ধ চলছে, বিজয় অবশ্যম্ভাবী

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। ফাইল ছবি

একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীরা কেউই সাধারণ অপরাধী ছিল না, চোর বা পকেটমার নয়, তারা গণহত্যাকারী। এবং আমরা যে এত দিনেও তাদের রাজনীতি থেকে বিচ্যুত করতে পারিনি সে ব্যর্থতা আমাদেরই বরং অপরাধী করে রেখেছে। আমরা আজ অপরাধী আমাদের শহীদদের কাছে, অতীত ও বর্তমান প্রজন্মের কাছে, নিজেদের বিবেকের কাছে এবং সমগ্র বিশ্বের কাছে। বিশ্বের সব বিবেকমান মানুষই চায় স্বাধীন দেশে স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনীতি করার অধিকার রহিত হোক।

সেটা সম্ভব না হওয়ার ব্যর্থতা আমাদের জন্য অপরাধ তো বটেই, মস্ত বড় লজ্জাও। ন্যায়বিচার, নানা অপরাধের শাস্তি, দুর্নীতি দমন—এসব আওয়াজ হরহামেশাই শোনা যায়। কিন্তু সব অপরাধই একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের তুলনায় সামান্য। কেননা যুদ্ধাপরাধীরা যা করেছিল তা হলো জাতিগত গণহত্যা।

ওই গণহত্যাকারীদের রাজনীতি থেকে বিদায় আমরা করতে পারিনি, তখন অন্যান্য দুষ্কর্মের বিস্তার রোধ হবে এমনটা আশা করি কী করে? আমাদের বিচারব্যবস্থায় এক শ একটা গলদ খুঁজে পাওয়া যাবে, কিন্তু তার গোড়ার গলদটা হচ্ছে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা যেসব অপরাধীর অপরাধকে পরাভূত করে ঘটেছে, তাদের স্থায়ী রোধে জাতির কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে না পারা। অত বড় অপরাধ করে যদি পার পাওয়া যায়, তবে ছিঁচকে অপরাধীরা ভয় পাবে কেন? ভয় পাচ্ছেও না।

এই যে আমরা সব দুর্নীতি, দুষ্কর্মের বিচার দাবি করছি, এটা প্রতিহিংসার ব্যাপার নয়, ব্যাপার ন্যায়বিচারের। বিচার করতে না পারলে নৈতিকভাবে আমরা পরাজিত হয়ে যাব, অতীতের ধারাবাহিকতায়।

আমরা আমাদের মাতৃভূমিকে ভালোবাসি, কিন্তু ঘৃণাহীন ভালোবাসা তো কোনো ভালোবাসা নয়, তাতে না থাকে গভীরতা, না থাকে আন্তরিকতা। দেশকে ভালোবাসতে হলে দেশের শত্রুদের ঘৃণা করতে হয়। প্রবল ভালোবাসার প্রয়োজনেই প্রচণ্ড ঘৃণা চাই। আর শত্রুকেই যদি না চিনি, তবে মিত্রকে চিনব কী করে? শত্রুদের আমরা মিত্রদের থেকে আলাদা করতে পারিনি এবং মিত্র খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়েছি শত্রুকে তার তৎপরতা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়ে।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পরও আমরা ধিক্কার দিতে চাই, প্রমাণ করতে চাই যে মানুষের জীবন মূল্যবান এবং মনুষ্যত্বের অবমাননা ঘটিয়ে পার পাওয়া যায় না। কেউ পায়নি কখনো, ছদ্মবেশী আত্মগোপনকারী যুদ্ধাপরাধীরাও পাবে না, যারা এখন ক্রমাগত আত্মপ্রকাশ করে চলেছে। এই যুদ্ধাপরাধীরা দেশের বাইরে থেকে এসেছিল; ছিল তারা দেশের ভেতরেও। বাইরে ছিল বর্বর হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী; ভেতরে ছিল তাদের দোসর বেঈমান রাজাকার, আলবদর, আলশামস। দুই পক্ষ মিলে এক পক্ষ হয়েছিল এবং যে নৃশংসতা ও নির্লজ্জতা সেদিন তারা প্রদর্শন করেছিল, তার তুলনা আছে কি না সন্দেহ। আমাদের মা-বোন-ভাই-বাবা-আত্মীয়-স্বজন-বন্ধুবান্ধবকে তারা যেভাবে হত্যা করেছে, লাঞ্ছিত করেছে, মৃত ও লাঞ্ছিতদের ওপর দাঁড়িয়ে উল্লাস করেছে, সেটা ছিল দানবীয়। আমরা যারা কোনোক্রমে বেঁচে গেছি এবং যারা আমাদের পরে এসেছে ও সৌভাগ্যক্রমে ওই দানবদের মুখোমুখি হয়নি, তাদের কি অধিকার আছে ওদের রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠার সুযোগ করে দেওয়ার?

পাকিস্তানি হানাদার দানবরা বাংলাদেশের মানুষের দ্বারা বিতাড়িত হয়েছে, কিন্তু তারা আসামি হয়নি; সেই আসামি না হওয়াটাই একটা বড় কারণ, যে জন্য আজ তারা তাদের নিজের দেশের মানুষের ওপর, ভগ্ন পাকিস্তানের অসহায় জনগণের ওপর নানা ধরনের ফ্যাসিবাদী নির্যাতন চালাচ্ছে।

যে দ্বিজাতিতত্ত্বের ওপর ভর করে পাকিস্তান দাঁড়িয়ে থাকতে সচেষ্ট ছিল, একাত্তর প্রমাণ করেছে সেটা ছিল কত বড় ও মারাত্মক রকমের একটা ভ্রান্তি। ভারতবর্ষ সব সময়েই বহুজাতির দেশ, তাকে এক জাতিতে পরিণত করা যেমন অসম্ভব ছিল, দুই জাতিতে ভাগ করাটাও ছিল তেমনি ভয়ংকর এক অন্যায়। ওই অন্যায় যারা করেছে, স্বাধীনতার নাম করে যারা দেশভাগ ঘটিয়েছে, তারা তখনকার ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে ছিল, মুসলিম লীগেও ছিল। সাতচল্লিশের দেশভাগের পর পাকিস্তানের খলনায়করা পূর্ববঙ্গের মানুষের ওপর বিশেষ রকম নিপীড়ন চালিয়েছে। একাত্তরে তারা এবং তাদের দ্বিজাতিতত্ত্ব উভয়েই পরাজিত হয়েছে। উভয়েই লেজ গুটিয়ে পালিয়েছিল, কিন্তু আমরা যেহেতু দ্বিজাতিতত্ত্বকে এবং তত্ত্বের রক্ষক গণহত্যাকারীদের পরিপূর্ণরূপে উন্মোচিত করে দিতে পারিনি এবং জালেমদের জন্য ব্যবস্থা করতে পারিনি স্থায়ী উৎপাটনে, তাই নানা ফাঁকফোকরের ভেতর দিয়ে, ছদ্মবেশ ধারণ করে, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠায় বাধা প্রদানকারী পুঁজিবাদী বিশ্বের সমর্থন পেয়ে এবং ওই পুঁজিবাদীদের সহায়তায় যারা বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় এবং রাজনীতিতে আরোহণ করেছে, তাদের আনুকূল্য লাভ করে তারা এবং তাদের ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের ধারণা উভয়েই আবার ফিরে এসেছে।

পাকিস্তান ছিল একটি বিকারের নাম, যে বিকার রাজনীতির কাজে ধর্মকে ব্যবহার করেছে এবং ধর্মের নামে নির্যাতন চালিয়েছে রাষ্ট্রের নাগরিকদের ওপর। সেই বিকার থেকে মুক্তিলাভের জন্য পূর্ববঙ্গের মানুষ সাতচল্লিশের পর থেকেই চেষ্টা শুরু করেছে। সেই চেষ্টারই চূড়ান্ত পর্যায়ে যুদ্ধাপরাধীরা অস্ত্রহাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আন্দোলনকারী নিরস্ত্র পূর্ববঙ্গবাসীর ওপর।

আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করি; সে চেতনার কেন্দ্রভূমিতে ছিল একটি সমষ্টিগত স্বপ্ন। ওই স্বপ্নটি মোটেই ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয় ছিল না, ছিল একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ার। যুদ্ধাপরাধীদের হামলাটি ছিল রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনের সেই সমষ্টিগত স্বপ্নটির ওপরই। তাদের বিচার করার মধ্য দিয়ে আমরা এটিও পুনরায় জানিয়ে দিতে চাই যে মুক্তির স্বপ্ন থেকে আমরা একচুলও সরে আসিনি। তাই যুদ্ধাপরাধীদের রাজনৈতিক ও সামাজিক পুনর্বাসনেরও আমরা বিরোধী। পুনর্বাসনের কাজটি যারা করেছে, তাদের আমরা ধিক্কার দিই। বিচারের দাবির সঙ্গে অপরাধীদের সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবে চিহ্নিত ও বিচ্ছিন্ন করার আকাঙ্ক্ষাও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সারা বিশ্বের কাছে এ বাণী নতুন করে পৌঁছে দেবে যে এ ধরনের অপরাধের কোনো ক্ষমা নেই। সতর্ক করে দেবে ভবিষ্যতে অপরাধীদের রাজনৈতিক পুনর্বাসনেও।

আমরা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ চাই, যার জন্য প্রথম শর্ত হচ্ছে রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতিষ্ঠা। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হচ্ছে ইহজাগতিক, সে বলে ধর্ম ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ব্যাপার, রাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যক্তিগত বিশ্বাসকে যুক্ত করা অসংগত এবং ধর্মবিশ্বাসকে নিরিখ করে নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি মস্ত বড় অন্যায়। হানাদার ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা যে কতটা গণতন্ত্রবিদ্বেষী ছিল তার প্রমাণ তারা রেখে গেছে ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর তাদের আক্রমণের মধ্যেই। ধর্মকে আচ্ছাদন হিসেবে ব্যবহার করে আজ যে দেশে তথাকথিত ধর্মভিত্তিক রাজনীতি তৎপর হয়ে উঠেছে, তারা ওই যুদ্ধাপরাধীদেরই মতাদর্শিক দোসর।

ধর্ম ব্যবসায়ীদের যারা স্থানীয় পৃষ্ঠপোষক, তাদের একাংশ যে রাষ্ট্রক্ষমতারই অংশীদার হয়ে পড়েছিল, সেটি মিথ্যা নয়। তাদের বাড়বাড়ন্তের পেছনে ওই পৃষ্ঠপোষকদের মদদ দান একটি স্বতঃপ্রকাশিত সত্য। অপরাধী এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকরা এখনো তৎপর রয়েছে। পার পেয়ে গেছে, লাই পেয়েছে। কেননা যুদ্ধাপরাধীদের উৎপাটিত করা সম্ভব হলে তাদের পৃষ্ঠপোষকরাও নির্মূল হতো।

যেদিক থেকেই দেখি না কেন, রাজনৈতিকভাবে ওদের পরাভূত করার কোনো বিকল্প নেই। অনেক বিলম্ব ঘটে গেছে, তাতে ক্ষতি হয়েছে প্রচুর, আমরা সঠিকভাবে সামনে এগোতে পারিনি, মীমাংসিত প্রশ্নকে অমীমাংসিত করার চেষ্টা হয়েছে, নানা ধরনের বিভ্রান্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, পঙ্কিলতা ও অন্ধকারের আবর্তে আমরা আটকা পড়ে গেছি। মুক্তিযোদ্ধারা আজ নত হয়ে ভিক্ষা করে, আলবদর, রাজাকার বুক ফুলিয়ে হাঁটে এবং আমোদ-উল্লাসে মত্ত হয়। এমনকি ব্যক্তিগত পর্যায়ে আমাদের নিজেদের মধ্যেও তো পশ্চাৎপদতা রয়েছে; বহুদিনের অভ্যাস, শিক্ষা ও প্রচার আমাদের নিজেদের ভেতরেও প্রতিক্রিয়াশীলতাকে লালন-পালন করেছে। যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতির অধিকার রহিত হলে এই যে গোপন আমি, অন্ধকারের আমি, সেও খবর পাবে আলোর পথ কোনটি, কোন পথ ধরে এগোনো চাই এবং কোন পথটি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যানযোগ্য।

একাত্তরে আমরা মাতৃভূমিকে মুক্ত করতে চেয়েছিলাম। হানাদারদের হটিয়েছি, কিন্তু তাদের দোসররা টিকে আছে। তাদের ভ্রান্ত মতাদর্শও কার্যকর রয়েছে, যে জন্য মুক্তি তো আসেইনি, এমনকি শত্রুমুক্ত যে হয়েছি, তা-ও নয়। ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ গঠনের এ কাজ আসলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধেরই অসমাপ্ত অংশ। যুদ্ধ শেষ হয়নি, তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া চাই। আমরা অপরাধবোধ, লজ্জা ও পশ্চাদমুখিতার ভারে অবনত হয়ে থাকতে চাই না, যেতে চাই সামনে।

কারা নেবে এগিয়ে? নেবে দেশের সাধারণ মানুষ, যারা মুক্তি চায়। আমাদের আবেদন তাই জনগণের কাছেই। কিন্তু আবেদন কেন বলছি? আমরা কারা? আমরা তো জনগণেরই অংশ। কিন্তু তবু আমাদের মধ্যে যারা দেশপ্রেমিক ও গণতান্ত্রিক, তাদের বিশেষ কর্তব্য এদের রাজনৈতিকভাবে পরাভূত করা। এবং এই দাবি ঊর্ধ্বে তুলে ধরা, যাতে তা সর্বজনীন হতে পারে। মুক্তির যুদ্ধ চলছে, তার ধারাবাহিক বিজয় অবশ্যম্ভাবী।

শেয়ার করুন