আড়াইশ’, সাড়ে তিনশ’ কিংবা ৫-৭’শ জনের নামে একের পর মামলা হচ্ছে। মুখে মুখে এই খবর। পাশাপাশি মামলার ড্রাফট কপি ছড়িয়ে পড়ছে ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ বা অন্য কোনো অনলাইন মাধ্যমে। এরপরই আসে মামলা থেকে নাম বাদ দিতে টাকার প্রস্তাব। রফাদফা হলেই মুক্তি। প্রকৃত অপরাধীদের বাদ দিয়ে বাণিজ্যের সুবিধার্থে প্রাথমিকভাবে বিত্তশালীদের নাম দিয়ে সাজানো হয় মামলার খসড়ার আসামি তালিকা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মামলা বাণিজ্যের এই অভিযোগ এখন ব্যাপক আলোচিত।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে বিস্তর লেখালেখি হচ্ছে। পুলিশ বলছে, মামলা বাণিজ্যের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের ধরার চেষ্টা চলছে। এ নিয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে সতর্কতামূলক বিজ্ঞপ্তিও দেয়া হয়েছে।
পুলিশ সুপারের কার্যালয় থেকে পাওয়া হিসাবে ৫ই আগস্টের পর জেলার বিভিন্ন থানায় রাজনৈতিক মামলা হয়েছে ২৯টি। এসব মামলায় এজাহারনামীয় আসামি করা হয়েছে ১৯২৯ জনকে। প্রত্যেক মামলায় আরও এক-দেড়শো জন অজ্ঞাতনামা আসামি রয়েছে। এ ছাড়া আদালতেও হয়েছে বেশ কয়েকটি মামলা।
থানায় হওয়া মামলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে সদর মডেল থানায় ১৩টি। অন্য থানার মধ্যে আখাউড়ায় ৫টি, আশুগঞ্জে ৪টি, নবীনগরে ২টি এবং সরাইল, নাসিরনগর, বাঞ্ছারামপুর, কসবা ও বিজয়নগর থানায় ১টি করে মামলা হয়েছে। এসব মামলার বেশির ভাগই হত্যার অভিযোগে করা।
এদিকে থানা ও আদালত মিলিয়ে সবচেয়ে বেশি মামলা দায়ের করা হয়েছে সাবেক গণপূর্তমন্ত্রী যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর বিরুদ্ধে। তাঁকে আসামি করা হয়েছে ১১টি মামলায়! তিনি ঢাকার একটি মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে রয়েছে। মিথ্যা ও কল্পিত মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ইতোমধ্যে বিক্ষোভ করেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা।
শহরের দক্ষিণ মোড়াইলের ওষুধ ব্যবসায়ী মো. মোবারক হোসেনকে বাদী বানিয়ে তৈরি করা একটি মামলার এজাহারের খসড়া কপি গত মাসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ায়। এ বিষয়ে গত ৩১শে অক্টোবর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন মোবারক। যাতে তাকে বাদী দেখিয়ে মামলার ভুয়া এজাহার তৈরি করে হোয়াটসঅ্যাপ-ফেসবুকে দেয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। মোবারক হোসেন জানান, মামলার কপি ভাইরাল হওয়ার পরই তার ছোট ভাই মোকাররম হোসেন রবিন ফোন করে মামলার বিষয়টি সত্য কিনা তার কাছে জানতে চান। আমি কোনো কিছু জানি না বলে তাকে জানাই এবং নিরাপত্তার জন্যে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করি। এটি কেন করা হয়েছে তা বুঝতে পারছি না। শত্রুতামূলক কেউ করে থাকতে পারে।
গত ২৮শে অক্টোবর সাড়ে ৩’শ জনের বিরুদ্ধে সদর মডেল থানায় একটি মামলা হয়েছে। এরআগে থেকেই অনলাইনে ভেসে বেড়াচ্ছিল এই মামলার কপি। নাম প্রকাশ না করে এক ব্যবসায়ী জানান-তিনি ওই মামলার ৫ রকম আসামি তালিকা পেয়েছেন। দেখা গেছে একটিতে কারও নাম আছে, অন্যটিতে নেই। আসামিদের নামও আগে পিছে করা হয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী কৃষক দল যুক্তরাজ্য শাখার সদস্য সচিব ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা জাতীয়তাবাদী ফোরাম ইউকে’র আহ্বায়ক শাহ মোহাম্মদ ইব্রাহিম মিয়া বলেন, এই মামলাটি হওয়ার ৩ দিন আগে অনলাইনে ৩০০ জনের নামে মামলা হচ্ছে মর্মে একটি এজাহারের কপি পাই। আমার ছোট ভাই শাহ মোহাম্মদ ইয়াছিন মামলার কপিটা হোয়াটসঅ্যাপে আমাকে পাঠায়। পরে দেখলাম থানায় রেকর্ডকৃত মামলায় আমার দুই ভাই ইয়াছিন ও কাওসারের নাম যথাক্রমে ২৯ ও ৩০ নম্বরে রয়েছে। অথচ আমার পুরো পরিবার বিএনপি’র রাজনীতিতে যুক্ত। মামলার কপি পাওয়ার পরই ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের বিএনপি নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছিলাম।
জেলা শহরের কাজীপাড়ার বাসিন্দা ইব্রাহিম আরও বলেন, এই শহরে কে আওয়ামী লীগ আর কে বিএনপি-এটা চিহ্নিত। যেসব মামলা হচ্ছে, আমার জানামতে, আসামিদের ২০ ভাগও ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয়।
সম্প্রতি আরও একটি মামলা ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপ ম্যাসেঞ্জারে ঘুরছে। সেইসঙ্গে বাণিজ্যের কথাবার্তাও হচ্ছে। আলোচনা আছে শহরের এক ধনাঢ্য ব্যক্তির কাছে দুটি মামলা থেকে তার নাম বাদ দেয়ার জন্যে ২৫ লাখ টাকা চাওয়া হয়। আরেক জনের কাছে ১৫ লাখ টাকা। মামলা থেকে বাঁচতে কেউ কেউ ২/৩ লাখ টাকা করে দিয়েছেন এমন তথ্যও চাউর আছে। নাম কাটার জন্যে সর্বনিম্ন ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত নেয়া হচ্ছে। মামলায় আসামি করার ভয় দেখিয়েও অনেকের কাছে টাকা চাওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে জেলা শহর থেকে গ্রামের আনাচে-কানাচে পর্যন্ত এক আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। তবে এ নিয়ে ভয়ে কেউ মুখ খুলছেন না।
মামলা বাণিজ্য চরমে ওঠার পর গত ২৯শে অক্টোবর সদর মডেল থানা পুলিশ একটি সতর্ক বিজ্ঞপ্তি দেয়। থানার অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ মোজাফফর হোসেন স্বাক্ষরিত এই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়- সম্প্রতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে কতিপয় ব্যক্তি কম্পিউটার টাইপের মাধ্যমে ২০০/৩০০ বা তার অধিক ব্যক্তির নাম উল্লেখপূর্বক মামলার অভিযোগ/এজাহার লিখে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। মামলায় তাদের নাম ডুকিয়ে দেয়া ও মামলা থেকে নাম বাদ দেয়ার কথা বলে টাকা-পয়সা আদায়সহ জনমনে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। এরূপ এজাহার বা অভিযোগ দেখে কেউ আতঙ্কিত বা ভয় পেয়ে কোনো প্রকার টাকা পয়সা লেনদেন না করার জন্যে সতর্ক করার পাশাপাশি এমন এজাহার বা অভিযোগ দেখলে আতঙ্কিত না হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর মডেল থানায় যোগাযোগ করতে বলা হয়।
মামলা বাণিজ্য নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন জেলার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও। জেলা হেফাজত ইসলাম নেতা মুফতি জাকারিয়া খান বলেন, যারা মামলার নামে ফায়দা হাসিল করছে তাদের যেন আইনের আওতায় আনা হয়।
জেলা জামায়াতে ইসলামীর সাধারণ সম্পাদক মোবারক হোসেন বলেন, ৫ই আগস্টের পর আমরা সুন্দর পরিবেশেই বসবাস করছিলাম। এখন দেখা যাচ্ছে মামলাকে পুঁজি করে বাণিজ্য করছে। এটা দুঃখজনক। একজন ব্যক্তি হত্যা হয়েছে বা কোনো ঘটনার শিকার হয়েছে। এখানে ৩৫০ জন, আড়াইশো বা ৫’শ লোক আসামি হওয়া যুক্তিসঙ্গত নয়।
জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি কামরুজ্জামান মামুন বলেন, মামলা ফাইল হওয়ার আগে অনলাইনে দিয়ে বা লিস্ট দেখিয়ে যে বাণিজ্য করা হচ্ছে তা অনৈতিক। এনিয়ে আমি খুবই বিব্রত। এ ধরনের হয়রানির শিকার কেউ হোক আমি চাই না। যারা এটা করছে এদের বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে তাদের আইনের আওতায় আনা হোক।
জেলা বিএনপি’র সদস্য সচিব সিরাজুল ইসলাম বলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ইদানিংকালে কিছু মামলার কপি ঘুরে ফিরে বিভিন্ন আইডিতে পোস্ট করা হচ্ছে। এসব কপি ফেসবুকে দিয়ে কেউ কেউ ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার চেষ্টা করছে। এতে বিএনপি জড়িত নয়। আমি নিজেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখতে পাই, কিছু মানুষ মামলা বাণিজ্যের জন্যে কারও কারও নাম লিস্ট করে পোস্ট করছে। এ নিয়ে অনেক মানুষ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। আমি ওসি এবং পুলিশ সুপারকে বিষয়টি অবগত করে অনুরোধ করেছি এ ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে।
পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জাবেদুর রহমান বলেন, বিষয়টি জানার পর থেকে আমরা বিভিন্ন জায়গায় রেইড দিয়েছি। আমি ওসিকে বলেছি যেহেতু টাইপ হয়, কম্পিউটার আকারে অনলাইনে যাচ্ছে সেজন্যে কম্পিউটারের দোকানগুলোতে রেইড দিতে বলেছি। এজন্যে আমাদের কম্পিউটার এক্সপার্টদের নিয়ে যেতে বলেছি। তারা গিয়ে কম্পিউটারে সার্চ করে দেখবে। তাদের সেইভ ফাইলে এ ধরনের কোনো কিছু আছে কিনা। বাজার কেন্দ্রিক আমরা কিছু পাইনি। পরবর্তী সন্দেহ কোর্টভিত্তিক। এজাহার লেখার জন্যে অভিজ্ঞতার দরকার পড়ে। যারা এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তারা। আমরা ওই জায়গায় হাত দেবো। আমরা এ নিয়ে গোপনে কাজ করছি। যেই হোক এটা অন্যায় জিনিস। এটাকে অবশ্যই নির্বৃত্ত করতে হবে। আমি এটা করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ। যে জড়িত থাকবে তাকে ছাড় দেবো না।