বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক ও সামরিক উত্তেজনা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে একটি বৈশ্বিক যুদ্ধের আশঙ্কা ক্রমশ বাস্তবতার রূপ নিচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত, গাজায় ইসরায়েলের ধ্বংসযজ্ঞ, উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক হুমকি এবং যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন- সবকিছুই মিলে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিচ্ছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের আবারও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ফিরে আসা এবং তার যুদ্ধবিরোধী মনোভাব আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তবে প্রশ্ন হলো, এ পরিবর্তন কি উত্তেজনা প্রশমনে ভূমিকা রাখবে, নাকি পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলবে?
ট্রাম্পের পুনরাবির্ভাব এবং যুদ্ধবিরোধী অবস্থান
২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় ফিরে এসেছেন। তার প্রথম মেয়াদে (২০১৭-২০২১) তিনি আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার এবং মধ্যপ্রাচ্যে সরাসরি সংঘাতে না জড়ানোর মাধ্যমে যুদ্ধবিরোধী অবস্থানের পরিচয় দিয়েছিলেন। দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে তিনি আবারও বলেন, ‘আমেরিকা আর কোনো যুদ্ধে লড়বে না। আমাদের যুদ্ধ হবে নিজেদের সুরক্ষায়।’
যদিও ট্রাম্পের এই মনোভাব প্রশংসাযোগ্য, তার প্রশাসনের রাশিয়া এবং চীনের মতো দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক কেমন হবে, তা নিয়ে উদ্বেগ রয়ে গেছে। ন্যাটোর মহাসচিব মার্ক রুটের সঙ্গে তার সাম্প্রতিক বৈঠকে বিশ্ব নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনার কথা বলা হলেও, তার নীতিতে কতটা বাস্তবায়ন হবে, তা সময়ই বলে দেবে। তবে ট্রাম্পের যুদ্ধবিরোধী অবস্থান বিশ্বব্যাপী উত্তেজনা প্রশমনের একটি সুযোগ তৈরি করতে পারে।
রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত: উত্তেজনার চরম সীমা
রাশিয়া সম্প্রতি ইউক্রেনে নতুন ধরনের মাঝারি পাল্লার হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র ‘ওরেশনিক’ ব্যবহার করেছে। শব্দের চেয়ে ১০ গুণ দ্রুতগামী এই ক্ষেপণাস্ত্র ইউক্রেনের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অকার্যকর করে তুলেছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সরাসরি ঘোষণা দিয়েছেন, তার দেশ যুদ্ধক্ষেত্রে আরও আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগের জন্য প্রস্তুত।
অন্যদিকে, ইউক্রেনও যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের সরবরাহ করা দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলা চালিয়েছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি এরই মধ্যে বিশ্বনেতাদের কাছে উন্নত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা চেয়েছেন। এই সংঘাত এখন একটি প্রলয়ঙ্কর পরিস্থিতি তৈরি করেছে, যা কেবল দুই দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই; এটি বৈশ্বিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে।
গাজা এবং মধ্যপ্রাচ্যের সংকট
গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের সাম্প্রতিক অভিযান আরেকটি মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু, লক্ষাধিক মানুষের বাস্তুচ্যুতি এবং অবকাঠামোগত ধ্বংসের ফলে পুরো অঞ্চল অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে।
মধ্যপ্রাচ্যের এই দীর্ঘ সংঘাত আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ইরান, লেবানন এবং সিরিয়ার মতো দেশগুলো ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতাকারী ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে ট্রাম্প প্রশাসন ইসরায়েলের প্রতি তার একপক্ষীয় সমর্থন বজায় রাখলে, এ অঞ্চলের সংকট আরও ঘনীভূত হতে পারে।
উত্তর কোরিয়া এবং চীনের ভূমিকা
উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন সম্প্রতি পারমাণবিক যুদ্ধের হুমকি দিয়েছেন। উত্তর কোরিয়া ইতোমধ্যে রাশিয়ার সঙ্গে মিলে ইউক্রেনে সামরিক সহায়তা দিচ্ছে। কুরস্ক অঞ্চলে উত্তর কোরিয়ার সেনাদের উপস্থিতি এবং ইউক্রেনীয় সেনাদের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ একটি বড় ধরনের সংঘাতের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
অন্যদিকে, চীন একটি পরাশক্তি হিসেবে তার অবস্থান সুদৃঢ় করার চেষ্টা করছে। তাইওয়ান ইস্যুতে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছে। এই পরিস্থিতি একটি নতুন সামরিক সংঘর্ষের আশঙ্কা তৈরি করছে। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের হত্যা ও ধ্বংসের ভয়াবহতা বিশ্ববাসীর বিবেককে আলোড়িত করছে।
তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ: সম্ভাব্য পরিণতি
তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুধু রাষ্ট্রীয় সীমান্তে সীমাবদ্ধ থাকবে না; এটি পুরো মানব সভ্যতার অস্তিত্ব চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে।
১. মানবিক বিপর্যয়: অসংখ্য মানুষের মৃত্যু, পারমাণবিক অস্ত্রের তেজস্ক্রিয়তা এবং পরিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি।
২. বিশ্ব অর্থনীতি ভেঙে পড়া: যুদ্ধের ফলে জ্বালানি সংকট, খাদ্য ঘাটতি এবং সরবরাহ ব্যবস্থার ধস পুরো পৃথিবীকে বিপর্যস্ত করবে।
৩. জলবায়ু পরিবর্তন: যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞ পরিবেশকে এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে, যা পৃথিবীতে জীবনধারণ কঠিন করে তুলবে।
যুদ্ধ এড়ানোর উপায়: শান্তির পথে প্রত্যাবর্তন
তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের এই অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসতে হলে বিশ্বনেতাদের দায়িত্বশীল ভূমিকা নিতে হবে।
১. কূটনৈতিক আলোচনা: রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত, গাজার সংকট এবং চীন-তাইওয়ান উত্তেজনা কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে।
২. অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ: পারমাণবিক অস্ত্রধারী দেশগুলোকে অস্ত্র সীমিতকরণ চুক্তি কার্যকর করতে হবে।
৩. জাতিসংঘের কার্যকর ভূমিকা: জাতিসংঘকে নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়ে আন্তর্জাতিক সংকট নিরসনে আরও সক্রিয় হতে হবে।
৪. মানবাধিকারের প্রতি সম্মান: প্রতিটি সংঘাতের মূলে মানবাধিকারের লঙ্ঘন রয়েছে। তাই মানবাধিকারকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।
ট্রাম্প প্রশাসনের সম্ভাব্য ভূমিকা
ডোনাল্ড ট্রাম্পের যুদ্ধবিরোধী মনোভাব যদি বাস্তবে রূপ নেয়, তবে তিনি বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন। ট্রাম্পের প্রশাসন যদি রাশিয়া এবং চীনের সঙ্গে একটি কার্যকর সহযোগিতা গড়ে তুলতে পারে, তবে যুদ্ধের সম্ভাবনা অনেকাংশে কমে যেতে পারে। তবে এজন্য প্রয়োজন যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর দায়িত্বশীল পররাষ্ট্রনীতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষা।
মানবতার জন্য একসঙ্গে কাজ করার আহবান
আজকের পৃথিবী এমন এক সংকটময় অবস্থায় রয়েছে, যেখানে প্রতিটি দেশকে নিজের স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করতে হবে। যুদ্ধ কোনো সমস্যার সমাধান নয়; এটি মানব সভ্যতার ধ্বংসের পথ ত্বরান্বিত করে। কূটনীতি, সহমর্মিতা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতাই পারে এই উত্তেজনা থেকে বিশ্বকে রক্ষা করতে।
মানবতার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে বিশ্ববাসীকে শান্তির পথ বেছে নিতে হবে। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ এড়াতে এখনই কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। যুদ্ধ নয়, প্রয়োজন একটি সহনশীল পৃথিবী যেখানে সব জাতি, ধর্ম এবং রাষ্ট্র নিরাপদে সহাবস্থান করতে পারে। বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ একটি মানবিক বিশ্বব্যবস্থা কামনা করছে।
লেখক : রাজনীতিক, লেখক ও চেয়ারম্যান, বিএফডিআর।