‘মেগা মানডে’: সংঘাতে রণক্ষেত্র মোল্লা কলেজ, আহত শতাধিক

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজধানীর ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে হামলা-ভাঙচুর। সংগৃহীত ছবি

ঢাকার মাতুয়াইলের মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা সংঘর্ষে জড়িয়েছে।

সোমবার বেলা ১২টা থেকে মোল্লা কলেজের সামনে প্রায় দুই ঘণ্টার এ সংঘর্ষে শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছে।

ঢাকা মেডিকেল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মো. ফারুক জানান, বিকাল সোয়া ৪টা নাগাদ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ৩০ জনকে আহত অবস্থায় আনা হয়, যার মধ্যে দুই-তিনজন চালক ও পথচারী আছে।

তাদের মধ্যে পরিচয় পাওয়া কয়েকজন হলেন- সোহরাওয়ার্দী কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষের রাজীব (১৯) ও দ্বিতীয় বর্ষের শাহেদুল (২০); কবি নজরুল সরকারি কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষের রানা (২০), মারুফ (১৯), রুমান (১৯), হাসিনুর (১৯), আরাফাত (১৯); একই কলেজের স্নাতক প্রথম বর্ষের অনুপম দাস (২৩) ও দ্বিতীয় বর্ষের সুমন (২২) এবং ইম্পেরিয়াল কলেজ হাতিরঝিল শাখার উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম বর্ষের হুমায়ুন (২০)।

কবি নজরুল ইসলাম সরকারি কলেজের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী শরীফ হোসেন বলেন, তাদের কলেজের এবং সোহরাওয়ার্দী কলেজের অন্তত ৫০ জন আহত হয়েছে।

“রোববারের হামলার ঘটনার প্রতিবাদে আমরা মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের সামনে শান্তিপূর্ণ অবস্থান নেওয়ার সময় ওই কলেজের পক্ষ হয়ে সন্ত্রাসীরা আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছে।”

সংঘর্ষে আহত হয়ে ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গেছে সোহরাওয়ার্দী ও নজরুল কলেজের অন্তত ৩০ শিক্ষার্থী।

তাদের মধ্যে পরিচয় পাওয়া কয়েকজন হলেন- নাইম (২০), সিয়াম (১৯), মোল্লা সোহাগ (১৮), রাজিম (১৭), শরিফুল (১৭), জাহিদ (২৫), মোস্তফা (২৩), রাতুল (২১), শফিকুল ইসলাম (২৬), মেহেদী হাসান (২৪), সজীব বেপারী (২৮), ফয়সাল (১৯), সাগর (২১), ইমন (২৪), সিয়াম (১৮)।

ন্যাশনাল মেডিকেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক মাহমুদ বিকাল সোয়া ৩টায় গণমাধ্যমকে বলেন, “এখন পর্যন্ত প্রায় ৩০ জন আহত এসেছে আমাদের কাছে। এদের মধ্যে ১০ জনের অবস্থা গুরুতর। তার মধ্যে কয়েকজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে যেতে বলেছি। তাদের সেখানে ভর্তি হতে হবে। আমাদের জরুরি বিভাগে ভর্তি আহতদের আমরা পর্যবেক্ষণে রেখে চিকিৎসা দিচ্ছি।”

পুরান ঢাকার ন্যাশনাল মেডিকেলে মাহাবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থী অভিজিতের মৃত্যুর ঘটনায় রোববার ঘেরাও কর্মসূচি দেওয়া হয়েছিল। পূর্বঘোষিত সেই ‘সুপার সানডে’ কর্মসূচির মধ্যে ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল ও পাশের সোহরাওয়ার্দী কলেজে ব্যাপক ভাঙচুর চালায় মোল্লা কলেজসহ কয়েকটি কলেজের শিক্ষার্থীরা।

ওই সময় সোহরাওয়ার্দী কলেজ কেন্দ্রে অনার্স প্রথম বর্ষের পরীক্ষা দিচ্ছিলেন নজরুল কলেজের শিক্ষার্থীরা। গণ্ডগোলের মধ্যে নিরাপত্তার কারণে মাঝপথে পরীক্ষা স্থগিত করা হয়।

ওই হামলা ও লুটপাটের প্রতিবাদে সোমবার ‘মেগা মানডে’ কর্মসূচির ডাক দেন সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা।

এর অংশ হিসেবে সোমবার সকাল থেকে সোহরাওয়ার্দী কলেজের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাস প্রাঙ্গণে জড়ো হতে শুরু করেন। পরে তারা মিছিল নিয়ে কবি নজরুল কলেজের সামনে আসেন।

এসময় নজরুল কলেজের অধ্যক্ষ মাইকে শান্ত হওয়ার আহ্বান জানালে দুই কলেজের শিক্ষার্থীরা ‘ভুয়া, ভুয়া’ স্লোগান দিতে থাকেন। পরে তারা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে ডেমরা সড়ক সংলগ্ন মোল্লা কলেজে হামলা চালায়। এসময় মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীরা তাদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়।

সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, দুই পক্ষের সংঘর্ষের মধ্যে বেশ কয়েকজনকে বেধড়ক মারধর করা হলে তারা সড়কে লুটিয়ে পড়েন। আর মোল্লা কলেজের সামনের কাঁচসহ বিভিন্ন অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

মোল্লা কলেজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশরাফ সামীর বলেন, “আমাদের এক থেকে ১২তলা পর্যন্ত সব ধ্বংস করে দিয়েছে, আগুন লাগিয়ে দিছে। আমাদের কোটি টাকার উপরে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এমন হামলার আশঙ্কায় গতকাল রাত থেকে আমাদের চেয়ারম্যান প্রশাসনের কাছে সহযোগিতা চেয়েছে, প্রশাসন সহযোগিতা করলে আজ এমন হতো না।”

হামলার তার কলেজেরই শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।

সংঘর্ষের বর্ণনা দিতে গিয়ে মোল্লা কলেজের সামনে পুলিশের ওয়ারী বিভাগের উপ কমিশনার ছালেহউদ্দিন বলেন, “২০-২৫ হাজার শিক্ষার্থী যাত্রাবাড়ী মোড় হয়ে মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে হামলার জন্য এসেছে। তারা আমাদের ওভারটেক করে চলে এসেছে। আমরা তাদের পেছনে পেছনে এসে বারণের চেষ্টা করেছি। তারা এসে ভাঙচুর করেছে, চড়াও হয়েছে। এর সাথে এলাকার জনগণও এসেছে।”

বেলা ২টার দিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এসেছে বলে জানান তিনি।

এক প্রশ্নের জবাবে পুলিশ কর্মকর্তা ছালেহউদ্দিন বলেন, “সকাল থেকে আমরা যাত্রবাড়ী মোড়ে প্রস্তুত ছিলাম- যাতে মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজ আক্রান্ত না হয়। আমরা যাত্রাবাড়ী মোড়ে পর্যাপ্ত সংখ্যক পুলিশ এপিসিসহ প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম ডিএমপি কমিশনারের নির্দেশনায়। এরপর হাজার হাজার ছাত্র আমাদের ব্যারিকেড ভেঙে মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে এসে ভাঙচুর করেছে। আমরা ঘটনাস্থলে তাৎক্ষণিকভাবে রাশ করেছি। আমরা এখানকার ছাত্র প্রতিনিধি, এ অঞ্চলের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধি, এ কলেজের অথরিটি, শিক্ষক-শিক্ষিকা আছেন সবার সাথে আলোচনা করবো। ঘটনা পরবর্তী আমাদের রেসপন্স টিম আছে। এটা সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণে যাতে আসে, সে চেষ্টা আমরা অব্যাহত রেখেছি।”

আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খোঁজা হচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, সব পক্ষকে নিয়ে বিকাল ৪টায় আলোচনায় বসতে যাচ্ছেন তারা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা হচ্ছে। যে পরিস্থিতি আসুক, এটার সমাধান আছে। প্রত্যেক সমস্যার সুরাহা আছে। আমরা সে সুরাহার পথে হাটছি। আমরা আলাপ আলোচনার মধ্য দিয়ে সকল পক্ষকে নিয়ে আমরা আলোচনায় বসছি। আলোচনার মধ্য দিয়ে আমরা সুন্দর একটি সমাধানে পৌঁছার চেষ্টা করছি।

বিকাল ৪টার দিকে মোল্লা কলেজের পরিস্থিতি শান্ত দেখা গেছে। সেখানে বিপুল সংখ্যক পুলিশ ও সেনা সদস্য অবস্থান নিয়েছে।

সেন্ট গ্রেগরী স্কুল ভাঙচুর

রোববার দুপুরে সোহরাওয়ার্দী কলেজে ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনায় পুরান ঢাকার সেন্ট গ্রেগরী স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরাও ছিল অভিযোগ তুলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে হামলার ঘটনা ঘটেছে।

রোববার সন্ধ্যা ৬টার দিকে সেন্ট গ্রেগরীতে হামলার ঘটনা ঘটে বলে জানিয়েছেন সূত্রাপুর থানার ওসি সাইফুল ইসলাম। তবে কারা হামলা চালিয়েছে তা নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি তিনি।

একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, সোহরাওয়ার্দী কলেজের একদল শিক্ষার্থী ওই হামলা চালান।

সেন্ট গ্রেগরী স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী নাজমুল ইসলাম বলেন, “হঠাৎ করে একদল পোলাপান এসে আমাদের কলেজে কলেজে হামলা চালায়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তারা কলেজ বিল্ডিংয়ের কাঁচের গ্লাস, চেয়ার, টেবিল এসব ভাঙচুর করে।

“আমাদের শ্রেণিকক্ষ, অধ্যক্ষের রুমের দরজা, শিক্ষকরুমসহ প্রায় ৩০/৪০টি কক্ষে তারা ভাঙচুর করেছে। কলেজের দ্বিতীয় তলায় একটি কক্ষে তারা আগুন ধরিয়ে দেয়।”

এ হামলার নিন্দা জানিয়ে সেন্ট গ্রেগরী স্কুল কর্তৃপক্ষ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, “সেন্ট গ্রেগরী হাই স্কুল এন্ড কলেজে বহিরাগত ৩০/৩৫ জন উশৃঙ্খল যুবক নিরাপত্তা বেষ্টনী অতিক্রম করে সন্ত্রাসী কায়দায় হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট চালিয়েছে। এ সময় তারা নিরাপত্তাকর্মী নাজমুল হক ও সুমন গোমেজকে ব্যাপক মারধর করে।

“গুরুতর আহত অবস্থায় তাদের উদ্ধার করে সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হয়েছে। সেন্ট গ্রেগরি হাই স্কুল এন্ড কলেজ এই সন্ত্রাসী হামলার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছে।’

শেয়ার করুন