আমি দীপিকা চক্রবর্ত্তী, পিএ ৪০৯৪০। কথা ছিলো আর মাত্র ১০ দিন পর স্বপ্নের নীল পোশাক গায়ে জড়িয়ে শোল্ডারে র্যাংক ব্যাজ, লেনিয়ার আর বুকে পুলিশের নেমপ্লেট লাগিয়ে সাধারণ মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করবো। যে স্বপ্ন আমি লালায়িত করেছি দীর্ঘ বছর, যে স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য কণ্টকাকীর্ণ পথে হেঁটেছি বিগত ২৬ বছর এবং লাস্ট ১ বছর ব্যয় করেছি নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করার জন্য আর সব কিছুকে অতিক্রম করে সারদার মাঠে নিজেকে শীতের সময় ঠাণ্ডায় বরফের ন্যায় জমিয়েছি, বৃষ্টিতে ভিজিয়েছি, গ্রীষ্মের ৪২/৪৫° তাপমাত্রার রোদে নিজেকে আরো ১ বছর পুড়িয়েছি। গায়ে ১০৩° জ্বর নিয়ে মাঠের প্রতিবেলার দৌড় শেষ করেছি তবুও মেডিকেল ভর্তি হই নি, মাঠ ছাড়ি নি। নরম হাতের তালুতে কড়া শক্ত চামড়ায় পরিণত হয়েছে ট্রেনিংয়ের কঠোরতায়। আর রাইফেল কাঁধে নিতে নিতে রাইফেল শরীরের একটা অংশ বলেই যেখানে মনে হতো, এক দিনের জন্য যেখানে মাঠ ছেড়ে কোনো প্রকার ছুটি কাটাই নি বরং যখন যে-ই কাজে ডাকা হয়েছে আপ্রাণ চেষ্টা করে সফলতা দেখিয়েছি প্রতি কাজেই। মাঠ, মঞ্চ কোনো কিছুতেই কখনো পিছনে যাই নি। কখনো পড়ে গেলেও সাথে সাথে সব ব্যথা ভুলে উঠে দাঁড়িয়েছি। কোনো কষ্ট কোনো ব্যথা আমার স্বপ্ন পূরণের বাঁধা হতে পারে নি।…
আর ঠিক যখন চূড়ান্তভাবে প্রস্তুত করে যখন দেশের সেবায় নিয়োজিত হবো ঠিক তখন এত দিনের স্বপ্নকে দুঃস্বপ্ন বানিয়ে হাতে ধরিয়ে দেওয়া হলো অব্যাহতি পত্র ? অভিযোগ দেওয়া হলো “শৃঙ্খলা ভঙ্গের”!
ব্যাস! ২৬ বছরের স্বপ্নকে ২৬ সেকেণ্ডে ধূলিসাৎ করে দেওয়া হলো। সংবাদটা যখন পাই তখন আমি পি.এল. ছুটিতে সেই মুহূর্তে মনে হচ্ছিলো সংবাদটা সত্যি তো!! আমার সেন্স সঠিক কাজ করছে তো ?? আমার হৃদক্রিয়া ঠিকঠাক কাজ করছে তো ??এটা কি দুঃস্বপ্ন !! কিন্তু না এটাই ছিলো সত্য এবং নিষ্ঠুর সত্য!!
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত অব্যাহতি পাওয়া ২৫২ জন সাব-ইন্সপেক্টের লিস্টের আমিও একজন। কথা হলো প্রাইমারি, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রেজুয়েশন, পোস্ট-গ্রেজুয়েশন কমপ্লিট করেছি। এই দীর্ঘ শিক্ষাজীবনের টার্ন করার ক্ষেত্রে আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষকগণ ও আমার সহপাঠীরা এবং আমার এলাকার মানুষ বলতে পারবে আমার আচরণগত দিক দিয়ে আমি কেমন? গত বছর ৪০তম এস আই এ নিয়োগপ্রাপ্ত হই। এস আই এ যোগদান করতে সারদার উদ্দেশে পাড়ি জমাই।
কিন্তু এখন ২৫২ জনের লিস্টে আমিও বাদ পড়ি। সাথে আমার সাজানো স্বপ্ন নিমিষেই ধূলিসাৎ হয়ে গেলো। স্তম্বিত হয়ে গেলাম আমি নিজেও। পরিবারের প্রতিটা মানুষ নিস্তব্ধ ! বাবা, মায়ের চোখের জল, বোন এবং আমাদের শুভাকাঙ্ক্ষীদের কান্না, আমার জীবনের এই করুণ পরিণতি এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দায় আমি কাকে দিবো?এটা কি আমার ভাগ্য? নাকি অন্যায়ভাবে আমার জীবনের স্বপ্নগুলা মুছে দেওয়া হচ্ছে ?? ব্যাপারটা আমি না নিজে মানতে পারছি, না পরিবারের মানুষ !
আমাদের ২৫২টা পরিবারের অসহায়ত্বের বেদনা কি কেউ বুঝবে ?? এ কেমন বৈষম্যের স্বীকার হলাম?? আমরা কি এর সুবিচার পাবো??? রাষ্ট্র আমাদের সাথে এমন আচরণ কেন করছে ্?? দেশের বর্তমান নীতি নির্ধারক যারা আছেন তারা এমন একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে একবার ও কি ভেবেছে এত দিন পরে এসে অব্যাহতি দিলে এতগুলি পরিবারের কী বেহাল দশা হতে পারে? যদিও আনিত অভিযোগটি সত্য নয়, কতৃপক্ষ চাইলে সুষ্ট তদন্ত করতে পারতো। এখানে অনেকেই আছে যাদের আর্থিক অবস্থা খুব ই শোচনীয় এবং অনেকে জব ছেড়ে গিয়েছিল স্বপ্ন পূরণের জন্য,অনেকের চাকুরীর বয়স শেষ। আসলে আমি কারে দোষ দিবো ? সব দোষ হয়তো আমার ভাগ্যের !
ট্রেনিং চলাকালীন সময়ে কতটা কষ্ট করে সব কিছু সামাল দিয়েছি একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ছাড়া আর কেউ জানে না। যারা সারদায় ট্রেনিং করেছে তারাই ফিল করতে পারবে সেখানে কতটা শারীরিক, মানসিক পরিশ্রম করতে হয়। ভোর ৪টা হতে শুরু করে রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত কী কষ্ট সহ্য না করতে হয়েছে। বিনা বেতনে ১ বছর ট্রেনিং করেছি। সরকারী খরচে খাওয়া দাওয়া, মাস শেষে ১৮১৫ টাকা পকেট মানি দিতো যেখানে রুমের খালাকে বেতন দিতে হতো ২৫০০ টাকা, সাথে নিজস্ব হাত খরচসহ আনুষঙ্গিক খরচ তো আছেই।
আমার মা-বাবার আমাকে নিয়ে কত ইচ্ছে কত স্বপ্ন সব এক মুহূর্তে ধূলিসাৎ হয়ে গেল। মেয়েরা তার বাবা মায়ের খেয়াল রাখতে পারে না এই কথাটাই বদলাতে চেয়েছিলাম আমি। ভাই নেই বলে খোঁচা মারা কথাগুলোকে মিথ্যা করে বাবা মায়ের পাশে দাঁড়াতে চেয়েছিলাম। মায়ের অপূর্ণ থাকা সব ছোট বড় ইচ্ছা পূরণ করবো বলেছিলাম মা’কে। কিন্তু তার আগেই আমার তিলে তিলে লালন করা স্বপ্নের মৃত্যু দেখে ফেললাম আমি!
আমার এত দিনের সাজানো স্বপ্ন এইভাবে যারা নিঃশেষ করে দিয়েছেন তাদের বিচার আমি সৃষ্টিকর্তার উপর ছেড়ে দিলাম। উপরে তিনি সব দেখছেন সব জানেন।
আমার স্বপ্ন ভঙ্গের দায় কার ?? এই প্রশ্ন আপনাদের কাছে রেখে গেলাম! এই চাকুরীকে ঘিরেই আমি আমার পরিবারকে নিয়ে স্বপ্ন সাজিয়েছিলাম কিন্তু আপনারা সেটা এক নিমিষেই গুড়ে বালি করে দিয়েছেন।
অনেকে বলছেন আইনী প্রক্রিয়ায় গেলে চাকুরী ফেরত পাবো এক সময়। আরে ভাই, যে চাকুরীটা আমার এখন দরকার সেটা পরে পেয়েই আমার কী হবে?? যখন আমার মা, বাবা ও প্রিয় মানুষের খুশীতে কান্না দেখা যাবে না? আর বাংলাদেশের এই আইনী জটিলতা ওভারকাম করার আর্থিক ও মানসিক সক্ষমতা এই মুহূর্তে আমার কোনোটাই নেই।
আমার নিজের জীবনকে এইভাবে অন্ধকার দিকে ঠেলে না দিয়ে এর থেকে ভালো হতো যদি “সেভেন পয়েন্ট সিক্স টু এমএম” রাইফেল কিংবা এলএমজি বুলেট দিয়ে ব্রাস্ট ফায়ার করে বুকটা ঝাঁঝরা করে দিতেন। তাইলে হয়তো এত কষ্ট হতো না। পরিবারের মানুষের অসহায় মুখগুলি দেখতে হতো না।
সব শেষে ঈশ্বরের কাছে একটাই বলাঃ এত তোমাকে ডাকি প্রতিদিন, এত প্রার্থনা আমার, আমার সাথেই কেন এমন করো ঈশ্বর? এত পরীক্ষা আমাদেরকে নিও না, হে দয়াময়।
প্রকৃতি নাকি কখনো কারো ঋণ রাখে না। আমার এই ঋণ প্রকৃতি মিটাবে কি করে? আমার সাথে যে অবিচার করা হয়েছে তুমি তার বিচার করো, হে মহান স্রষ্টা।
তবে, হে রাষ্ট্র ! তুমি আমাকে আমার অধিকার থেকে শুধু বঞ্চিতই করো নি,তুমি আমাকে শারীরিকভাবে বাঁচিয়ে রেখেছ কিন্তু মানসিকভাবে হত্যা করে ফেলছ। একদিন যেন এর সুবিচার হয়।