নব্বই দশকের জনপ্রিয় গায়ক মনি কিশোরের মরদেহ ৩ দিন ধরে পড়ে আছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে । দাফন নাকি সৎকার-এমন প্রশ্নে নিয়েও ছিল জটিলতা। মেয়ে দেশে আসা না আসা নিয়েও কথা উঠছিল। সবমিলিয়ে শিল্পীর দাফন বিলম্ব হচ্ছিল। অবশেষে সকল জটিলতার অবসান হয়েছে। আগামীকাল মনি কিশোরের দাফন করা হবে। এমন তথ্য জানিয়েছেন গীতিকার মিল্টন খন্দকার।
দাফন প্রসঙ্গে এ গীতিকার বলেন, ‘ মনি কিশোরের মেয়ে নিন্তী চৌধুরী সরকারিভাবে একটি কাগজ পাঠিয়েছেন। আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে থানা কর্তৃপক্ষ কাগজটি পেয়ে যাবে। পেতে হয়তো রাত হয়ে যাবে। রাতে তো আর দাফন সম্ভব নয়। আশা করছি আগামীকাল জোহরবাদ তাঁর নামাজে জানাযা ও দাফন হবে। এ বিষয়ে আগামীকাল সকালে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিতে চাই। যাতে তাঁর জানাজা ও দাফনে সবাই উপস্থিত থাকতে পারেন।
কোথায় দাফন হবে শিল্পীর? এমন প্রশ্নে জবাবে মিল্টন খন্দকার বলেন, ইতোপূর্বে মনি কিশোরের লাশ আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের মাধ্যমে দাফন কথা প্রচার হচ্ছিল। এটি আসলে ভুল তথ্য ছিল। মনি কিশোরের ভাই এটি ভুল করে বলেছিলেন। এখন পারিবারিকভাবে দাফনের চেষ্টা চলছে। দাফনের জন্য প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের কথা ভাবা হয়েছিল। সেখানে অনেক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে বলে সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছি। রামপুরা অথবা বনশ্রীর কোন একটি কবরস্থানে এখন দাফন করতে চাই। সরকারি কাগজটি হাতে পেলেই দাফনের স্থানটি সবাইকে জানিয়ে দিবো।
তিনি আরও বলেন, বলা হয়েছিল, মনি কিশোরের মেয়ে দেশে এলেই দাফন হবে। আমরার আশা করেছিলাম মেয়ে দেশে আসবেন। কিন্তু তাঁর পরীক্ষা চলার কারণে তিনি আসতে পারবেন না। এ কারণে সেখান থেকে তিনি বাংলাদেশ অ্যাম্বাসিতে লাশ দাফনের জন্য লিখিত দিয়েছেন। বাংলাদেশ অ্যাম্বাসী সেটি ঢাকায় পাঠিয়েছেন। ওই চিঠিটা এখন যাবে থানায়। এরপর হবে লাশ দাফন।
নব্বই দশকের জনপ্রিয় শিল্পী মনি কিশোর ছিলেন একাধারে গীতিকার, সুরকার এবং সংগীতশিল্পী। রামপুরা টেলিভিশন ভবনের পাশে একটি ভাড়া বাসায় একা থাকতেন মনি কিশোর। গত শনিবার রাতে এই শিল্পীর চিরদিনের জন্য পৃথিবী থেকে বিদায়ের খবর পাওয়া যায়। রামপুরা থানার উপ-পরিদর্শক খান আব্দুর রহমান তার মরদেহ উদ্ধার করেন।
নব্বই দশকের শুরুতে ‘চার্মিং বউ’ অ্যালবামের ‘কী ছিলে আমার’ শিরোনামের একটি গান মনি কিশোরকে প্রতিষ্ঠিত ও ব্যাপক পরিচিত করে দেয় সংগীতাঙ্গনে। একে একে ৩০টির বেশি একক অ্যালবাম করে ফেলেন। এরপর একসময় অডিও-জগৎ নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে যেতে থাকল। একটা সময় মনি কিশোর অনিয়মিত হয়ে পড়েন। পেশাদার সংগীতজীবনের শুরুতে বিয়ে করেন মনি কিশোর। শামীমা চৌধুরীর সঙ্গে সেই বিয়ে টেকেনি। দেড় যুগ আগে তাদের দাম্পত্য জীবনের ইতি ঘটে। বিয়ের সময় ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন মনি কিশোর। সে হিসেবে তার মরদেহের দাফন করা হবে বলে জানান বড় ভাই অশোক কুমার।
উদ্ধারকারী পুলিশ কর্মকর্তা মঙ্গলবার দুপুরে গণমাধ্যমকে বলেন, আপাতত শিল্পীর মরদেহ মর্গে থাকবে। শিল্পীর মেয়ে দেশে ফিরলেই তার সিদ্ধান্তে যা হওয়ার হবে। অথবা দূতাবাসের মাধ্যমে কোনো চিঠি পাঠিয়ে যদি কাউকে দায়িত্ব দেন, তখনই আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হতো। তা ছাড়া তিনি যে ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন, এ রকম প্রমাণাদি আমাদের সরবরাহ করতে পারলেও হয়। মনি কিশোর সাহেবের মেয়ে নিন্তি চৌধুরীর সঙ্গে আমাদের ওসি তদন্ত স্যারের কথা হয়েছে।
ওসি তদন্ত শাহাদাত হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, নিন্তি চৌধুরী আমাদের কাছে একটা তথ্য হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়েছেন। আমরা তাকে পরামর্শ দিয়েছি, স্থানীয় দূতাবাস অথবা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে যেন পাঠান। অন্যদিকে পরিবার, ভাই-বোনেরা চেয়েছিলেন হিন্দুধর্মমতে মরদেহের আনুষ্ঠানিকতা সারতে। দুই পক্ষ থেকে দুই ধরনের বক্তব্যের কারণে একটা বিতর্ক ও জটিলতা তৈরি হতে পারে। এই বিতর্ক ও জটিলতার অবসানে আমরা শিল্পী মনি কিশোরের মেয়ে নিন্তি চৌধুরীকে দেশে উপস্থিত হয়ে মরদেহ গ্রহণ করার পরামর্শ দিয়েছি। তিনি যদি দেশে আসতে না পারেন, তাহলে যথা নিয়মে প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহের অনুরোধ করেছি। এরপরই আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারব।
নব্বই দশক থেকেই গান গেয়ে শ্রোতার মন মাতিয়েছেন মনি কিশোর। সেই কবে গেয়েছিলেন ‘কী ছিলে আমার, বলো না তুমি’, তা আজও অনেক সংগীতপ্রেমী গেয়ে ওঠেন আপনমনে। সেই গানের স্রষ্টা মনি কিশোর দীর্ঘ সময় ধরে ছিলেন লোকচক্ষুর অন্তরালে। অনেকটা অভিমান থেকে নিজেকে আড়াল করে রেখেছিলেন। শেষ দিকে তো এমনও হয়েছে, কেউ যাতে তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারে, নিজের ব্যবহৃত পুরোনো মুঠোফোন নম্বর বন্ধ করে দিয়েছিলেন। মনি কিশোর পাঁচ শতাধিক গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। রেডিও-টিভির তালিকাভুক্ত শিল্পী হলেও গান গেয়েছেন অল্প। সিনেমায়ও তেমন গাননি। মূলত অডিওতে চুটিয়ে কাজ করেছেন।
তার জনপ্রিয় গানের মধ্যে ‘কী ছিলে আমার’, ‘সেই দুটি চোখ কোথায় তোমার’, ‘তুমি শুধু আমারই জন্য’, ‘মুখে বলো ভালোবাসি’, ‘আমি মরে গেলে জানি তুমি’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তার সবচেয়ে শ্রোতাপ্রিয় গান ‘কী ছিলে আমার’ তারই সুর করা ও লেখা। মাঝখানে দীর্ঘদিন নতুন গান প্রকাশ থেকে দূরে ছিলেন এই গায়ক। চলতি বছর এক সাক্ষাৎকারে জানান, তিনি আবারও গান করছেন।
জানিয়েছিলেন, পুরোনো গানগুলো ইউটিউবে দিচ্ছেন পর্যায়ক্রমে। জনপ্রিয় গান ‘কী ছিলে আমার’ নতুন করে প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তার ভাষ্য ছিল, এ প্রজন্মের শ্রোতারা গানটি শুনেছেন।
পুলিশ কর্মকর্তা বাবার সাত সন্তানের মধ্যে মনি কিশোর চতুর্থ সন্তান । চার ভাই ও তিন বোনের মধ্যে সবচেয়ে বড় ভাই মারা গেছেন। দেড় যুগ আগে মনি কিশোরের সঙ্গে তার স্ত্রীর বিচ্ছেদ হওয়ার পর থেকে একা থাকতেন। তার একমাত্র মেয়ে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী। নড়াইল জেলার লক্ষীপুরে মামাবাড়িতে ১৯৬১ সালের ৯ জানুয়ারি জন্ম মনি কিশোরের।