চাকরিপ্রার্থীদের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের মুখে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা দুই বছর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। একই সঙ্গে সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসির) অধীনে বিসিএস পরীক্ষায় একজন প্রার্থী ৩ বারের বেশি অংশ নিতে পারবেন না। বয়সসীমা বাড়ানোর সিদ্ধান্তটি ইতিবাচক হিসেবে দেখলেও সর্বোচ্চ তিনবার বিসিএস দেওয়ার বিষয়টি মানতে নারাজ চাকরিপ্রার্থীরা। এ নিয়ে প্রয়োজনে তারা আন্দোলনে নামবেন বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
শিক্ষাবিদ ও জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বেঁধে দিলে সেই পর্যন্ত সবার আবেদন করার সুযোগ রাখা উচিত। আর আবেদন করার সুযোগ সীমিত করলে বয়সসীমা বেঁধে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। অর্থাৎ, বয়স বেঁধে দেওয়ার পর কতবার আবেদন করতে পারবে, সেটা নির্ধারণ করে দেওয়াটা সম্পূর্ণ ‘অযৌক্তিক’।
তিনবারের বেশি বিসিএস নয়—মানতে নারাজ প্রার্থীরা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র রাকিবুল হাসান। ২০২১ সালের নভেম্বরে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হওয়া ৪৪তম বিসিএসে প্রথমবার অংশ নেন তিনি। তাতে প্রিলিমিনারিতে বাদ পড়েন। ৪৫তম বিসিএসে প্রিলিমিনারিতে উত্তীর্ণ হয়ে লিখিত পরীক্ষা দিয়েছেন। তবে ৪৬তম বিসিএসে আবারও প্রিলিমিনারিতে ফেল করেছেন।
রাকিবুল হাসান বলেন, ‘সরকার যে তিনবার পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার নিয়ম করতে যাচ্ছে, তাতে তো আমি আর বিসিএসে অংশ নিতে পারবো না। যদি ৪৫তম বিসিএসে আমি লিখিত পরীক্ষায় না টিকতে পারি, তাহলে আমার স্বপ্ন শেষ। অথচ আমার বয়স এখন ২৮ বছর ৯ মাস চলছে। তার মানে আমার আরও তিন বছরের বেশি বয়স রয়েছে। বয়স থাকবে অথচ বিসিএসে অংশ নিতে পারবো না। এ নিয়ম মানি না। এটা বৈষম্যমূলক।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০২২ সালে স্নাতকোত্তর পাস করেন জ্যোতি নাজিফা। তিনিও দুবার বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন। নতুন নিয়মকে ‘হাস্যকর’ উল্লেখ করে জ্যোতি নাজিফা বলেন, ‘বিসিএসে একটার রেজাল্ট দিতে তিন বছর লাগে। এর মধ্যে আবার তিনটার প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হয়ে যায়। সেখানে তিনবারের বেশি অংশ নেওয়া যাবে না, এটা কোনো যুক্তিযুক্ত কারণ হতে পারে না।’
তিনি বলেন, ‘সরকার ৩২ বছর বয়সসীমা করে দিয়েছে, ভালো কথা। এ বয়স পর্যন্ত আমি কোথায় কতবার পরীক্ষা দেবো, নাকি দেবো না—সেটা সম্পূর্ণ আমার মৌলিক অধিকার। সেখানে আমাকে সীমাবদ্ধ করে দেওয়া যাবে না।’
সরকারি তিতুমীর কলেজ থেকে স্নাতক পাস করে স্নাতকোত্তরে অধ্যয়নরত আয়েশা সিদ্দিকা আশা। তিনি বলেন, ‘আমাদের দীর্ঘ সেশনজট। যারা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের সেশনের, তাদের দেড় বছর আগে মাস্টার্স শেষ। আমরা মাত্র মাস্টার্স শুরু করছি। স্নাতক শেষ করতেও তাদের চেয়ে বেশি সময় লেগেছে আমাদের। আমি মনে করি, সরকার যদি এ সীমা ঠিক করে দিতে চায়, তাহলে সেটা অন্তত পাঁচবার করা উচিত। এর নিচে হলে চাকরিপ্রার্থীরা কেউ এটা মানবে না।’
আন্দোলনের হুঁশিয়ারি ৩৫-প্রত্যাশীদের
চাকরিতে ৩৫-প্রত্যাশী পরিষদের গণমাধ্যমবিষয়ক সম্পাদক খাদিজা আক্তার মুক্তা। তিনি বলেন, ‘সর্বোচ্চ তিনবার বিসিএস দেওয়া যাবে, এটা চাকরিপ্রার্থীদের সঙ্গে প্রহসন। ৩০ বছর বয়সসীমাতেই যেখানে একজন প্রার্থী পাঁচ থেকে ছয়বার বিসিএস দিতে পারে, সেখানে বয়সসীমা মাত্র দুই বছর বাড়িয়ে তিনবার নির্ধারণ করে দেওয়াটা হাস্যকর ছাড়া কিছুই নয়।’
দাবি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন না করা হলে আন্দোলনে নামার হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা চাকরির বয়সসীমা ৩৫ বছরই চাই। একই সঙ্গে বিসিএসে ৮ থেকে ১০ বার সুযোগ চাই। এর বাইরে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রহসন হলে কঠোর আন্দোলনের মাধ্যমে রাজপথে জবাব দেওয়া হবে।’
বয়সসীমা বেঁধে সর্বোচ্চ তিনবার আবেদন অযৌক্তিক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. সাদিক হাসান। জনপ্রশাসন, ই-গভর্ন্যান্সসহ বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করেছেন তিনি। তার মতে, বিসিএসে সর্বোচ্চ তিনবার পরীক্ষা দেওয়া যাবে, এটা কোনো দিক থেকেই যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নয়।
অধ্যাপক সাদিক হাসান বলেন, ‘বয়সসীমা বাড়ানোর সিদ্ধান্তটি নিশ্চয়ই ভালো। কিন্তু আপনি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ঠিক করে দিচ্ছেন, আবার কতবার আবেদন করা যাবে; সেটাও ঠিক করে দিচ্ছেন। এখানে তো একটার সঙ্গে আরেকটা নিয়মের স্পষ্ট বিরোধ দেখা যাচ্ছে। যদি আবেদনের সুযোগ সর্বোচ্চ তিনবার দেওয়া হয়, সেখানে তো বয়সসীমার প্রয়োজন নেই।’
নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, ‘দেখুন, একজন শিক্ষার্থী স্নাতক শেষ করে প্রথম বিসিএসে তড়িঘড়ি যখন অংশ নেন, তখন সেটাতে সাকসেস রেট খুব কম। বাংলাদেশের বাস্তবতায় একাধিকবার বিসিএসে অংশ নিয়েই সফলতার হার বেশি। অনেকে তো শেষ বিসিএসে গিয়ে চাকরি পান।
‘আমার ছাত্র-ছাত্রীদের অনেকে ২৪ বছর বয়সে স্নাতক শেষ করেছে। প্রথম বিসিএসে অনেক সময় ওরা বুঝে উঠতে পারে না। লক্ষ্য ঠিক করে ওরা যখন বিসিএসকেন্দ্রিক পড়াশোনা করে, তখন সেখানে তার মেধা, সময় ও অর্থ ইনভেস্ট (বিনিয়োগ) করে। সফল হতেও সে মরিয়া থাকে। সেখানে সর্বোচ্চ তিনবার অংশগ্রহণের নিয়ম করে দিলে প্রার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এটা যৌক্তিক নয়’- যোগ করেন অধ্যাপক সাদিক।
পরীক্ষায় অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে নয়, বরং কতবারের বেশি সুপারিশ পেতে পারবে না; সেটা বেঁধে দেওয়া উচিত বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।
তিনি বলেন, ‘এ নিয়ে দীর্ঘদিন অনেক আলাপ-আলোচনা হয়েছে। বয়সসীমা কত বছর করা হলো, তা নিয়ে আমার আগ্রহ নেই, কোনো কথাও নেই। যতদিন বয়সসীমা, ততদিন পরীক্ষা দিতে দেওয়াটা উচিত বলে মনে করি। এখানে একটা জিনিস করা যেতে পারে যে, দুই বা তিনবারের বেশি কাউকে নিয়োগের সুপারিশ করা হবে না। কারণ, অনেকে এক ক্যাডারে নিয়োগ পেয়ে সেটা ছেড়ে অন্যটাতে চলে যান। এতে যারা বেকার, তারা বেকারই থাকেন। শুধু শুধু অনেক পদে নতুন নিয়োগের মূলা দেখানো হয়।’
কখন থেকে চালু হবে এ নিয়ম?
উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে বয়সসীমা ৩২ বছর করা এবং তিনবারের বেশি বিসিএসে অংশ নেওয়া যাবে না বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। বয়সসীমা বাড়ানোর বিষয়ে দ্রুত আদেশ জারি হতে পারে। তবে তিনবারের বেশি যে বিসিএসে অংশ নেওয়া যাবে না, এটা বাস্তবায়নে প্রথমে ‘বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস বিধিমালা, ২০১৪’ সংশোধন করতে হবে। ‘সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮’ এর ধারা ৫৯-এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এ বিধিতে সংশোধন বা সংযোজন আনবে।
কিন্তু চাকরিপ্রার্থীদের প্রশ্ন- যারা এরই মধ্যে তিনবার বিসিএসে অংশ নিয়েছেন, তাদের ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য হবে কি না। পিএসসির পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (ক্যাডার শাখা) আনন্দ কুমার বিশ্বাস জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে কোনো নির্দেশনা বা সিদ্ধান্ত আমাদের এখানে আসেনি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় যেভাবে বলবে, আমরা সেভাবে করবো।’
জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. আব্দুর রউফ বলেন, ‘এটা তো আজকের উপদেষ্টা পরিষদের সিদ্ধান্ত। বয়সসীমার বিষয়টি তো ক্লিয়ার (স্পষ্ট)। বাকি যে বিষয়টি (বিসিএসে সর্বোচ্চ তিনবার অংশগ্রহণ) জানতে চাইছেন, সেটা নিয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত হবে।
‘তবে আমার ধারণা—নতুন একটি নিয়ম করা হলে শুরুটাও সেখান থেকে নতুন করে হয়। অর্থাৎ, সামনের বার যারা বিসিএসে প্রথমবার অংশ নেবেন, সেখান থেকে নিয়মটা শুরু হওয়ার কথা। তবুও আলোচনার আগে এ নিয়ে চূড়ান্ত কিছু বলা সম্ভব নয়’- বলেন তিনি।