অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিনে প্রত্যাশা ও হতাশা

এম এম আকাশ

এম এম আকাশ। ফাইল ছবি

কথায় বলে– বৃক্ষের পরিচয় ফলে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের বয়স অবশ্য বেশি নয়। সুতরাং তার ফল এখনই আমরা পুরোপুরি বুঝতে পারব, তা হয়তো সঠিক প্রত্যাশা হবে না। তবে এর মধ্যেই কয়েকটি সমস্যা ও জটিলতার লক্ষণ মানুষকে ক্রমশ সন্দেহ ও হতাশার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সেই প্রশ্ন, হতাশা ও এর বিপরীতে এখনও জনগণের মধ্যে বিদ্যমান আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং প্রত্যাশা একে একে তুলে ধরা হলো–

হতাশা এক : দক্ষিণপন্থাপ্রীতি

প্রথম থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার রেডিক্যাল গণতান্ত্রিক শক্তি ও বামপন্থিদের প্রতি তেমন অনুরাগ দেখাল না। জামায়াতসহ দক্ষিণপন্থি শক্তির প্রতিই তার পক্ষপাতিত্ব ক্রমশ বড় হয়ে ফুটে উঠল। যদিও উপদেষ্টামণ্ডলী নির্বাচনের সময় ড. ইউনূস কর্তৃক নির্দলীয় লোকদেরই এবং একজন বামপন্থিকেও মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে এবং বিভিন্ন কমিশনপ্রধান ও টাস্কর্ফোসপ্রধান নির্বাচনের সময়ও কিছুটা দলনিরপেক্ষতা ও প্রগতিশীলতা বজায় রাখা হয়েছে।

হতাশা দুই : অনিশ্চিত গণতন্ত্র 

এখন পর্যন্ত সরকার কতদিন থাকবে এবং ন্যূনতম কোন কাজগুলো করবে, তার একটি সুস্পষ্ট রোডম্যাপ দিতে পারেনি। এটা নিশ্চয় সরকারের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। মনে হয়েছিল, নির্দলীয় নির্বাচন কমিশন গঠন দ্রুত সমাপ্ত করে, নির্বাচনে সব গণতান্ত্রিক দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে, টাকা-পেশিশক্তি ও প্রশাসনিক প্রভাবমুক্ত একটি অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ-অংশগ্রহণমূলক এবং লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডে নির্বাচনের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার উদ্যোগ নিয়ে তার সু‌নি‌র্দিষ্ট পরিকল্পনাটি তুলে ধরবে। যেখানে সব গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে। কিন্তু সরকার এই পথে না গিয়ে কমিশন গঠন করে বিষয়টি তিন মাস পিছিয়ে দিয়েছে।

আমরা মনে করি, জনগণ আর কোনো দখলদার বা স্বৈরাচারের রাজত্ব চায় না। কিন্তু নানাভাবে সর্বত্র নতুন দখলদারদের ক্ষমতা কাঠামো গড়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে। হামলা-মামলা ও মব আক্রমণের মাধ্যমে কখনও ঘৃণিত, কখনও আধা-ঘৃণিত, আবার কখনও নির্দোষ ব্যক্তিদেরও ধরে ধরে আক্রমণ অব্যাহত আছে। ‌কিন্তু এক‌টি দলের সব সদস্য-সমর্থক যে সমান অপরাধী ছিলেন না– সেটাও বিবেচনায় নিতে হবে। নানা রকম মিথ্যা ট্যাগ লাগিয়ে বাক্‌-ব্যক্তি-সংগঠনের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করা আইনসংগত হ‌বে না। এর ফলে ভীতি ও অনিশ্চয়তা ফিরে আস‌বে ও এসেছে। আগামীতে ত্রয়োদশ নির্বাচন করতে হবে এবং কা‌দের নিয়ে তা হবে– এটি নিয়ে এই অনিশ্চিত অবস্থা যত দ্রুত কমিয়ে একটি অবাধ সুষ্ঠু প্রতিযোগিতামূলক আবহাওয়া তৈরি করা যাবে, ততই গণতন্ত্র বিপদমুক্ত, অংশগ্রহণমূলক হ‌বে।

হতাশা তিন : অর্থনৈতিক ব্যর্থতা

বাজারে খাদ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেও সরকার ব্যর্থ হয়েছে। মানুষের হতাশা তাই এ ক্ষেত্রে একটুও কমেনি। ব্যাংকিং খাতে ঋণখেলাপিদের সম্পূর্ণ তালিকা প্রকাশ করে দ্রুত তাদের কাছ থেকে অর্থ উদ্ধার বা তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা এবং তাদের বিদেশে পাচারকৃত অর্থ উদ্ধার করে দেশে ফিরিয়ে আনা– এসব বিষয়ে কতটুকু দৃশ্যমান অগ্রগতি হলো, তা নিয়ে কোনো সুস্পষ্ট হিসাব বা তালিকা আজও আমাদের হাতে এখনও আসেনি। তবে দেশের ধনিক শ্রেণিপক্ষ যেহেতু প্রভাবশালী রাজনৈতিক বিভিন্ন দলের সমর্থক গোষ্ঠী আগে থেকেই ছিল, সেহেতু তাদের মধ্যে একই অপরাধে দুই রকম ফল ঘটতে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। এখন যারা সরকার সমর্থক তারা যদি শাস্তিমুক্ত থাকতে পারে, তাহলে তোষণমূলক পুঁজিবাদই আবার নতুনরূপে ফিরে আসবে। চোখ বন্ধ করে ন্যায়বিচার করতে গেলে সর্বপ্রথম প্রয়োজন দলমত নির্বিশেষে অর্থনৈতিক অপরাধীদের একটি সঠিক নিরপেক্ষ তালিকাবিশিষ্ট অর্থনৈ‌তিক শ্বেতপত্র প্রকাশ। তবে অর্থনৈতিক শ্বেতপত্রের আহ্বায়ক জানিয়েছেন, এ দায়িত্ব তাঁর একার নয়। দুর্নীতিবিরোধী টাস্কফোর্সের যিনি প্রধান, তিনিও এই কাজে যুক্ত রয়েছেন। এ ছাড়া ব্যাংকিং খাতের টাস্কফোর্সপ্রধান ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নবনিযুক্ত গভর্নরও এ কাজের সঙ্গে যুক্ত। বিদ্যমান আইন মন্ত্রণালয় ও সরকারপ্রধানের অনুমোদনও লাগবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এসব অতি গুরুত্বপূর্ণ শক্তিশালী টিম ও টিমপ্রধান সম্মিলিত ও নির্দলীয়ভাবে সব রকম আর্থিক অপরাধী, ব্যাংক অপরাধী, জ্বালানি অপরাধী এবং অবকাঠামো খাতের অপরাধীদের শনাক্ত করে তাদের দুর্নীতির মোট পরিমাণ উদ্ঘাটন এবং তাদের সেই আত্মসাৎকৃত অর্থ উদ্ধার; নিদেনপক্ষে তাদের বিরুদ্ধে আর্থিক মামলা ও বিচার করে যথাযোগ্য শাস্তি বিধান করতে পারবেন কি? বস্তুত এটাই হবে বর্তমানে সরকার ও টিমের শ্রেণিনিরপেক্ষতা বা শ্রেণিপক্ষপাতিত্ব নির্ধারণের এক ধরনের এসিড টেস্ট। তবে ঢিলেঢালাভাবে অসৎ আমলা, অসৎ রাজনীতিবিদ ও অসৎ ব্যবসায়ীদের ত্রিভুজ ক্ষমতা কাঠামোকে বুড়ি ছোঁয়া বা লোক দেখানো প্রতীকী কয়েকজনকে আঘাত করেই অভিযানে ক্ষান্ত হলে জনগণ পুনরায় বলতে বাধ্য হবে– ‘কুকুরের লেজ সোজা হলো না’; প্রমাণিত হলো, লোক সরানো সোজা কিন্তু বিপ্লব বা ব্যবস্থা বদল কঠিন। ‘বিপ্লব’, ‘দ্বিতীয় রিপাবলিক’ বা ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ বলে যারা শুরুতে অতি উচ্চকিত হয়েছিলেন, তারাও এখন বলতে বাধ্য হচ্ছেন– ‘আমরা আহাম্মকের স্বর্গে বসবাস করছিলাম।’

সর্বশেষ হতাশা : দায়মুক্তির হতাশা

সম্প্রতি সরকার তার দায়মুক্তির জন্য একটি খসড়া অধ্যাদেশ প্রণয়ন করেছে। এটি এখন গেজেট প্রকাশের অপেক্ষায়। সবাই জানেন, এ সরকারের চরিত্র ‘না বিপ্লবী-না সাংবিধানিক’। যেহেতু কোটা আন্দোলনকারীদের একাংশ দাবি করে, এটি একটি ‘বিপ্লবী সরকার’; এটি সাংবিধানিক বিধির অধীন কোনো সরকার নয়, সেহেতু এ সরকারের মধ্যে তার দায়মুক্তি নিয়ে ভাবার তাগিদ কীভাবে তৈরি হলো, সেটা জনগণ এখনও বুঝে উঠতে পারেনি। অধ্যাদেশের যে খসড়া সংবাদপত্রে ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে, তাতে সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয় হচ্ছে, এই অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো কাজ নিয়ে কোথাও ভবিষ্যতে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। এটা এক ধরনের ইনডেমনিটি আইন, যা আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের গণতান্ত্রিক স্পিরিটের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ নয়। অতীতে অবশ্য অনেক অগণতান্ত্রিক শক্তি এ ধরনের অধ্যাদেশ দিয়ে নিজেদের নিরাপত্তা রক্ষা করতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বা ২০০২ সালের ক্লিনহার্ট অপারেশনের ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স বা ‘রক্ষীবাহিনী’র ইনডেমিনিট অর্ডিন্যান্স– সবই যেহেতু মৌলিকভাবে এক ধরনের বেআইনি কাজ ছিল, সেহেতু তা নিয়ে পরে গণতান্ত্রিক শাসনামলে আদালতে নতুন করে প্রশ্ন তুলে ধরা সম্ভব হয়েছে এবং কোথাও কোথাও সেগুলো খারিজও করা গেছে।

সর্বশেষ বলতে চাই, অধ্যাদেশ দিয়ে নিরাপত্তা অর্জিত হবে না। বর্ধিত জনকল্যাণ, বৈষম্য হ্রাস ও প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেই এই অন্তর্বর্তী সরকারকে নি‌জে‌দের দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন এবং জনগণের মন থেকে প্রশ্ন ও হতাশা দূর করতে হবে। সেটাই হবে তাদের শ্রেষ্ঠ রক্ষাকবচ। আরেকটি কথা না বলে পারছি না। সেটা হচ্ছে, ট্রাম্পের জয়ের পর ভূরাজনীতিতে নতুন করে কোনো প্রতিকূল পরিবর্তন হলে তা প্রত্যক্ষভাবে এই মুহূ‌র্তে বর্তমান সরকারকেই মোকাবিলা করতে হবে।

লেখক : প্রাক্তন অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

শেয়ার করুন