ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার হিড়িক পড়েছে। গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে একের পর এক হত্যা ও বিস্ফোরক মামলা করা হচ্ছে। শুধু ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর মডেল থানাতেই প্রায় এক ডজন হত্যা, বিস্ফোরক ও নাশকতার মামলা দায়ের করা হয়েছে। এছাড়া আদালত ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অন্যান্য থানাতেও মামলা হচ্ছে। প্রায় প্রতিটি মামলাতে গড়ে দুই শতাধিক মানুষকে আসামি করা হচ্ছে।
এসব মামলায় আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, জাতীয় পার্টির সরকারের সময়ের সংসদ সদস্য, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, মেয়র, উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মেম্বারসহ প্রতিপক্ষের রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীসহ সাধারণ মানুষকে আসামি করা হচ্ছে।
এসব মামলায় জেলার কয়েকজন সাংবাদিককেও আসামি করা হয়েছে। প্রবাসে থেকেও মামলার আসামি হয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর এলাকার ভাদুঘর গ্রামের মো. বাছির দুলাল এবং সদর উপজেলার নাটাই উত্তর ইউনিয়নের ভাটপাড়া গ্রামের মো. রাসেল।
মিথ্যা ও কল্পিত মামলায় গ্রেফতার এবং নিপীড়নের তীব্রতা প্রতিদিন তীব্র থেকে তীব্র হচ্ছে। সরজমিন খোঁজ নিয়ে জানা গেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক গণপূর্তমন্ত্রী যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী গত ৩১ অক্টোবর গ্রেফতারের পর নিপীড়নের তীব্রতা দুর্বিষহ পর্যায়ে চলে গেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিশেষ করে ৫ নভেম্বর মোকতাদির চৌধুরীর মুক্তির দাবিতে চিনাইর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ডিগ্রি কলেজ ও চিনাইর আঞ্জুমান আরা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল বের করার পর মাত্রা ছাড়িয়েছে পুলিশি দমন-পীড়ন।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্কুল ও কলেজের শিক্ষকদের বাধা উপেক্ষা করে গত ৫ নভেম্বর সকাল সাড়ে নয়টার দিকে শিক্ষার্থীরা “মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করো, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করো। মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় গ্রেপ্তার শিক্ষাঙ্গনের আলোকবর্তিকা, চব্বিশের কোটা সংস্কার আন্দোলনের পক্ষে জোরালো কণ্ঠস্বর, সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী, যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী-এর নিঃশর্ত মুক্তি চাই। অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে।”-লেখা সম্বলিত ব্যানারে বিক্ষোভ মিছিল বের করে সুলতানপুর-চিনাইর-আখাউড়া মহাসড়ক অবরোধ করে। রাস্তায় অবস্থানের কিছুক্ষণ পরে শিক্ষকরা তাদেরকে সেখান থেকে ক্লাসে ফিরিয়ে নেন। কিন্তু ঘটনার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মোজাফফর হোসেনের নেতৃত্বে পুলিশের একটি টিম চিনাইর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ডিগ্রি কলেজ এবং চিনাইর আঞ্জুমান আরা উচ্চ বিদ্যালয়ে এসে তাণ্ডব চালায়।
স্থানীয়রা আরও জানায়, সেদিন পুলিশ দুইজন ছাত্রীসহ স্কুল ও কলেজের চার শিক্ষার্থীকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। তাদের মধ্যে একজন শিক্ষার্থী দশম শ্রেণির নির্বাচনী পরীক্ষা দিচ্ছিলেন, পরীক্ষার হল থেকেই তাকে আটক করা হয়। এসময় চিনাইর দক্ষিণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষককে শারীরিকভাবে নিগৃহীত করে পুলিশের একাধিক কনস্টেবল।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে চিনাইর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিগ্রি কলেজের এক শিক্ষার্থী মত ও পথকে বলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর ও বিজয়নগরের শিক্ষার উন্নয়নে মোকতাদির চৌধুরী নানামুখী উন্নয়ন করেছেন। বিশেষ করে আমাদের কলেজসহ সমগ্র ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শিক্ষাঙ্গনের সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখাসহ শিক্ষাখাতে ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। তিনি আমাদেরকে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় গড়ে উঠতে সবসময় অনুপ্রাণিত করতেন। কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি উগ্রপন্থী মহল যারা সংখ্যায় স্বল্প কিন্তু সংঘবদ্ধ তারা মোকতাদির চৌধুরী সাহেবের অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে নিঃশেষ করার লক্ষে তার বিরুদ্ধে একাধিক মিথ্যা ও কল্পিত হত্যা মামলা দায়ের করেছে। আমরা এসব মিথ্যা মামলার প্রতিবাদে একটি অহিংস প্রতিবাদ জানানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি একান্ত নিজেদের বিবেকের তাড়নায় এবং স্কুল-কলেজ প্রশাসন ও স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরোধিতা সত্ত্বেও যথারীতি ৫ নভেম্বর সেই কর্মসূচি সফল করি।
ওই শিক্ষার্থী আরও বলেন, আমরা বিক্ষোভ মিছিল শেষ করে কলেজে আসার পর কলেজের অধ্যক্ষ ইকবাল হোসেন শিক্ষার্থীদের বেত্রাঘাত করেন, একই আচরণ করেন চিনাইর আঞ্জুমান আরা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারি প্রধান শিক্ষক আব্দুল হান্নান মোহন ও সিনিয়র শিক্ষক কোহিনূর বেগম। তারা ছাত্রদের বেত্রাঘাত ও ছাত্রীদের চুলের মুঠি টেনে হেনস্থা করে ৪ জন শিক্ষার্থীকে পুলিশের হাতে তুলে দেন! পুলিশ জনসম্মুখেই দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক শিক্ষার্থীকে অনেক মারধর করেন। আমাদের প্রশ্ন এগুলো কী শিক্ষকদের আচরণ হতে পারে? কিংবা পুলিশ কীভাবে বিনা অপরাধে আমাদেরকে আটক করে থানায় রাখতে পারল?
ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চিনাইর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ডিগ্রি কলেজের এক শিক্ষক মত ও পথকে বলেন, সাবেক গণপূর্তমন্ত্রী উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী আমাদের এই কলেজের প্রতিষ্ঠা ও দীর্ঘদিনের সভাপতি ছিলেন। তিনি এই অত্র অঞ্চলের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যাপক উন্নয়ন করায় তার সঙ্গে শিক্ষার্থীদের আবেগ মিশ্রিত রয়েছে। সেই আবেগ থেকেই তারা সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে তাঁর মুক্তি চেয়ে বিক্ষোভ মিছিল বের করে। এটি তারা করতেই পারেন, কিন্তু এই কর্মসূচি পালনের ফলে তাদের সঙ্গে যা হয়েছে তা অনভিপ্রেত ও অগ্রহণযোগ্য। বিশেষ করে পুলিশ হয়রানির বিষয়টি কোনোভাবেই সমর্থন করা যায় না।
তিনি আরও বলেন, শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করার কিছুক্ষণ পরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মোজাফফর হোসেনের নেতৃত্বে পুলিশের একটি টিম এসে আমাদের শিক্ষকদের সঙ্গে খুবই রূঢ় ভাষায় কথা বলেন। তিনি আমাদের কাছে কোন কোন শিক্ষার্থী বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের নাম-ঠিকানা জানতে চান, অন্যথায় আমাদেরকেও গ্রেফতার করে নেওয়ারও হুমকি দেন। তখন আমরা সবাই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ি।
এদিকে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের পর এলাকাজুড়ে পুলিশি হয়রানির খড়গ নেমে এসেছে। প্রতিদিন বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন পুলিশ ও ডিবির একাধিক টিম। এ অবস্থায় ভয় ও আতঙ্কে দিন পার করছে সাধারণ মানুষ। কখন কার বিরুদ্ধে মামলা হয় এই আতঙ্কে তটস্থ তারা।
এ বিষয়ে জানতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মোজাফফর হোসেনের মুঠোফোনে কল দিলেও তার নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।