মুক্তির আন্দোলন একাত্তরে শুরু হয়নি, শেষও হয়নি

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। ফাইল ছবি

রাষ্ট্র আছে বলে রাজনীতি থাকবেই এবং আছেও। অবৈধ পথে যারা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে ফেলেন, তারা প্রথমেই যা বলেন তা হলো, তাদের কোনো রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ নেই; গণতন্ত্রের বারতা নিয়ে এসেছেন এবং তারা অতিদ্রুত নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা তুলে দিয়ে অব্যাহতি নেবেন। কিন্তু অবৈধ পন্থায় রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার কাজটা তো নির্জলাভাবেই রাজনৈতিক এবং একেবারে প্রথম দিন থেকেই তারা নতুন রাজনীতি শুরু করেন; দল গড়েন, তাদের পক্ষে কাজ করতে প্রস্তুত এমন লোক খোঁজেন, তাদেরকে উপদেষ্টা বানান, লোক দেখানো সংস্কারের নামে সাধারণ মানুষের কষ্ট বৃদ্ধি করেন এবং সাজানো নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নিজেদের নির্বাচিত করার ঘটনা আমাদের ইতিহাসে ঘটেছেও; আবারও ঘটলে বিস্মিত হবো না।

এ ধরনের রাজনীতি দিয়ে দেশের কি কোনো উপকার হবে? এর জবাব ওই প্রশ্নটির ভেতরেই রয়ে গেছে। যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় যাতায়াত করে তারা নিজেদের স্বার্থ দেখে; দেশের স্বার্থ দেখে না। দেশের সম্পদ যেটুকু আছে সেটা তারা অতিদ্রুত নিজেদের করতলগত করে নিতে চায়। পাশাপাশি তুলে দিতে চায় তাদের হাতে, যাদের বদৌলতে অলৌকিকভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্তি ঘটেছে। জনগণের মুক্তির কথা যখন আমরা বলি তখন ওই সম্পদের ওপর জনগণের মালিকানার প্রশ্নটাই প্রথমে আসে; আসতে বাধ্য। আমাদের দেশ যে দরিদ্র, তার কারণ সম্পদের অভাব নয়। কারণ হচ্ছে সম্পদের ওপর জনগণের মালিকানা না-থাকা এবং সম্পদ বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়া। দেশের খরচে আমরা মানুষকে শিক্ষিত করি। সেই শিক্ষিত মানুষদের স্বপ্ন থাকে বিদেশে যাওয়ার; নয়তো দেশে থেকেই বিদেশি কোম্পানিতে চাকরি করার। এ ক্ষেত্রে যেটা ঘটে তা হলো, দেশের খরচে যে দক্ষতা তৈরি হয়, তা দেশের কাজে লাগে না; ব্যয় হয় বিদেশিদের সম্পদ উৎপাদনে। তার চেয়েও যেটা নিষ্ঠুর তা হলো, দেশের সম্পদ বিদেশে চলে যাওয়া। ভূখণ্ডের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার নানা মতলব তো রয়েছেই।

যাকে আমরা পরাধীনতা বলে জানি, তার ভেতরকার মূল ব্যাপারটাই ছিল আমাদের সম্পদের ওপর বিদেশিদের কর্তৃত্ব। বিদেশি শাসকরা এ দেশে কর্মচারী, চাকরবাকর, দালাল ইত্যাদি তৈরি করেছে। উদ্দেশ্য ছিল এদের সাহায্যে এখানে যে সম্পদ রয়েছে তা দখল করা। কাজটা পাঠান ও মোগলরা করেছে। পরে ইংরেজরা করেছে আরও জোরেশোরে। পাঠান ও মোগলদের পাচার করা সম্পদ তবু উপমহাদেশের ভেতরেই রয়ে গেছে; ইংরেজরা তা নিয়ে গেছে নিজেদের দেশে। খনিজ সম্পদ উত্তোলন, কলকারখানা স্থাপন, যান্ত্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা, এমনকি এক সময়ে নীল, পরে পাট ও চা-এর উৎপাদন– সবকিছুর মালিকানা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের হাতেই ছিল। এবং জাহাজ ভর্তি করে তারা সোনাদানা থেকে শুরু করে কত যে অর্থ ও বিত্ত পাচার করেছে, তার হিসাব বের করা কঠিন। ফলে তারা যে পরিমাণে ধনী হয়েছে, আমরা ঠিক সেই পরিমাণেই নিঃস্ব হয়েছি। তাদের দেশে শিল্পবিপ্লব ঘটেছে এবং আমরা পরিণত হয়েছি তাদের আটকে পড়া ক্রেতায়।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মূল কারণ ছিল সম্পদের ওই মালিকানাই। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রে যা ঘটেছে, তথাকথিত স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রেও তাই ঘটেছিল। পূর্ববঙ্গের সম্পদের ওপর কর্তৃত্ব পূর্ববঙ্গবাসীর ছিল না। কর্তৃত্ব ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিদের। আমরা বলেছিলাম, এ দেশে যা কিছু আছে তা আমাদেরই থাকবে। ওই দাবির ব্যাপারে বাঙালিদের দৃঢ়তা দেখেই পাঞ্জাবি সেনাবাহিনী ক্ষেপে গেল এবং গণহত্যা শুরু করে দিল।

একাত্তরে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে আমরা জয়ী হয়েছি। কিন্তু দেশের সম্পদের ওপর দেশবাসীর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কি? না, হয়নি। আর সে জন্যই তো বলতে হয়, আমরা এখনও মুক্তি পাইনি। সামাজিক সম্পত্তি ক্রমাগত ব্যক্তিমালিকানায় চলে গেছে। কলকারখানা ব্যক্তিগত হয়ে গেছে এবং যাচ্ছে। সবচেয়ে ভয়াবহ যে বিপদ তা হলো, দেশের সম্পদ বিদেশিদের হাতে চলে যাওয়া। এই ব্যাপারে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন শাসক শ্রেণি রুখে দাঁড়াবে কি; উপরন্তু বিদেশিদের লুণ্ঠনে সাহায্য করছে তাদের আশীর্বাদপুষ্ট তাঁবেদার হয়ে। এটাই হচ্ছে এখন আমাদের রাজনীতির প্রধান বৈশিষ্ট্য। আর এটা তারা করছে নিজেদের স্বার্থে। বিদেশিদের সাহায্যে ও মদদে দেশের ক্ষমতাপ্রাপ্তিতে কৃতজ্ঞতার প্রতিদানস্বরূপ সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থ রক্ষায় তৎপর হচ্ছে।

তাদের এই নীতিকে নীতিবিগর্হিত বলার আবশ্যকতা দেখি না। একে দেশদ্রোহ বলাই যথেষ্ট। স্পষ্টতই এরা মনে করে যে, বাংলাদেশের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। তাই অতিদ্রুততায় যতটুকু হস্তগত করা যায় সেটুকুই লাভ। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো যত না তৎপর, এদের তৎপরতা তার চেয়ে বেশি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে অত বড় নেতা হয়েছিলেন, তার কারণ এ দেশের সম্পদ জবরদখলকারীদের কাছে তিনি আত্মসমর্পণ করেননি। তাদের হুঙ্কার তাঁকে বিচলিত করেনি; এবং তিনি সপরিবারে প্রাণ দিয়েছেন সেই সব বেইমানের হাতে, যারা ব্যস্ত ছিল পুঁজিবাদের বিকাশের জন্য রাস্তা পরিষ্কার করে দিয়ে দেশের মানুষের ওপর বহুজাতিক পুঁজির শোষণকে স্থায়ী করবার কাজে। হুঙ্কার প্রদানকারীরা যেমন, বেইমানরাও তেমনি ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে; বঙ্গবন্ধু মুজিব আছেন ইতিহাসের নায়ক হয়ে এবং থাকবেনও। আজকে যারা দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করার ব্যাপারে শশব্যস্ত হয়ে পড়েছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাদের সতর্ক করে দিয়েছেন; সেই সতর্কবাণীতে কান না-দিলে দেশের মানুষের যে ভয়ংকর রকমের ক্ষতি হবে– তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু দেশবাসী যে তাদেরকেও ক্ষমা করে দেবে– তেমনটা ভাববার কোনো কারণ নেই।

ইতিহাস তো এসব কাজ আগেও ক্ষমা করেনি, ভবিষ্যতেও করবে না। তবে সেই ভবিষ্যৎ আমরা পাব কি যদি এখনই প্রতিরোধ গড়ে না তুলি? প্রতিরোধ না গড়লে একাত্তরেই আমরা শেষ হয়ে যেতাম। একাত্তর কিন্তু মিথ্যা নয়, সে বলছে– মুক্তির সংগ্রাম চলবেই। এবং নিরাপত্তা অর্থে বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির বংশানুক্রমিক নিরাপত্তা নয়, চাই সমগ্র দেশবাসীর জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা।

বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ৫৩ বছর আগে; কেবল স্বাধীনতার জন্য নয়, আমরা লড়েছিলাম মুক্তির জন্যও। মুক্তির জন্য আমাদের যে আন্দোলন তা একাত্তরে শুরু হয়নি, শেষও হয়নি; কিন্তু আমরা তাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারিনি বলেই আজ দেশের এই দুর্গতি। ‘আমরা’ বলে কাদেরকে বোঝাচ্ছি, সেটাও পরিষ্কার হওয়া দরকার। বোঝাচ্ছি তাদেরকে যারা দেশপ্রেমিক ও গণতান্ত্রিক, যারা মনে করে যে বর্তমান ব্যবস্থা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয়। মুক্তি যে সহজে অর্জিত হবে, তা মোটেই নয়। শাসক শ্রেণি বাধা দেবে। এই শ্রেণিকে হটিয়ে দিয়ে একটি গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করার কাজটি কঠিন বৈকি। কিন্তু এ কাজের কোনো বিকল্প নেই।

এই নিরাপত্তার লক্ষ্যে সংগ্রাম করবার জন্য দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিকদের মাঠে দেখা যাচ্ছে না; কিন্তু মানুষকে তো বাঁচতে হবে; তাই জনগণের সম্পদ রক্ষা করবে এমন রাজনৈতিক শক্তিকে বিকশিত করতে সচেষ্ট হওয়া দেশপ্রেমিক মানুষ মাত্রেরই অবশ্যপালনীয় কর্তব্য ও দায়িত্ব। এটা ভুললে যে ক্ষতিটা হবে, তা অপূরণীয়।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

শেয়ার করুন