বেইজিংয়ের অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থ রক্ষার জন্য মিয়ানমারে চীনা নিরাপত্তা কোম্পানি মোতায়েন করা হয়েছে। ফলে চীনা নাগরিকরা মিয়ানমারের চলমান গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে যেতে পারে। বিশ্লেষকরা সতর্ক করে বলেছেন, এতে সম্ভাব্য মারাত্মক ঘটনা ঘটতে পারে এবং কূটনৈতিক সংকট উস্কে দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীনা প্রকল্পগুলো পুনরায় চালু করার অনুমতি দিতে মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে রাজি করাতে গিয়ে চীনের নিরাপত্তা কর্মীরা ‘ব্যাপক চ্যালেঞ্জের’ সম্মুখীন হবে। বিশেষ করে যেহেতু অনেক প্রকল্পের অবস্থান বর্তমানে বিরোধীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এলাকায়।
মূল ভূখণ্ড ও মিয়ানমারের সাম্প্রতিক সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন মতে, চীন তার প্রকল্প ও কর্মীদের সুরক্ষার জন্য মিয়ানমারের সামরিক শাসনের সঙ্গে একটি যৌথ সুরক্ষা সংস্থা প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করছে। ২২ অক্টোবর জান্তা এই উদ্যোগ সামনে রেখে একটি সমঝোতা স্মারকের খসড়া করার জন্য কমিটি গঠন করে। বিবিসি-বার্মিজ সার্ভিসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমারে ইতোমধ্যে চারটি চীনা বেসরকারি নিরাপত্তা কোম্পানি কাজ করছে। এই প্রস্তাবটি আগস্টে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইয়ের মিয়ানমার সফর এবং এই মাসের শুরুতে মিয়ানমারের সামরিক নেতা মিন অং হ্লাইংয়ের প্রথম চীন সফরের পর উত্থাপিত হয়।
ইউনিভার্সিটি অব সাউথ অস্ট্রেলিয়ার জ্যেষ্ঠ প্রভাষক অ্যাডাম সিম্পসন বলেছেন, চীনা বেসরকারি সামরিক করপোরেশনগুলো নিরাপত্তা কার্যক্রম পরিচালনা করার ফলে চীনা নাগরিকদের গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়া এবং সম্ভবত প্রাণহানির অতি আশঙ্কা তৈরি হয়। ‘এটি নিঃসন্দেহে একটি কূটনৈতিক ঘটনার জন্ম দেবে।’ তিনি বলেন, এই চীনা কোম্পানির উপস্থিতি জান্তার পক্ষ থেকে একটি ‘বিব্রতকর স্বীকৃতি’। তারা যে মিয়ানমারে চীনা স্বার্থের মৌলিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অক্ষম– এই ঘটনা তারই স্বীকৃতি দেয়। সিম্পসন বলেন, নিরাপত্তার ভূমিকায় থাকা চীনা নাগরিকরা ‘প্রধান অর্থনৈতিক ও জনসংখ্যা কেন্দ্রগুলোর নিয়ন্ত্রণ সুরক্ষিত করতে গিয়ে বিরোধীদের তৎপরতাকে আরও জটিল করে তোলে।’
চীনের তেল ও গ্যাস পাইপলাইনের স্বার্থ রক্ষার জন্য রাখাইনের কিয়াউকপিউতে পিপলস লিবারেশন আর্মির ‘প্রক্সি’ নিয়ে ভারত সম্ভবত উদ্বিগ্ন। সিম্পসন বলেছেন, ভারতের দীর্ঘ বিলম্বিত কালাদান মাল্টি-মডেল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট প্রকল্প একই প্রদেশে হওয়ার কথা। বাংলাদেশ ‘তাদের দোরগোড়ায়’ সৈন্য নিয়ে চিন্তিত। একইভাবে থাইল্যান্ড তাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রে চীনা নাগরিকদের নিরাপত্তা কার্যক্রম নিয়ে উদ্বিগ্ন। সিম্পসন এ কথাও বলেছেন, তারা মিয়ানমারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে হয়তো বৈঠকে বসতেও ইতস্তত বোধ করবেন।
ইউনাইটেড স্টেটস ইনস্টিটিউট অব পিসের মিয়ানমার বিশেষজ্ঞ জেসন টাওয়ার বলেছেন, বেইজিং দেখেছে কীভাবে জান্তা জোরপূর্বক সেনা নিয়োগের মাধ্যমে মিয়ানমারের নিজস্ব বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থাগুলো ‘পরস্পরকে ধ্বংসকারী’ বানিয়েছে। এ কারণেই উদ্বিগ্ন যে, দুর্বল নিরাপত্তা সক্রিয় সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে চীনা প্রকল্পগুলোর অপারেশন বন্ধ করতে বাধ্য করবে। তবে চীনা নিরাপত্তা কর্মীরা দেশের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে প্রকল্পগুলো পুনরায় শুরু করার অনুমতি দিতে গিয়ে ‘ব্যাপক চ্যালেঞ্জের’ মুখোমুখি হবে। টাওয়ারের মতে, কারণ এই গোষ্ঠীগুলো হয়তো নিরাপত্তা সংস্থাগুলোকে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হিসেবে দেখে।
টাওয়ারের মতে, চীন স্পষ্টভাবে দেখছে, জান্তা তার বিনিয়োগ রক্ষা করতে লড়াই করছে। যেমন চীন-মিয়ানমার পাইপলাইন প্রকল্প ও রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন খনিসহ রাখাইন রাজ্যের কিউকফিউতে গভীর সমুদ্রবন্দরের মতো পরিকল্পিত বিনিয়োগ। তিনি এও বলেছেন, অনেক প্রকল্প এখন জাতিগত সশস্ত্র সংগঠন ও জনগণের প্রতিরক্ষা বাহিনীর মিশ্রণে নিয়ন্ত্রিত। আর সামরিক বাহিনী পাইপলাইনের বড় অংশে এখনও ঢুকতে পারেনি।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনী নিরাপত্তার জন্য ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে এবং চীনের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে। টাওয়ারের মতে, বেইজিং সেই সঙ্গে বিদেশে তার নিরাপত্তা কোম্পানি সম্প্রসারণের জন্য দেশটিকে পরীক্ষামূলক হিসেবে ব্যবহার করছে। তিনি আরও বলেন, বিপুলসংখ্যক চীনা নিরাপত্তা কর্মী পাঠিয়েও চীন অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্প নিজেদের করে নিতে পারেনি। এর মধ্যে রয়েছে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর, যেটি নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জেরও সম্মুখীন, যেখানে চীনা নাগরিকরা ঘন ঘন সন্ত্রাসী ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীর আক্রমণের নিশানা হয়েছে।
লেখক : পূর্ব এশিয়াবিষয়ক চীনা সংবাদদাতা ও বিশ্লেষক
সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট থেকে ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম