বহুল আলোচিত গ্রেনেড হামলার মামলায় সব আসামি খালাস পেয়েছেন গত ১ ডিসেম্বর হাইকোর্টের এক রায়ে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকায় তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশে নৃশংস গ্রেনেড হামলা হয়েছিল। এতে ২৪ জন নিহত ও তিন শতাধিক আহত হন। সে মামলায় নিম্ন আদালতে ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।
দণ্ডিতদের মধ্যে ছিলেন বিএনপির বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ বিএনপি ও জামায়াতের আরও কয়েক নেতা। হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি আবদুল হান্নানও এ মামলায় মৃত্যুদণ্ড পেয়েছিলেন। তবে ২০০৪ সালেরই মে মাসে বাংলাদেশে নিযুক্ত তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা মামলায় ২০১৭ সালে মুফতি হান্নানের ফাঁসি কার্যকর হয়।
হাইকোর্ট বিচারিক আদালতের রায়কেও বাতিল ঘোষণা করেছেন। একই সঙ্গে মামলায় সব আসামির খালাসের পেছনে কিছু কারণও তুলে ধরেছেন। বলা হয়েছে, মুফতি আবদুল হান্নানের দ্বিতীয় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি এবং সম্পূরক চার্জশিটের ভিত্তিতে মামলার বিচার করা ছিল ‘অবৈধ’। এ মামলায় ২০১১ সালে আসামি মুফতি হান্নানের জবানবন্দির ভিত্তিতে সম্পূরক চার্জশিট দেওয়া হয়। আসামিপক্ষের আইনজীবীদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পরে তা প্রত্যাহার করতে চেয়েছেন মুফতি হান্নান।
হাইকোর্ট পর্যবেক্ষণে আরও উল্লেখ করেছেন, ‘এ ধরনের মামলায় পরস্পর কেউ দেখেছেন, কেউ স্বচক্ষে দেখেছেন, এই মর্মে কোনো এভিডেন্স নেই। যাদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে, তাদের টর্চার করে জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে’ (সমকাল, ২ ডিসেম্বর ২০০৪)। রায়ের পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়েছে, ‘মুফতি হান্নানের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির কোনো এভিডেনসিয়াল মূল্য নেই। এটি জোর করে নেওয়া হয়েছিল এবং সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে যথাযথভাবে যাচাই করা হয়নি’ (সমকাল, ২ ডিসেম্বর ২০০৪)।
নিঃসন্দেহে, হাইকোর্টের রায় ও পর্যবেক্ষণ নিয়ে জনমনে অনেক কৌতূহল তৈরি হয়েছে। তবে কৌতূহল নিরসন করার সক্ষমতা সাধারণ মানুষের নেই। কেবল আইনজ্ঞ, বিশেষত ফৌজদারি মামলা বিষয়ে অভিজ্ঞ আইনজীবীরাই এর ভালো ব্যাখ্যা দিতে পারেন। কিন্তু বিস্ময়কর হলো, হাইকোর্টের রায়টি নিয়ে জনপরিসরে খুব একটা আলোচনা দেখা যাচ্ছে না।
প্রধানত আসামিপক্ষের আইনজীবীদের বক্তব্যই সংবাদমাধ্যমে এসেছে। হতে পারে, যেসব আইনজীবী বিচারিক আদালতে বাদীর হয়ে মামলাটি পরিচালনা করেছেন, রাজনৈতিক পালাবদলের কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তারা আত্মগোপনে বা সংবাদমাদ্যমকে এড়িয়ে চলছেন। কিন্তু দু’পক্ষের বাইরের আইনজীবীদের খুব ছোট অংশকেই এ নিয়ে কথা বলতে দেখা গেছে, তাও বেশ সতর্কতার সঙ্গে।
জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলেতে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহবুব শফিকের একটা বক্তব্য অবশ্য এসেছে। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘আদালত বলেছেন, চার্জশিট ত্রুটিপূর্ণ। কিন্তু এটা বলে আদালত যেটা করতে পারতেন, আসামিদের ফের রিমান্ডে পাঠানো বা মামলার পুনঃতদন্ত এসব ব্যাপারে নির্দেশনা দেওয়া। কিন্তু আদালত এ ধরনের কোনো নির্দেশনা দেননি।’
রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে ভুক্তভোগী বা তাদের স্বজনের বক্তব্যও সংবাদমাধ্যমে চোখে পড়ার মতো করে আসেনি। এ নিয়ে প্রশ্নও তুলেছেন কেউ কেউ। শুধু ওই ডয়চে ভেলেতেই দেখলাম, কয়েকজন ক্ষতিগ্রস্ত ও তাদের স্বজন কথা বলেছেন, যাদের বক্তব্যের সারমর্ম হলো– তারা ন্যায়বিচার পাননি। বিষয়টা হৃদয়বিদারক।
অস্বীকার করা যাবে– ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার ২৩, বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে গ্রেনেড হামলা হয়নি? একটা-দুটো নয়, ১৩টা গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়েছিল; পাওয়া গিয়েছিল আরও কয়েকটি অবিস্ফোরিত গ্রেনেড। সেসব গ্রেনেড কেউ না কেউ তো ছুড়েছিল। তারা কারা? সেই গ্রেনেড হামলায় ২৪টি তাজা প্রাণ ঝরে গিয়েছিল; আহত তিন শতাধিক। এদের কি ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার নেই? হতে পারে, আওয়ামী লীগ হামলাটির বিচার নিয়ে রাজনীতি করতে চেয়েছে। তাই বলে তো গ্রেনেড হামলাটি মিথ্যা হয়ে যায়নি!
বিশেষভাবে উল্লেখ্য, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর বড় অংশ নিম্নআয়ভুক্ত, যেগুলোর কোনো কোনোটা একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়েছে অথবা পুরোপুরি কর্মক্ষমতা হারাতে দেখেছে। অসহায় এসব মানুষ বেঁচে থাকার উপায় হরিয়েছেন। এখন যদি বিচার থেকেও বঞ্চিত হন, তাহলে কি দ্বিগুণ জুলুমের শিকার হচ্ছেন না?
ডয়চে ভেলেকে এক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন, পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলে তা দেখে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে। কিন্তু সমকালকে ফৌজদারি মামলা বিশেষজ্ঞ আইনজীবী বলেছেন, আপিলেও এ মামলায় খুব সুবিধা হবে বলে তিনি মনে করেন না।
সন্দেহ নেই– শুরু থেকেই মামলাটি নিয়ে নানা রাজনৈতিক খেলা হয়েছে। ঘটনার পরপর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে মামলা করার চেষ্টা হলেও আওয়ামী লীগের মামলা না নিয়ে পুলিশ নিজেই মামলা করে। ওই আমলেই এ বিষয়ে বহুল আলোচিত ‘জজ মিয়া নাটক’ আমরা জানি। অন্যদিকে ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তদন্ত শেষে চার্জশিট হয়, যেখানে বিএনপির শীর্ষ নেতা তারেক রহমানসহ কারও কারও নাম ছিল না। তার ভিত্তিতে মামলা অনেক দূর এগিয়েও যায়। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে ২০১১ সালে অধিকতর তদন্তে নামে। অভিযোগ আছে, মূলত প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপির শীর্ষ নেতাকে দণ্ডিত করতেই আওয়ামী লীগ এক মামলায় কার্যত দুই চার্জশিটের ব্যবস্থা করে, যাকে হাইকোর্ট অবৈধ বলেছেন।
এটাও সত্য– দেশে বিশেষত রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে হামলা বা খুনের বিচার হয় না বললেই চলে। এ ছাড়া সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি ও শিক্ষার্থী তনু হত্যার মতো অনেক মামলাও বছরের পর বছর ঝুলে আছে। অর্থাৎ দেশে এক প্রকার বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি বহুদিন ধরেই আছে। এ কথা বলা নিশ্চয় অতিরঞ্জন হবে না, আলোচ্য রায়ের পর ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ভুক্তভোগীরাও ওই বিচারহীনতার শিকার হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হলো।
কথা হচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলোর অপকর্মের দায় তো কোনো নাগরিকের ন্যায়বিচার প্রাপ্তি আটকাতে পারে না। উপরন্তু অন্তর্বর্তী সরকার ওই বিচারহীনতার অপসংস্কৃতির অবসান ঘটিয়ে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করে রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়েছে। যে আন্দোলন এ সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়েছে, তার একটা জনপ্রিয় স্লোগান ছিল ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’– আমরা ন্যায়বিচার চাই। এই ন্যায়বিচার নিশ্চিতভাবেই সিলেকটিভ হতে পারে না; ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় ক্ষতিগ্রস্তদেরও জন্য প্রযোজ্য।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক