যদি বলা যায়, মৌলবাদিতা ও মস্তানি একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ; তাহলে উভয়েই তেড়ে আসবেন মারতে। তখনই একটা প্রমাণ হাতেনাতে পাওয়া যাবে– ধারণাটা মিথ্যে নয় মোটেই। দুটোই রোগ বটে; রোগীর পক্ষে বিপজ্জনক, জাতির পক্ষে চরম ক্ষতিকর। এরা উভয়েই মৌলবাদ যেমন মস্তানি করে তেমনি– উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কহীন, জীবনের স্বাভাবিক ধারাপ্রবাহ থেকে বিচ্যুত। উৎপাদনবিরোধী তারা, ধারাপ্রবাহের অন্তরায়। আপাতদূরত্বের আড়ালে কাছাকাছি তারা, একই রকম অসহিষ্ণু ও উচ্ছৃঙ্খল; জন্ম তাদের সমাজের একই আবিলতায়।
আমেরিকায় মৌলবাদের তৎপরতা শুরু হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে। হতাশায়। উদারনীতি ও আধুনিকতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল কিছু মানুষ, যারা বলতে চেয়েছিল, মোক্ষ রয়েছে বাইবেলে প্রত্যাগমনে। বিবর্তনবাদ পড়ানো যাবে না বিদ্যালয়ে– এ দাবিও তুলেছিল তারা। কিন্তু এই মৌলবাদের সঙ্গে মৌলিক পার্থক্য আছে আমাদের দেশের মৌলবাদের। অত নিরীহ নয় সে, আদালতে যায় না; ভোজালি হাতে খুন করতে বের হয়। মৌলবাদ যে কত ভয়ংকর হতে পারে, দেখেছি আমরা একাত্তরে। তখন সে ঘাতক হয়েছিল, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ছত্রছায়ায়।
মৌলবাদীদের তৎপরতা চরমভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে মস্তানদের দৌরাত্ম্য; প্রায় একই মাত্রায়, বলতে গেলে। তারা সর্বক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করছে। এ নিয়ে চিন্তিত অনেকেই; উদ্বিগ্ন ভীষণভাবে। কিন্তু মৌলবাদ, মস্তানি থামছে না; শক্তিশালীই হচ্ছে ক্রমাগত। এ শক্তির উৎস কোথায়– সেটা পরিষ্কার।
মৌলবাদীরা বিপ্লব চায়। জানে, এ যুগ বিপ্লবের যুগ। এখন বিপ্লবের বিরোধিতা করলে মানুষের কাছে যাওয়া যাবে না। এমনকি ভাত-কাপড়ের কথাও বলে আজকাল; গণতন্ত্রের দাবি তো তোলেই। সমস্ত কিছুর পেছনে একটি অভিপ্রায় থাকে, যেটি হচ্ছে বিপ্লবকে ঠেকিয়ে রাখা। বিপ্লবের কথা বলেই বিপ্লবকে প্রতিহত করবে। যেমন রাজনীতি করার মধ্য দিয়েই মানুষকে পরিণত করছে অরাজনৈতিক প্রাণীতে। অরাজনৈতিক হলে মানুষ আর মানুষ থাকে না; দেবতা হয় কিংবা পশু। দেবতা হলে অসুবিধা ছিল না, আকাশে থাকত। কিন্তু পশু হয় বলেই বিপদ ঘটায়। পশু সমাজ মানে না, সমাজের পরিবর্তন চায় না। পশু মানুষ হলে তার লাভ-লোকসানের হিসাব করা কঠিন। কিন্তু মানুষ পশু হলে সমাজ যে অচল হয়, তাতে সন্দেহের বেশি অবকাশ দেখি না।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশে মৌলবাদ প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে একদিকে; অন্যদিকে গণতন্ত্র আসছে না। এ দুটি বিচ্ছিন্ন নয় পরস্পর থেকে। গণতন্ত্র পাকিস্তানেও ছিল না, এখনও নেই; মৌলবাদ পাকিস্তানি আমলেও বাড়ছিল, এখন বাড়ছে প্রবলভাবে। গণতন্ত্র তো কেবল ভোট নয়, যদিও সে ভোটও বটে; গণতন্ত্র হচ্ছে মানুষের মৌলিক অধিকার এবং সেই সঙ্গে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ। আজ অধিকারও নেই, মূল্যবোধও নেই। যার ফলে পরমতসহিষ্ণুতার অভাব, অভাব সহনশীলতার। যা থেকে বোঝা যায়, সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদ উভয়ে গণতন্ত্রের শত্রু এবং মৌলবাদের মিত্র।
দেশে গণতন্ত্র নেই বলেই মৌলবাদের বাড়বাড়ন্ত। সামন্ত ও সাম্রাজ্যবাদে ভক্তি, আনুগত্য, অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার ইত্যাদির প্রশ্রয় থাকে; তার প্রবণতা স্বৈরাচারমুখী, মৌলবাদও এসবকে আশ্রয় করেই তাজা থাকে এবং এদের পোক্ত করে প্রাণপণে। অর্থনীতিতে পুঁজিবাদ গেড়ে বসেছে প্রবলভাবে বিশ্ব পুঁজিবাদের অনুসারীর বদৌলতে। না মেনে উপায় নেই যে, এখন উৎপাদন হয় মুনাফার স্বার্থে; বিক্রি হয় বাজারে; দ্বন্দ্ব এখন শ্রমের সঙ্গে পুঁজির। কিন্তু এই পুঁজিবাদ সামন্তবাদের বুক চিরে বেরিয়ে আসেনি। যার জন্য এর নানা অঙ্গে সামন্তবাদী মূল্যবোধগুলো বিরাজমান।
আমাদের বুর্জোয়ারাও জাতীয় চরিত্রের নন; মুৎসুদ্দি চরিত্রের বটে। এক সময়ে পরাধীনতা অত্যন্ত স্থূলভাবে সত্য ছিল আমাদের জন্য; এখন সত্য পরনির্ভরতা, ঋণ, সাহায্য, দান, অনুদান, আমদানি, রপ্তানি– সবদিকের পরনির্ভরতা। ফল দাঁড়াচ্ছে এই যে, কেবল দরিদ্ররাই ভূমিহীন নয়; বুর্জোয়ারাও ভূমিহীন। তাদের আস্থা নেই নিজের ওপর। তারাও দাঁড়িয়ে নেই আত্মশক্তির ভূমিতে। ভূমিহীনের পক্ষে অদৃষ্টবাদী না হয়ে উপায় কী! এই আত্মআস্থাহীন অদৃষ্টবাদিতা, এই করুণাপ্রার্থী পরনির্ভরতা– এরা উভয়েই মৌলবাদের পৃষ্ঠপোষক।
দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে স্বাধীনতা সমষ্টিগতদের স্বাধীন করেনি। গরিবকে যে স্বাধীন করবে না, সেটা স্বাভাবিক। যারা ধনী হয়েছে, সেটা কীসের জোরে? অদৃষ্টের জোরেই বটে। সেটাই বিশ্বাস করতে হয়। বিশ্বাস করাতে হয় অন্যকেও, নইলে তো মানতে হয়, বড়লোক হবার জন্য সে লোক ঠকিয়েছে, যে স্বীকৃতি মোটেই সম্মানজনক নয় তার পক্ষে।
নৈতিক শিক্ষার সূত্রগুলো আমরা ধর্মের কাছ থেকেই পাব বলে আশা করি। প্রকৃত ধার্মিকতায় আধ্যাত্মিকতা থাকে। সেখানে পরিচ্ছন্নতা পাওয়া যায়; কখনও কখনও তা মরমিবাদী হয়ে ওঠে বটে, তবে প্রায়শ মানুষের প্রতি বিদ্বেষ ন জাগিয়ে ভালোবাসা জাগায়। প্রকৃত ধার্মিকের গুণ এগুলো। তিনি অন্যকে করুণা করতে পারেন, কিন্তু সাধারণত ঘৃণা করেন না। অন্যের ওপর নিজের মত চাপাতে যাবেন– এ আগ্রহ গড়ে উঠলেও তাকে তিনি দমন করেন। কিন্তু বুর্জোয়াদের ধর্মচর্চায় এসব গুণ অন্তর্হিত। তার ভিত কোনো দিক দিয়েই দার্শনিক নয়। সর্বতোভাবে বস্তুবাদী।
আর ধর্ম যখন মৌলবাদীর হাতে পড়ে তখন সে মোটেই ধার্মিক থাকে না; মস্তানিতে পরিণত হয়। মৌলবাদী নিজে ধর্মের অনুশীলন করুক না-করুক, অন্য করছে কিনা এ বিষয়ে ভীষণ রক্তচক্ষু হয়ে থাকে। তার উদ্দেশ্য ধার্মিকতার সৃষ্টি নয়; মানুষের অগ্রগতিকে প্রতিহত করা। কায়েমি স্বার্থের দালাল সে-অসংশোধনীয়রূপে। মৌলবাদীরা বলে, ধর্মের সাহায্যে সমাজে শৃঙ্খলা আনবে। তা যদি সম্ভব হতো তবে পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের দোসররা অমন বিশৃঙ্খল হতো না।
মুক্তিযুদ্ধ ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। সম্ভব হয়নি। সম্ভব যে হবে না, তার আভাস একেবারে শুরুতেই দেখা দিয়েছিল– ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ যখন করা হলো সকল ধর্মের অবাধ, অর্থাৎ আরও বেশি চর্চা। ইহজাগতিকতার চর্চাটা এগোল না সেই তুলনায়। তার একটা বড় কারণ সমষ্টিগত ব্যর্থতা; মানুষের মুক্তির স্বপ্ন ভেঙে খান খান হয়ে গেল ব্যক্তিগত স্বপ্নের ঘায়ে। বাস্তবিক ব্যর্থতার ছবি সমস্ত আশাকে গ্রাস করে ফেলছে। ব্যাপকভাবে দেখা দিচ্ছে হতাশা।
বলার অপেক্ষা রাখে না, অর্থনীতিতে এখন প্রবাহ নেই। কোথাও খরা, কোথাও বন্যা; কিন্তু স্বাভাবিক প্রবাহ নেই। সেই বদ্ধতায়, সেই সঙ্গে বর্ধিষ্ণু বৈষম্যে মৌলবাদের বিকাশ সহজসাধ্য হচ্ছে। অর্থনীতির পরনির্ভরশীলতা নির্ভর হয়ে পড়েছে। আমাদের দেশ কৃষিনির্ভর, অথচ খাদ্যে পরনির্ভরশীলতা ক্রমশ বাড়ছে। হিসাবে দেখা গেছে, গত এক দশকে বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানি এক-দুই নয়, ৩০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আমিষ আর গরিব মানুষ খায় না; অবস্থাপন্নরাই খায়। প্রোটিন সমস্যার দ্বারা দরিদ্র সরাসরি আক্রান্ত হচ্ছে; অবস্থাপন্নরাই আক্রান্ত হচ্ছে না। যার ফলে আবারও প্রমাণিত হয়– এ দেশে গরিবের নিরাপত্তার প্রশ্নই ওঠে না।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়